ইতালির সামরিক শক্তি


  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১২:৫৬

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে ইতালির অবস্থান ১২তম। সামরিক শিল্পের দিক দিয়ে ইতালি বিশ্বে একটি শক্তিশালী দেশ। বিশ্বে শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানির তালিকায় ইতালির অবস্থান দশম। ইতালিতে রয়েছে বিশ্বখ্যাত কয়েকটি সমরাস্ত্র নির্মাণ শিল্প। ইতালি তার প্রয়োজনীয় প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র নিজেই উৎপাদনে সক্ষম।

বিমানবাহী রণতরী, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার থেকে শুরু করে ব্যালিস্টিক মিসাইল, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক সবই তৈরি করে ইতালি। ইতালি যৌথভাবে তৈরি করেছে ইউরোফাইটার টাইফুনের মতো ফোর্থ জেনারেশন শক্তিশালী ফাইটার জেট। ইতালির রয়েছে নিজস্ব তৈরি শক্তিশালী এটাক হেলিকপ্টার। ইতালিতে রয়েছে লিওনার্দো, ফিনকান্টিয়ারির মতো সমরাস্ত্র নির্মাণ শিল্প।

ইতালি পরমাণু শক্তিধর দেশ না হলেও তার কাছে মজুদ রয়েছে এ বোমা। দেশটিতে ২০টির অধিক পারমাণবিক বোমার মজুদ রয়েছে। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা। ন্যাটো নিউক্লিয়ার শেয়ার পলিসি অনুযায়ী ইতালিতে এসব বোমা মজুদ রয়েছে।

অন্য কারো দ্বারা পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হলে ইতালি এসব বোমা ব্যবহার করতে পারবে। পারমাণবিক বোমা না বানিয়েও পারমাণবিক বোমা মজুদ রয়েছে অপর যেসব দেশে সেগুলো হলো জার্মানি, তুরস্ক, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস। এসব প্রতিটি দেশে কমপক্ষে ২০টি করে বোমা মজুদ রয়েছে। সব দেশের এসব পারমানিবক বোমা যুক্তরাষ্ট্রের।

ইতালির লক্ষ্য ছিল ১৯৬০ এর দশকের শেষে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়া। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইতালির এ কর্মসূচী নিষিদ্ধ করা হয়।

ইতালি ১৯৭৩ সালে উদ্ভাবন করে আলফা ব্যালিস্টিক মিসাইল। এর পাল্লা ৮ হাজার কিলোমিটার। এটি পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম। ইতালি ১৯৭৩ সালে উদ্ভাবন করে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র এসপাইড। এটি এয়ার টু এয়ার এবং এয়ার টু সারফেস মিসাইল। এর গতি ম্যাক ৩ দশমিক ৭।
এ ছাড়া ইতালির কাছে রয়েছে এন্টি শিপ মিসাইল সি কিলার।

ইতালির কাছে ৯০টি ফোর্থ জেনারেশন ইউরো ফাইটার টাইফুন যুদ্ধ বিমান রয়েছে। এটি বর্তমানে বিশ্বের মোস্ট এডভান্সড ১০টি ফাইটার জেটের অন্তর্ভুক্ত। ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি বহুমুখী যুদ্ধ বিমান। ইউরো ফাইটার টাইফুন এর যৌথ নির্মাতা ইউরোপের এয়ারবাস, বৃটেনের বিএই সিস্টেম এবং ইতালির লিওনার্দো। টাইফুন সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৩ সালে। এটি একটি এয়ার সুপেরিয়রিটি বিমান। ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। এখন পর্যন্ত ৫৭১টি এ বিমান নির্মাণ করা হয়ছে।

ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি সুপারসনিক ফাইটার জেট। সর্বোচ্চ গতি শব্দের চেয়ে দ্বিগুন বা ম্যাক ২। এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফে এবং এন্টি-শিপ মিসাইল ছুড়তে সক্ষম এ বিমান। মিসাইল ছাড়াও প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী বোমা বহনের ব্যবস্থা রয়েছে এতে। এর রয়েছে শক্তিশালী রিভলভার ক্যানন।

