রাফালে বিমান কেনায় দুর্নীতি নিয়ে সংকটে ভারত


  • আহমাদ আব্দুুল্লাহ
  • ১৪ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০৭

ফ্রান্সের কিছু মিডিয়ায় ভারতের রাফালে বিমান ক্রয় নিয়ে বড় আকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দুটো দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্ত্র কেনাবেচায় এ রকম দুর্নীতি হতে পারে, তা অনেকের কাছেই যেন অবিশ্বাস্য। ফরাসি পত্রিকা মিডিয়াপার্ট জানায়, রাফালে বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ড্যাসল্ট এ বিমান নির্মাণের কাজটি পাওয়ার জন্য ভারতীয় একজন মধ্যস্বত্বভোগীকে এক মিলিয়ন ইউরো ঘুষ দিয়েছিল। এ মধ্যস্বত্বভোগীর বিরুদ্ধে এর আগেও অগাস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। মধ্যস্বত্বভোগীদের এ ঘুষ গ্রহণ এবং এর সাথে ভারতীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ নিয়ে ভারত ও ফ্রান্সজুড়ে এরই মধ্যে নানামুখী আলোচনাও শুরু হয়েছে।

ভারত ও ফ্রান্সের সরকারের মধ্যে ২০১৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্সের ড্যাসল্ট কোম্পানি ভারতকে পর্যায়ক্রমে ৩৬টি রাফালে বিমান সরবরাহ করবে। ৫৯ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি সমমূল্যের বিশাল এ সামরিক চুক্তিকে নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে এরই মাঝে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি এ চুক্তির বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ তদন্ত দাবি করেছে। তবে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের বিমান বাহিনীর জন্য রাফালে বিমানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দুর্নীতির অভিযোগের কারণে রাফালে বিমানের আমদানির প্রক্রিয়া যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

ফ্রান্সের নিউজ পোর্টাল মিডিয়াপার্ট জানায় ফ্রান্সের দুর্নীতি বিরোধী এজেন্সী এজেন্স ফ্রানসাইস এন্টিকোরাপশন, এএফএ, ডাসল্টে অডিট করতে গিয়ে বেশ কিছু অসংগতি খুঁজে পেয়েছে। ভারতীয় এই মধ্যস্বত্বভোগী এরই মধ্যে অগাস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার ক্রয়ের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। দাসলত দাবি করছে যে তারা অন্যায্যভাবে এই অর্থটি দিয়েছে ৫০টি বড়ো আকৃতির রেপ্লিকা মডেল নির্মাণের জন্য। যদিও ফরাসী তদন্তকারীরা তাদের তদন্তে এরকম কোনো মডেল খুঁজে পাননি। ফলে, এই অর্থ কী কারণে দেয়া হয়েছে তা পরিস্কার নয়।

এ খবরটি প্রকাশিত হওয়ার ভারতের অভ্যন্তরের রাজনীতির ময়দান নতুন করে সরব হয়ে উঠে। কংগ্রেস ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলও রাফালে চুক্তি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করার আহবান জানায়। কংগ্রেরস মুখপাত্র রানদিপ সুরজেওয়ালা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো প্রতিরক্ষা চুক্তিকে কেন্দ্র করে কত বেশি ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্য হয়েছে তা বের করা প্রয়োজন। কারা কারা এ ঘুষের শেয়ার পেয়েছেন এবং এ দুর্নীতিতে সরকারের কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন তা বের করাও সময়ের দাবি।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও উত্থাপিত অভিযোগ নিরসনে উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়েছে। দলটি বলছে ফরাসী মিডিয়ায় এক মিলিয়ন ইউরো ঘুষ দেয়ার এ খবরটি প্রকাশিত হওয়ায় রাফালে চুক্তি নিয়ে আগের দুনীতির অভিযোগগুলো নতুন করে সত্যতা পেলো। কিন্তু বারবার নানা মহল থেকে অভিযোগ আসার পরও মোদি সরকার বিষয়টি নিয়ে খোলাসা করছেনা, কোনো তদন্তও করছেনা। এতে বোঝা যাচ্ছে, সরকার পরিকলিপ্তভাবে কোনো অন্যায়কে আড়াল করতে চাইছে।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপি অবশ্য ফরাসি গনমাধ্যমের এ খবরটিকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছে। বিজেপির মুখপাত্র এবং দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাভি শংকর প্রসাদ বলছেন, ফ্রান্সে কর্পোরেট লেভেলে যে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দিতা হয় তার অংশ হিসেবেই ড্যাসল্টের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তোলা হয়েছে। এসব এ অভিযোগের কোনো সত্যতাই নেই। রাফালে চুক্তি নিয়ে এবারই প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ উঠলো তা নয়।

