ইউরোফাইটার টাইফুন না রেফালে, কোনটি শক্তিশালী


  • মেহেদী হাসান
  • ২৫ এপ্রিল ২০২১, ১০:৫৪

ইউরোপের দুই শক্তিশালী যুদ্ধবিমানের নাম ফ্রান্সের ড্যাসল্ট রেফালে আর বহুজাতিক ইউরো ফাইটার টাইফুন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং স্পেন মিলে ইউরো ফাইটার টাইফুন নামে একটি ‘ফিউচার ইউরোপিয়ান ফাইটার এয়ারক্রাফট’ নির্মাণের চুক্তি হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে এ বিমান নির্মাণ প্রকল্প কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধের কারণে ফ্রান্স বের হয়ে আসে ইউরো ফাইটার টাইফুন প্রকল্প থেকে। এরপর দেশটি একাই স্বাধীনভাবে রেফালে ফাইটার জেট নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে। ইউরো ফাইটার টাইফুনের আগেই ফ্রান্স আকাশে ওড়ায় তাদের রেফালে।

ফ্রান্সের রেফালে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে একটি আলোচিত অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট। বিভিন্ন দিক দিয়ে রেফালে ছাড়িয়ে গেছে বহুজাতিক ইউরো ফাইটার টাইফুনকে। এভয়নিক্স, রাডার এবং উইপন সিস্টেমের কারণে রেফালে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচিত। একটি ফ্লাইটে একাধিক অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম রেফালে। অপরদিকে বিভিন্ন দেশের চাহিদা এবং নির্মাণের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে ইউরো ফাইটার টাইফুন।

বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ১০ ফাইটার জেটের তালিকায় চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে মধ্যে স্থান পায় ফ্রান্সের রেফালে অথবা ইউরো ফাইটার টাইফুন।

ইউরোফাইটার টাইফুনের যৌথ নির্মাতা ইউরোপের এয়ারবাস, ব্রিটেনের বিএই সিস্টেম এবং ইতালির সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো। এ বিমান নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো যুক্ত রয়েছে জার্মানি এবং স্পেন। ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু হয় এ ফাইটার জেট নির্মাণের উদ্যোগ।

অপরদিকে রেফালের নির্মাতা ফ্রান্সের ড্যাসল্ট এভিয়েশন। রেফালে প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮৬ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০১ সালে। ইউরোফাইটার টাইফুন প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৯৪ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৩ সালে। ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি বহুজাতিক যুদ্ধবিমান। অপর দিকে রেফালের নির্মাতা এককভাবে ফ্রান্স ।

ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি ফোর্থ জেনারেশন ফাইটার জেট। রেফালে ফোর প্লাস জেনারেশন ফাইটার জেট।

বহুজাতিক টাইফুন একটি বহুমুখী, এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটার জেট। টাইফুনের রয়েছে এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং এন্টি এয়ার শিপ মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। এ ছাড়া রয়েছে রিকনিস্যান্স ক্ষমতা।

ইউরো ফাইটার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শক্তিশালী এয়ার টু এয়ার আমরাম মিসাইল। রাডার গাইডেড মেটিওর এয়ার টু এয়ার মিসাইলসহ বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী মিসাইল ছুড়তে সক্ষম। এর রয়েছে শক্তিশালী গ্রাউড এন্ড এন্টি শিপ মিসাইল বহন ক্ষমতা। মিসাইল ছাড়া প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী বোমা বহন করতে পারে টাইফুন। ইউরো ফাইটার টাইফুনের অস্ত্র বহনের জন্য রয়েছে ১৩টি হার্ড পয়েন্ট। রয়েছে রিভলভার ক্যানন যা প্রতি মিনিটে ১৫০টি গুলি ছুড়তে পারে। আসুন জেনে নেই এই দুটি যুদ্ধবিমান সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