বৃটেন, জার্মানি, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমানসহ ৯টি দেশের কাছে রয়েছে এ বিমান।
ইতালির বিমান বাহিনী এবং নেভির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-৩৫ রয়েছে ১১টি।

ইতালির কাছে পানাভিয়া টরনাডো বহুমুখী যুদ্ধ বিমান রয়েছে ৫৩টি। এ বিমান ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি যৌথভাবে নির্মাণ করছে। ইতালির এ এম এক্স ইন্টারন্যাশনাল বিমান রয়েছে ৩৩টি। এটি ইতালি এবং ব্রাজিল যৌথভাবে নির্মাণ করেছে।

ইতালির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শক্তিশালী এয়ারবর্ণ আর্লি ওয়ানির্ং এন্ড কন্ট্রোল, রিকনিস্যান্স, এরিয়েল ফুয়েল ট্যাঙ্কার, সামরিক পরিবহন বিমান এবং ফ্রান্সের তৈরি সমুদ্র টহল বিমান রয়েছে।

ইতালির সমস্ত শক্তিশালী হেলিকপ্টার তাদের নিজেদের তৈরি। এগুলো হলো অগাস্টা বেল, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড, এ১২৯ মানগস্টা এবং এমডি ৫০০ ডিফেন্ডার।

ইতালির কাছে দুই ধরনের এটাক সাবমেরিন রয়েছে। টোডারো ক্লাস সাবমেরিন জার্মানির তৈরি। আর সরো ক্লাস সাবমেরিন ইতালির তৈরি। সরো ক্লাস সাবমেরিন তৈরি করেছে ইতালির বিখ্যাত জাহাজ নির্মাণ শিল্প ফিনকান্টিয়ারি এসপিএ। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ইউরোপে ইতালির অবস্থান শীর্ষে।
ইতালির দুটি ক্লাস সাবমেরিনই ডিজেল ইলেকট্রিক চালিত।

ইতালির বিমানবাহী রণতরী সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে ২০০৯ সালে। এটি নির্মাণ করেছে ফিনকান্টিয়ারি এসপিএ। ইতালির প্রথম বিমানবাহী রণরতী জিসাপি গারুবালদি। এটি নেভিতে যুক্ত হয় ১৯৮৫ সালে। এটিও নির্মাণ করেছে ইতালির ফিনকান্টিয়ারি।

ইতালির কাছে রয়েছে সান গ্লরগিও ক্লাসের ৪টি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ। এটি ল্যান্ডিং ডক বা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার নামেও পরিচিত। এ ডক হেলিকপ্টার, সাজোয়া যান, ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং সৈন্য বহন করতে পারে। এর নির্মাতা ইতালির ফিনকান্টিয়ারি।

ইতালির কাছে রয়েছে নিজস্ব তৈরি দুই ধরনের এয়ার ডিফেন্স ডেস্ট্রয়ার। এর একটি হলো হরাইজন ক্লাস। এর চারটি ড্রেস্ট্রয়ার রয়েছে। এটি নির্মাণ করেছে ফিনকান্টিয়ারি ও লিওনার্দো। অপর ২টি এয়ার ডিফেন্স ডেস্ট্রয়ার হলো ডুরান্ড ডি লা পেনি ক্লাস। এর নির্মাতা ফিনকান্টিয়ারি এবং রিভা ট্রিগোসো।

ইতালিয়ান সশস্ত্র বাহিনী আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্স নিয়ে গঠিত। ইতালির সৈন্য সংখ্যা ৩ লাখ ৭১ হাজার। সক্রিয় সৈন্য ১ লাখ ৭৫ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ২০ হাজার। প্যারামিলিটারি ১ লাখ ৭৬ হাজার।

