তুরস্কের নৌবাহিনী ইসরায়েলের জন্য কতটা হুমকি?


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৩০

ইসরায়েলের হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, তুরস্কের নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী অবস্থান ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঙ্কারা নৌবাহিনীকে কীভাবে শক্তিশালী, আধুনিক ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন একটি বাহিনীতে পরিণত করেছে- সেসব তথ্য এই গবেষণা প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়। হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিটাইম পলিসি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক গবেষণা আরও দাবি করছে যে, তুরস্কের নৌবাহিনী এখন গোটা অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী।

হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্কের নৌবাহিনীর শক্তি ও সক্ষমতা এভাবে বাড়তে থাকলে তা ইসরায়েলের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। ইসরায়েল সরকারকে তুরস্কের এ সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনটি যে কয়েকজন মিলে তৈরি করেন, তার মধ্যে একজন হলেন কর্নেল শোলমো গুয়েটা। তিনি দাবি করেন, আঙ্কারা বর্তমানে এমনভাবে তার নৌবাহিনীকে তৈরি করছে, যাতে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তির সকল বৈশিষ্ট্য এ বাহিনীর থাকে। যে কোনো প্রয়োজনে স্বল্প সময়ের নোটিশে বাহিনীটি দূরপাল্লার অভিযান পরিচালনা করতে পারে।

তুরস্কের নৌবাহিনীর এই উত্থানে ইসরায়েলের শংকিত হওয়ার একটি বড়ো কারণ হলো তুরস্কের সাবমেরিন সক্ষমতা। তুরস্ক বর্তমানে তার সাবমেরিন বহরকে ৬টি উন্নত সাবস এর মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছে যা আগামী দু এক বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। এটি সম্পন্ন হলে তুরস্কের পক্ষ থেকে ১২ থেকে ১৪টি উন্নত ও আধুনিক সাবমেরিন একসাথে অপারেশনে চলে আসবে। সাবমেরিনের এই তাৎপর্যপূর্ন অগ্রগতি তুরস্ককে ইসরায়েলের তুলনায় বাড়তি সুবিধা দেবে। পাশাপাশি, তুরস্ক অনেকগুলো বহুমুখী ফ্রিগেট ও করভেটও নির্মাণ করছে। এই নৌযানগুলোতে আটমাকা মিসাইল সংযুক্ত করা হয়েছে। তুরস্ক গত ফেব্রুয়ারী মাসেই এ মিসাইলগুলোর সফল পরীক্ষাও চালিয়েছে।

আটমাকা হলো খুব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী, দূরপাল্লার ভূমি থেকে ভুমিতে নিক্ষেপন যোগ্য একটি এন্টি শিপ মিসাইল। এ মিসাইলটিকে যেকোনো পেট্রোল বোট, ফ্রিগেট এবং করভেটে খুব সহজেই সংযুক্ত করে নেয়া যায়। তুরস্কের নৌবাহিনীর ইনভেন্টরি শাখা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত হারপুন এন্টি শিপ মিসাইলগুলো ব্যবহার করছে। কিন্তু খুব শীঘ্রই হারপুনের জায়গায় আটমাকা মিসাইলগুলো স্থলাভিষিক্ত হবে।

আটমাকা মিসাইলে তুলনামূলক অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা হয়েছে। তুরস্কের এই মিসাইলগুলো ২শ কিলোমিটার বা ১২৪ মাইলের লম্বা পথও অতিক্রম করতে পারবে। ফলে, প্রতিপক্ষ তুরস্কের এই মিসাইল বাহিনী মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। কারণ ভিজুয়াল রেইঞ্জের অনেক বাইরে থেকে এ মিসাইলগুলো ছোড়া হবে আর মিসাইলটিও বেশ অল্প সময়ে লম্বা পথ অতিক্রম করে টার্গেটে আঘান হানতে পারবে। পাশাপাশি ডাটালিংকের মাধ্যমে আক্রমন, পুনরায় আক্রমন এবং যেকোনো সময় মিশন বাতিল করারও ব্যবস্থা রাখা হবে।