ইউরো ফাইটার টাইফুনের রয়েছে দ্রুত বাক নেয়ার উচ্চ ক্ষমতা। এ বিমান নির্মাণ করা হয়েছে আকাশে এয়ার সুপেরিয়রিটির জন্য তাই আকাশে অন্যান্য যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে অতি কাছ থেকে এবং সামনা সামনি তীব্র লড়াইয়ে সক্ষম এ বিমান। ডগ ফাইটিংয়ের জন্য বিখ্যাত টাইফুন। পাইলটদের মতে টাইফুন পরিচালনা করা অন্যান্য অ্যাডভান্সড ফাইটার জেটের তুলনায় অনেক সহজ।

অপরদিকে ফ্রান্সের রেফালে একটি বহুমুখী, এয়ার সুপ্রিমেসি ইন্টারডিকশন ফাইটার জেট। এর রয়েছে পরমানু বোমা বহনকারী মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। রেফালে একটি এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং এন্টি এয়ার শিপ মিসাইল ফাইটার জেট। এর রয়েছে গ্রাউন্ড সাপোর্ট এন্ড রিকনিস্যান্স ক্ষমতা।

রেফালে এয়ার টু এয়ার যেসব মিসাইল বহন করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আমরাম, এমবিডিএ মেটিওর, মিকা, মেজিক, সাইডউইন্ডার, আসরাম,

এয়ার টু এয়ার মেটিওর মিসাইলের নির্মাতা ইউরোপীয়ান ফার্ম এমবিডিএ। মেটিওর একটি দীর্ঘ পাল্লার রকেট এবং র‌্যাম জেট পাওয়ার্ড। এর আওতায় ১৫০ কিলোমিটার। অর্থাৎ আকাশে ১০০ কিলোমিটার দূরের শত্রু বিমানকে আঘাত করতে পারে রেফালে এবং টাইফুন।

এয়ার টু গ্রাউন্ড আক্রমনের জন্য টাইফুন এবং রেফালে উভয়ে বহন করে এপাচি, এলার্ম, হার্ম, মাভারিক. এএস৩০এল এবং পিজিএম মিসাইল ।

রেফালে ভূমিতে আক্রমনের জন্য ব্যবহার করে দীর্ঘ পাল্লার ক্রুজ মিসাইল। এ ধরনের একটি মিসাইলের ওজন ১ হাজার ৩০০ কেজি। এক থেকে দুটি এ ধনের মিসাইল বহন করতে পারে রেফালে। এ মিসাইলের আওতা ৬০০ কিলোমিটার এবং এর আঘাত ক্ষমতা নিখুত।

রেফালের এন্টি-শিপ মিসাইলের মধ্যে রয়েছে এক্সোসিট, পেঙ্গুইন৩ এবং হারপুন । ফ্রান্সের তৈরি এক্সোসিট এন্টি শিপ মিসাইলের রয়েছে রাডার ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা যা বহন করে রেফালে।

ইউরো ফাইটার টাইফুনের ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। সুপারসনিক ইউরো ফাইটার টাইফুনের সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ২। ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতি ১ হাজার ৩২০ মাইল। বিমানটির গঠন ক্যানার্ড, ডেল্টা উইং। রেফালেরও ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। রেফালের গতি শব্দের চেয়ে ১ দশমিক ৮ গুন বেশি বা ম্যাক ১পয়েন্ট ৮। ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতি ১ হাজার ১৮৮ মাইল। রেফালেরও গঠন ডেল্টা উইং। আসুন জেনে আসি আরো কিছু তথ্য

ইউরোফাইটার টাইফুনের দৈর্ঘ্য ৫২ ফিট ৪ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৩৫ ফিট ১১ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৭ ফিট ৪ ইঞ্চি। বিমানটির ওজন ১১ টন। মেক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ২৫ দশমিক ৫ টন। জ্বালানি ধারন ক্ষমতা ৫ টন।

রেফালের দৈর্ঘ্য ৫০ ফিট। ইউং স্প্যান ৩৫ ফিট ৯ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৭ ফিট ৬ ইঞ্চি। বিমানটির ওজন ১০ টন ৩০০ কেজি। ম্যাক্সিমাম টেক অফ ওয়েট ২৪ দশমিক ৫টন। রেফালের ইন্টারনাল ফুয়েল বহন ক্ষমতা ৪ দশমিক ৭ টন। এক্সটারনাল ফুয়েল বহন ক্ষমতা ৬ দশমিক ৬ টন।

