আমেরিকা কেন ইসরায়েলকে সমর্থন করে?


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৯ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৩

ইসরায়েলকে অন্ধভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য যুুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনা সহ্য করতে হয়। তারপরও ওয়াশিংটন বছরের পর বছর ইসরায়েলকে বড় আকারের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা সর্বজনবিদিত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের সিংহভাগ মানুষ দুটো ভিন্ন ধর্ম লালন করে। দুই দেশের ভৌগলিক অবস্থানেও আছে ব্যবধান।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত প্রায় ৭০ বছরের বেশি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গত চার দশকের হিসেবে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যেই দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, উভয়েই তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসরায়েলের স্বার্থকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছিল। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের অর্থনীতির প্রসার ও প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করে।

প্রশাসনের অন্য অনেক খাতের ব্যয় নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস আপত্তি করলেও এ বিষয়ে কংগ্রেস কখনোই বাঁধা দিয়েছে বলে জানা যায় না। মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে এরকম দেশে অর্থ সাহায্য দেয়ার বিষয়ে কংগ্রেসের উদারমনা সদস্যগন বরাবরই আপত্তি তোলেন। অন্যদিকে, রক্ষনশীল কংগ্রেস সদস্যরা অন্য দেশে অর্থ সাহায্য দেয়ার ব্যাপারেই সংকীর্ণ মানসিকতা লালন করেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, লিবারেল বা কনজারভেটিভ, উভয় মানসিকতার কংগ্রেস সদস্যরাই ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাওয়ার মার্কিন নীতি নিয়ে খুব একটা সমালোচনা করেননি।

মার্কিনীরা ইসরায়েলকে একপেশেভাবে সমর্থন করে যাওয়ায় মার্কিন মিত্র অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অবস্থান নিতে পারছে না। তবে, পশ্চিমা দেশগুলোর অধিকাংশই ১৯৬৭ সালের ইসরায়েল-আরব যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনী ভুমি দখলের প্রতিবাদে দীর্ঘ সময় ইসরায়েলকে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ করেনি। কিন্তু এখন সে অবস্থাতেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। ইসরায়েলি বাহিনীর অপশাসন, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন অনেকটা যেন বৈধতাও পেয়ে গেছে।

যতবারই জাতিসংঘে ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ততবারই ঢাল হয়ে ইসরায়েলকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এ কারণে পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

আইজাক রবিন, অ্যারিয়েল শ্যারন থেকে আজকের বেনজামিন নেতানিয়াহু, যে সরকারই ইসরায়েলে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তাকেই সমর্থন করে গেছে। যদিও এই সমর্থনের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা নৈতিক কারণকে সামনে আনে। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে নৈতিকতার যে দোহাই তুলে, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টান্ত ও যুক্তি উপস্থাপন করে থাকে।

আমেরিকার জনগনের ওপর এ পর্যন্ত যেসব জরিপ চালানো হয়েছে, তাতে দেখা যায় মার্কিন নাগরিকদের বড়ো একটি অংশ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে। তবে যেভাবে মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলকে আর্থিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তা সমর্থন করে না। মার্কিন সরকার যেভাবে এবং যে পরিমানে ইসরায়েলকে অর্থ সাহায্য ও অন্যান্য নিরাপত্তা দেয় তা বিশ্বের আর কোনো দেশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে আধুনিক ও সমৃদ্ধ করার কাজে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় হয়। আর ইসরায়েলিরা সর্বশেষ প্রযুক্তির সব অস্ত্র আর গোলাবারুদ ক্রয় করে তা দিয়ে নিরিহ ফিলিস্তিনিদেরকে হত্যা করে। মূলত আরব বিশ্বে অন্য যত সেনাবাহিনী আছে তাদের থেকে শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ইসরায়েলকে অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

ইসরায়েলিরা বর্তমানে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখল করে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে গোটা ফিলিস্তিনকেই নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসতে চায়। গাজাকে বিশ্বের বৃহত্তম মানব কারাগার হিসেবে ইসরায়েল ঘেরাও করে রেখেছে। বায়তুল মুকাদ্দাসেও মুসলিমদের নামাজ ও যাতায়াতকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। ফিলিস্তিনের আনাচে কানাচে মুসলিম সব স্থাপত্য ও নিদর্শনকে ইহুদিকরণ করা হয়েছে।

মার্কিনীরা ইসরায়েলিদেরকে দখলদারি অব্যহত রাখার জন্য সাহায্য করছে। এখন থেকে ২৫ কছর আগে মার্কিনীরা ইসরায়েলকে যে পরিমান অর্থ সাহায্য দিতো, বর্তমানে সেই পরিমান আরো অনেক বেড়েছে। যদিও এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলিরাও আর্থিক ও সামরিকভাবে আগের তুলনায় শক্তিশালী হয়েছে। তারপরও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়নি।