২০০৯ সাল থেকে তুরস্ক তাদের এন্টি শিপ মিসাইলগুলোকে উন্নত করার কাজ শুরু করে। হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে তুরস্কের নৌবাহিনীর স্ট্রাইক ফোর্স এবং হস্তক্ষেপের ক্রমবর্ধমান সক্ষমতার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। আনাদুলু এখন একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রোজেক্টও বাস্তবায়ন করছে। এটি হলো একটি উভচর জাতীয় এ্যাসল্ট শিপ, যা একইসঙ্গে হালকা ওজনের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হিসেবেও কাজ করবে। নতুন এ যুদ্ধজাহাজটি তুরস্ককে অভিনব মানের স্ট্রাইক সক্ষমতা প্রদান করবে। যা তুরস্কের নৌবাহিনী নিকট ভবিষ্যতে কৃষ্ণ সাগর এবং পুর্ব ভূমধ্যসাগরেও প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে।

এর পাশাপাশি, তুরস্ক এখন নিজস্ব প্রযুক্তিতেই অস্ত্র ও মিলিটারি গিয়ারও তৈরি করছে। তাছাড়া তুরস্কের হাতে এখন নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে তৈরি ক্রূজ মিসাইলও রয়েছে যা শতাধিক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। সব মিলিয়ে আঙ্কারা নানা ধরনের ড্রোন ও বিমান নির্মাণের পাশাপাশি এখন নিজস্ব অর্থায়নে ও প্রযুক্তিতে দেশের মাটিতেই নৌসমর যান নির্মাণ করছে। সেই সাথে জার্মান বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে সাবমেরিন এবং অন্যান্য নৌযানও তৈরি করছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্কের নৌবাহিনী এরই মধ্যে একটি গ্রীন-ওয়াটার নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে যারা দেশের উপকূলীয় সীমান্তকে পাড়ি দিয়ে যেকোনো স্থানেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। তুরস্কের নৌবাহিনীর এই উত্থান তার পুরনো সকল প্রতিদ্বন্দীদের জন্যই উদ্বেগের কারন হলেও ইসরায়েলের জন্য এ অগ্রগতি সবচেয়ে বড়ো হুমকি হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। ইসরায়েল যেহেতু এখনো সমুদ্র পথে রফতানির ওপর নির্ভরশীল তাই নৌপথে তুরস্কের এই উন্নতি ইসরায়েলের সামরিক খাতের জন্যই শুধু নয়, বরং অর্থনীতির জন্য বড়ো আকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

তুরস্কের নৌবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা খাতের সাফল্য শুধু এ দেশটিকেই এগিয়ে নিচ্ছেনা একই সাথে দেশটির মি দেশগুলো সুবিধা পাচ্ছে। যা ইসরায়েলসহ তুরস্কের অন্যান্য প্রতিপক্ষের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের কথা বলা যায়। পাকিস্তান তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান এসটিএম এর সাথে মিলে যৌথভাবে ১৭ হাজার টনের একটি ফ্লিট ট্যাংকার নির্মাণ করে এবং পরবর্তীতে ২০১৮ সাৈে পাকিস্তান তুরস্ক থেকে চারটি করভেট যুদ্ধজাহাজ কেনার জন্যেও চুক্তি করে।

তুরস্কের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বহুগুন বেড়েছে। তুরস্ক প্রতিরক্ষা খাতে এতটা শক্তিশালী না হলে কখনোই অন্য একটি দেশকে এত বড়ো অস্ত্রের চালান সরবরাহ করতে পারতোনা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশ তার নৌবাহিনীকে আরো বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী করে তুলতে চাইছে তারা কোনো না কোনোভাবে তুরস্কের সাথে অংশীদারিত্বে যুক্ত হচ্ছে।

তুরস্ক বিগত কয়েক বছরে মালয়েশিয়া, জর্জিয়া, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, কাতার এবং তুর্কমেনিস্তানসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে ১৩০টিরও বেশি যুদ্ধ জাহাজ রফতানি করেছে।

তুরস্কের ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এক্সপোর্টাস এসোসিয়েশন বা এসএসআই এর প্রেসিডেন্ট নাকি পোলাত বলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্প এখন অনেক বেশি সমৃদ্ধ এবং আমরা যেকোনো ধরনের উন্নত প্রযুক্তি ও উচ্চ সক্ষমতা সম্পন্ন অস্ত্র ও সমরযান নির্মাণ করতে পারি।