ইতালির ট্যাঙ্ক সংখ্যা ২০০। সাজোয়া যান ৮ হাজার ৫শ। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৫৪টি। টাউড আর্টিলারি ১০৮টি। রকেট প্রজেক্টর ২১টি। ইতালির মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক আরিয়াতে থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সাজোয়া যান, ট্যাঙ্ক ডেস্ট্রয়ার, ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভিহিক্যাল, আরমারড পারসোনাল ক্যারিয়ার, মর্টার ক্যারিয়ার, অন্যান্য ক্ষুদ্রাস্ত প্রায় সবই ইতালির নিজস্ব তৈরি।

ইতালির মোট বিমানের সংখ্যা ৮৭৬টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ১৮৬টি। পরিবহন বিমান আছে ৩৯টি। প্রশিক্ষন বিমান ১৮৮টি। স্পেশাল মিশন আছে ২৭টি। ট্যাঙ্কার ফ্লিট ১০টি। হেলিকপ্টার ৪১০টি। এটাক হেলিকপ্টার রয়েছে ৫৯টি।

ইতালির মোট রণতরীর সংখ্যা ২৪৯টি। বিমানবাহী রণতরী ২টি। ডেস্ট্রয়ার ৪টি। ফ্রিগেটস ১২টি। সাবমেরিন ৮টি। টহল জাহাজ ১৬টি। মাইন ওয়ারফেয়ার ১০টি।

ইতালির লিওনার্দো-ফিনমেকানিকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এটি একটি এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি, ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি এবং স্পেস ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত লিওনার্দোতে বর্তমানে ৫০ হাজারের বেশি জনবল রয়েছে। ২০১৮ সালে এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান রেভিনিউ আয়ের দিক দিয়ে। সারা বিশ্বে এর ১৮০টি কারখানা রয়েছে।

এরোনটিক্স, বিমান, হেলিকপ্টার, ইলেকট্রনিক্স, ডিফেন্স সিস্টেম, রিমোর্ট কন্ট্রোল উইপন স্টেশনস, টারেট, অটো ক্যাননস, রোটারি ক্যানস, নেভল আর্টিলারি, মিসাইল, টরপোডো, আনম্যান্ড গ্রাউন্ড ভিহিক্যাল, আনম্যান্ড আন্ডার ওয়াটার প্রভৃতি তৈরি করে লিওনার্দো-ফিনমেকানিকা।

ফিনকান্টিয়ারি ইতালিরর ৬২ বছরের পুরনো একটি বিশ্বখ্যাত জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ২০১৪ সালে এটি ছিল বিশ্বের চতুর্থ জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ইতালির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রণতরী নির্মাণ করছে ফিনকান্টিয়ারি।

বিশ্বে শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানিকার দেশের তালিকায় ইতালির অবস্থান দশম। স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট এর তথ্য অনুসারে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে যত অস্ত্র রপ্তানি হয়েছে তার ২ দশমিক ২ ভাগ বিক্রি করেছে ইতালি। ইতালির সমরাস্ত্রের প্রধান ক্রেতা তুরস্ক, মিশর এবং পাকিস্তান।

বিশ্ব ইতিহাসে ইতালি, রোম, রোমান সাম্রাজ্য খুবই পরিচিত কয়েকটি নাম। রোম শহরের সূচনা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে। সে হিসেবে এ শহরের বয়স ২ হাজার ৭০০ বছরের বেশি। মানবেতিহাসে আলোচিত একটি সাম্রাজ্য রোমান সাম্রাজ্য।

বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইতালি একটি আলোচিত দেশ ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে। জার্মান নেতা এডলফ হিটলার পর্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন বেনিতো মুসোলিনি দ্বারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ অবধি ইতালি বিশ্ব রাজনীতিতে একটি প্রায় নীরব দেশে পরিণত হয়েছে।