কংগ্রেস এর আগেও অভিযোগ তুলেছিল যে, ২০১৪ সালে দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে ফ্রান্সের সাথে এ বিমানগুলো ক্রয়ের জন্য যে চুক্তি করেছিল তার চেয়ে প্রায় তিনগুন দামে মোদি এবার চুক্তি করেছেন। মোদি সরকারের সাথে ড্যাসল্টের এ চুক্তি হয় ২০১৬ সালে। এরপর ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনেও রাফালে চুক্তির দুর্নীতি বিরাট ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। রাফালে জেট ক্রয়ে দুর্নীতি সম্বন্ধে জানার জন্য সুপ্রীম কোর্টে অনেকগুলো পিটিশনও দাখিল করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে সুপ্রীম কোর্ট সবগুলো পিটিশনই খারিজ করে দেয়। সুপ্রীম কোর্টের এ সিদ্ধান্তের পর মোদি সরকার মোটামুটি দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে একটি সার্টিফিকেট পেয়ে যায়।

ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক সামির পাটিল তুরস্কের আনাদুলু এজেন্সীকে বলেন, চলমান অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ রাফালে বিমান সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। এর আগে যখন অভিযোগ উঠেছিল, তখন বেশ লম্বা সময়ের জন্য ভারতীয় প্রতিরক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সামির পাটিল আশা করেন এবার আর তা হবে না। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের মোট ৩৬টি রাফালে পাওয়ার কথা যার মধ্যে এ পর্যন্ত ১৪টি রাফালে ভারতের মাটিতে এসে অবতরণ করেছে।

আন্তর্জাতিক পরিসরে অস্ত্র কেনা বেচা নিয়ে কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতি বিষয়ক অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। বলা হয়, সব ধরনের বাণিজ্যের মধ্যে অস্ত্র বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। অস্ত্র বাণিজ্যে প্রচুর পরিমান অর্থ লেনদেন হয় আর এর ৪০ শতাংশই খরচ হয় দুর্নীতিজনিত সিস্টেম লসের কারণে। ফ্রান্সের ড্যাসল্ট বা পশ্চিমা কোম্পানি ভারতের কাউকে অবৈধ এ অর্থ প্রদান করেছে বিষয়টা তেমনও নয়। এশিয়া বা আফ্রিকার অন্য কোনো দেশের সাথে অস্ত্র বাণিজ্য বা অস্ত্র চুক্তির ক্ষেত্রেও একই ধরনের জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা অহরহই ঘটছে। অস্ত্র বাণিজ্যে দুর্নীতি এখন অনেকটা বিশ্বজনীন রূপ লাভ করেছে।

শুধু ভারত নয়, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, গ্রীস, ইসরাইল, পর্তুগাল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোর অস্ত্র কেনাবেচায়ও ঘুষের খবর পাওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাট লিওনার্ড স্ক্যান্ডালের কথাও বলা যায়। এ দুর্নীতিতে পোর্ট সার্ভিসের ঠিকাদার, মার্কিন নৌ বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলো।