তুরস্কের নৌবাহিনী সাম্প্রতিককালে যেসব জাহাজ নির্মাণ করেছে তার মধ্যে সারফেইস এবং আন্ডারওয়াটার- সব ধরনের নৌযানই রয়েছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বৈচিত্রতা ইংগিত দিচ্ছে যে তুরস্ক আগামী দিনগুলোতে সব ধরনের আধুনিক ও উন্নত যুদ্ধজাহাজের নকশা প্রনয়ণ, উন্নয়ন ও নির্মাণে সক্ষম।

এই মুহূর্তে তুরস্কের নৌ ও কোস্টগার্ড বাহিনী ৩শরও বেশি জাহাজ নিয়মিত পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ২৩০টি জাহাজ দেশটির সামরিক ও বেসামরিক খাতের শিপইয়ার্ড ইন্ড্রাস্টিতে নির্মিত। এই সব নৌযানের মধ্যে রয়েছে সাবমেরিন, ফ্রিগেট, করভেট, উভচর জাতীয় এ্যাসল্ট শিপ। ১৯৩৭ সালে তুরস্কের জাহাজ নির্মাণ শিল্পখাতটি যাত্রা শুরু করে। বিগত ১শ বছরে এখাত যতটা উন্নয়ন করেছে তারই বহি: প্রকাশ দেখা যাচ্ছে এসব নতুন নৌযান নির্মাণের মধ্য দিয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাঝে বেশ কয়েক বছর তুরস্কের জাহাজ নির্মাণ কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে কোল্ড ওয়ারের সময় আবারও এই কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮০ সালে এসে তুরস্ক এক হাজার টনের সাবমেরিন এবং টিসিজি ফাতিহ নামক ফ্রিগেটসহ আধুনিক যুদ্ধজাহাজের নকশা প্রনয়নের কাজ শুরু করে। এরও পরে দেশটি আনাদুলু, দেসান এবং ইস্তানবুলের শিপইয়ার্ডগুলোতে সাপোর্ট ও ল্যান্ডিং শিপ নির্মাণ করে।

একবিংশ শতকে এসে তুরস্ক তার সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নের কাজ শুরু করে। এক্ষেত্রে নৌবাহিনীকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের হাত ধরেই দেশটিতে ন্যাশনাল শিপ প্রোগ্রাম অবমুক্ত করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় তুরস্ক অনেকগুলো ফ্রিগেট ও করভেটও নির্মাণ করে যাতে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিকস এবং উইপন সিস্টেম সংযোজন করা হয়। পাশাপাশি, দেশের সবগুলো শিপইয়ার্ড থেকে প্রয়োজন অনুসারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পেট্রোল বোটও তৈরি করা হয়।

তুরস্কের রফতানি সক্ষমতার একটি বড়ো অংশ জুড়েই আছে এই পেট্রোলবোটগুলো। ২০১৭ সালে এসে তুরস্কের নৌযান কার্যক্রম নতুন গতি লাভ করে যখন দেশটির ৫টি প্রাইভেট শিপইয়ার্ড সেদেফ, আনাদুলু, সেফিন, সেলাহ এবং ইস্তানবুল একইসাথে তার্কিশ এসোসিয়েটেড ইন্টারন্যাশনাল শিপইয়ার্ড নামক একটি কনসোর্টিয়ামের আওতায় একসাথে কাজ করতে শুরু করে।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাত সংক্রান্ত শিল্পের প্রধান ইসমাইল দেমির বলেন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার মূল নিয়ামক হলো আমাদের নৌবাহিনী। ইতোমধ্যে আক্রমণাত্মক, নজরদারিমূলক, টার্গেট সনাক্তকরণ, সর্তক মিশন, সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার, সারফেইস ওয়ারফেয়ার, জলে ও স্থলে অপারেশন এবং পেট্রোল ডিউটি করার কাজে তুরস্কের নৌবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের নৌযান নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে। তুরস্কের নৌবাহিনী বিশ্বের পরাশক্তির সাথেও প্রতিদ্বন্দি¦তা করার পর্যায়ে চলে আসবে যখন দেশটির প্রথম লাইট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি নিয়মিত অপারেশনে চলে আসবে। তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন চলতি বছরের মধ্যেই এই জাহাজটির নির্মাণকাজ শেষ হবে।