রেফালের হার্ড পয়েন্ট ১৪টি। রেফালে বিমানে অটো ক্যানন গান রয়েছে যা প্রতি মিনিটে ১২৫ রাউন্ড গুলি ছুড়তে পারে। রেফালের রয়েছে রাডার, লেজার এবং মিসাইল ওয়ানির্ং রিসিভার।

বহুজাতিক ইউরো ফাইটার টাইফুন এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে ৫৭১টি। রেফালে নির্মিত হয়েছে ২০১টি।
ব্রিটেন, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, সৌদি আরব, ওমানসহ ৯টি দেশের কাছে রয়েছে ইউরো ফাইটার টাইফুন। কুয়েত ২৮টি এবং কাতার ২৪টি ইউরো ফাইটার টাইফুন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ব্রিটেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৬০টি ইউরো ফাইটার সংগ্রহ করেছে। জার্মানি ১৪৩টি, ইতালি ৯৬টি, স্পেন ৭৩টি ইউরো ফাইটার সংগ্রহ করেছে। সৌদি আরবের কাছে ৭১টি ইউরো ফাইটার টাইফুন রয়েছে।

অপর দিকে রেফালের ব্যবহারকারী দেশ হলো ফ্রান্স, ভারত, মিশর এবং কাতার। ফ্রান্স এখন পর্যন্ত দেড় শতাধিক রেফালে সার্ভিসে যুক্ত করেছে। ফ্রেন্স আর্মির ৩ শতাধিক এ বিমন সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারত ১৪টি রেফালে বিমান সংগ্রহ করেছে। ভারত মোট ৩৬টি রেফালের অর্ডার দিয়েছে। এ ছাড়া কাতার ২৫টি এবং মিশর ২৪টি রেফালে জেট সংগ্রহ করেছে।

ইউরো ফাইটার টাইফুন প্রথম যুদ্ধে অংশ নেয় লিবিয়ায় ২০১১ সালে ব্রিটেন এবং ইতালি এয়ার ফোর্সের অধীনে। অপর দিকে ২০০১ সালে সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার এক বছরের মাথায় ২০০২ সালে রেফালে অংশ নেয় আফগানিস্তানে অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডমে। অপরদিকে রেফালের শক্তি, ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা প্রমানিত। এর রয়েছে দীর্ঘ অপারেশন পরিচালনার ইতিহাস। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া অভিযানে অংশ নিয়েছে রেফালে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মিলে ইউরোফাইটার টাইফুন নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে আকাশে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকবেলা করা। এজন্য সে সময় পর্যন্ত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয় এ ফাইটার জেটে। এ বিমান নির্মাণ প্রকল্প ছিল ইউরোপের অন্যতম ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প।

আকস্মিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে পড়া এবং স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যয়বহুল এ বিমানের ভবিষ্যত নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় তখন। তবে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শুরু হয় উপসাগরীয় যুদ্ধ। এরপর থেকে গত ৩০ বছর ধরে চলছে ইরাক যুদ্ধ, ২০ বছর ধরে চলছে আফগানিস্তান যুদ্ধ। এর মাঝে যুক্ত হয়েছে লিবিয়া যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এসব অনেক অপারেশনে যুক্ত হয়েছে ইউরোফাইটার টাইফুন আর রেফালে।

প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে গত ২০ বছরে রাশিয়া আবার প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় ইউরোপের জন্য নতুন করে হুমকি হিসেবে আবির্র্ভূত হয় রাশিয়া। ফলে ইউরোফাইটার টাইফুন নিয়ে আরো বেশি অঅগ্রহী হয়ে উঠে ইউরোপের দেশগুলো।

ইউরোপের অনেক দেশ এখনো ব্যাপকভাবে সংগ্রহ করে চলছে শক্তিশালী এ ফাইটার জেট। অপর দিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সের রেফালের চাহিদাও ক্রমে বেড়ে চলেছে এবং এটি শক্তিশালী ফাইটার জেটের তালিকায় স্থান করেছে।