অনুসন্ধানে আরো বের হয় যে, এই চুক্তির সাথে জড়িত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের গ্লেন ডিফেন্স মেরিন এশিয়া লিমিটেড মার্কিন ৭ম নৌ বহরের সবাইকে খাবার থেকে শুনু করে টাগবোট সার্ভিস পর্যন্ত সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি বহরের তালিকাভুক্ত সামরিক ও বেসামরিক প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদান করেছে। যাতে বহরের আওতাধীন নৌযানগুলোর গতিবিধি সম্পর্কে আগাম খবর জানিয়ে দেয়া হয়। গ্লেন ডিফেন্স মেরিনের হার্বারে মার্কিন জাহাজটি নোঙ্গর করা হয়। কারণ মার্কিন একটি জাহাজ নোঙ্গর করাতে পারলেই প্রতিষ্ঠানটির বড়ো অংকের মুনাফাও নিশ্চিত হয়।

অনেক সময় একটি কোম্পানি তার প্রতিপক্ষ কোম্পানির ব্যবসায়িক পলিসি জানার জন্যেও ঘুষ দিয়ে থাকে। অস্ত্র চুক্তিতে দুটি কারনে দুর্নীতি হয়। প্রথমত অস্ত্র চুক্তি বা কেনাবেচার সাথে দেশের নিরাপত্তা স্বার্থ জড়িত হওয়ায় অনেক সময় দুর্নীতির বিষয়টিকে দেখেও না দেখার ভান করা হয়। এ কারণেই দুর্নীতিবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ছাড় পেয়ে যাওয়ার আশা করে। এছাড়া প্রতিটি দেশের ক্ষমতায় যেহেতু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই থাকেন, তারা দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক রং দিয়ে নিজেরা যেমন বাঁচার চেষ্টা করেন তেমনি দুর্নীতিবাজদেরও আড়াল করেন। এ কারণে অস্ত্র ক্রয় বিক্রয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই শোনা গেলেও এর সাথে জড়িতদের শাস্তির নজির খুবই কম।

যে দেশ অস্ত্র কিনছে বা বিক্রি করছে, উভয়েই নিজ নিজ স্বার্থে দুর্নীতিকে প্রশয় দেয়। যারা অস্ত্র রফতানি করে তারা চায় তাদের দেশের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রসার হোক। তাদের নির্মিত অস্ত্রগুলো গ্রহণযোগ্যতা পাক। বিভিন্ন দেশ রাষ্ট্রীয় ভাবে দুর্নীতি প্রশয় দেয়। কারন এসব প্রতিষ্টানে বহু লোকের যেমন কর্মসংস্থান হয় তেমনি বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।

এ ধরনের দুর্নীতির একটি উদাহরণ হলো ২০০৬ সালে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেলয়ারের একটি সিদ্ধান্ত। সে সময়ে সৌদি আরবের কাছে ব্রিটেনের বিএই সিস্টেমের অস্ত্র বিক্রয় নিয়ে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ব্লেয়ার কাউকে কিছু না বলেই নির্বাহী ক্ষমতাবলে তদন্ত কার্যক্রম বাতিল করে দেয়। মূলত বিএই সিস্টেম যাতে নির্বিঘ্নে সৌদি আরবসহ অন্য সকল দেশে অস্ত্র বিক্রি করতে পারে তা নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নেন।

অন্যদিকে, ক্রেতা দেশগুলো জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোতে এক ধরনের সুযোগসন্ধানী ঠিকাদার ডিলার, কর্মকর্তার জন্ম হয়। যারা বিদেশী সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে এই দুর্নীতি করে থাকে। এক্ষেত্রে ক্রেতা দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কুটনৈতিক কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনীর একটি স্বার্থান্বেষী মহলও তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। অস্ত্র ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ভায়া মিডিয়া কৌশল বন্ধ না হলে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্যের দুর্নীতি বন্ধ হয়তো দূরাশাই থেকে যাবে।