ইসরায়েলের এখন নিজস্ব অস্ত্র নির্মাণ শিল্প রয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সমরাস্ত্র, সাঁজোয়া যানই শুধু নয় একের পর এক মনুষ্যবিহীন ড্রোন প্রযুক্তি ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছে। ইসরায়েলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে রফতানিও হচ্ছে। এমনকী খোদ মার্কিনীরাও ইসরায়েলের তৈরি আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করছে। মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, বিশ্বের অনেক পরাশক্তি দেশকেও মোকাবেলা করার সক্ষমতা ইসরায়েলি বাহিনী অর্জন করেছে। অথচ ইসরায়েলের সামনে কোনো ধরনের সামরিক বা প্রতিরক্ষা ঝুঁকিও নেই।

ইসরায়েলিরা জুজুর ভয় তুলে ইরানের নিউক্লিয়ার স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে। ইরানসহ বিভিন্ন আরব দেশের বিজ্ঞানী ও প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতাদের গুপ্ত হত্যা করছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ কেউই এর কোনো সমালোচনা করছেনা। জো বাইডেন ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি পুনরায় চালু করার বিষয়ে আগ্রহ দেখানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও ইসরায়েল প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। আর ইসরায়েলের সেই প্রভাব দেখা যাচ্ছে ইরানের সাথে চুক্তি করা নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে। মনে হচ্ছে, আমেরিকাকেই যেনো গিলে ফেলতে চাইছে ইসরায়েল।

কিন্তু এর পরও আমেরিকা কেন দীর্ঘ এত বছর ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আসছে বিশ্লেষকরা তার বেশ কিছু কারণ উদঘাটন করেছেন। এখনো মার্কিন নীতি নির্ধারকদের বড়ো একটি অংশই বিশ্বাস করেন যে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি তা ইসরায়েলের হাত দিয়েই বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেকোনো দেশের শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেয়ে বরং ইসরায়েলকে এগিয়ে নেয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অধিক নিরাপদ হবে বলেও এসব বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের মতে ইসরায়েলের সহিংস আক্রমন এবং কূটনৈতিক চালের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বিশেষ করে লেবানন এবং জর্ডানে ইসলামী সংগঠন ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো সফল হতে পারেনি।

মিশরে মুরসি সরকারের পতন, মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়কে ইসরায়েলের কূটনৈতিক কৌশলের সফলতা বলেই মার্কিন নীতি নির্ধারকেরা মনে করেন। তারা নিজেরাও কোনো অবস্থাতেই মধ্যপ্রাচ্যে বা আফ্রিকার কোথাও এই মুসলিম গোষ্ঠীর উত্থান দেখতে আগ্রহী নন।

ধীরে ধীরে গড়ে উঠা ইসরায়েলের সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ন। যুক্তরাষ্ট্র নিজে যে কাজ করতে পারছে না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি হিসেবে ইসরায়েল তা করে যাচ্ছে। ইসরায়েলের বিমান বাহিনী এখন গোটা অঞ্চলের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ। আমীরাতসহ আরব বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় এ অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন অনেক সহজ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার ভিত্তি অনেকটা একপেশে। ইসরায়েল যত শক্তিশালী হবে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব ততটাই কমে আসবে। সম্প্রতি এফ-থার্টি ফাইভ বিমান নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তাতে বোঝা যায় , ইসরায়েলের ইশারাতেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিরক্ষা কৌশল প্রণয়ন করছে। ইসরায়েল পছন্দ না করায় তুরস্ককে এফ থার্টি ফাইভ বিমান নির্মাণ প্রকল্প থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিয়ে দেয়। তুরস্কের সমরাস্ত্র প্রতিরক্ষা শিল্পের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তুরস্কের কাছে সামরিক সরঞ্জামাদি এবং বিমানের রফতানিও বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার পুরস্কার হিসেবে আমীরাতকে এফ থার্টি ফাইভ বিমান দেয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ইসরায়েল এক্ষেত্রেও আপত্তি তুলেছে এবং সেই আপত্তির কারনে এফ থার্টি ফাইভ বিমান হস্তান্তর ব্যহত হয়েছে।

ইসরায়েলের উত্থানের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান ও পাকিস্তানকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সিআইএ অতীতে রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যেভাবে গুপ্তহত্যা করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেই এসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা। শুধু গুপ্তহত্যাই নয়, বরং সাইবার হামলা করে ইরানসহ নানা দেশকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অপটিকাল ফাইবারের লাইন ইসরায়েলের সমুদ্র উপকূলের নীচ দিয়ে নেয়া হয়েছে। ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্যের তথ্য নিয়ন্ত্রনের এটি একটি ইসরইলি ফন্দি। সম্প্রতি সুয়েজ খালে জাহাজ আটকে যাওয়া নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার কাছে ইসরায়েলি কৌশল আছে বলে মনে করা হয়। সুয়েজ খালের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইসরায়েলের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের নতুন এক পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রকের আসনে বসতে চায়। আর যুক্তরাষ্ট্র সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ইসরায়েলকে অন্যায়ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।