ভারতীয় বিমানবাহিনীতে নজিরবিহীন সংকট


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৪ এপ্রিল ২০২১, ১২:৩৩

ফ্রান্সের ডাসল্ট কোম্পানি থেকে রাফালে বিমানের জন্য ভারত চুক্তি করেছে ৬ বছর আগে। বিমানগুলো একে একে ভারতে এসে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু উন্নত রাফালে বিমান কিংবা সর্বশেষ প্রযুক্তির সব হেলিকপ্টার পাওয়ার পরও ভারতীয় বিমানবাহিনীতে নানা ধরনের সংকটের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমস একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশটিতে প্রশিক্ষিত পাইলটের বিশাল শূন্যতা দেখা দিয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে বিমান কিনে আনলেও সেই বিমানগুলো চালানোর মতো লোক পাওয়া যাচ্ছে না।

কিছুদিনের মধ্যে ভারতের হাতে আরো ৯টি রাফালে বিমান এসে পৌঁছাবে। এই চালানের বিমানগুলো উত্তরাঞ্চলীয় পাঞ্জাব শহরের আমবালা বিমানঘাঁটিতে এসে অবতরণ করবে। আমবালা ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিমানঘাঁটি। এই ঘাঁটির অবস্থানটি ভারত-চীন সীমান্তের বেশ কাছে। আমবালাকে ঘিরে ভারতের এ প্রস্তুতিকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

ডাসল্টের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় বাহিনী মোট ৩৬টি রাফালে বিমান গ্রহণ করবে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্যারিস সফরে গিয়ে এই চুক্তিটি করেন। পরবর্তীতে মে মাসে নর্থ বেঙ্গলের হাসিমারা বিমানঘাঁটিতে আরো ৫টি রাফালে বিমান এসে অবতরন করবে। এ বিমানঘাটিটাও ভারত-চীন সীমান্তের উত্তরে অবস্থিত। ইতোমধ্যেই এ বিমান ঘাঁটিতে মিগ-টোয়েন্টি সেভেনের বেশ কিছু বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। যেগুলো গত বছর থেকে নিয়মিত আকাশপথে টহল দিতেও শুরু করেছে।

কিন্তু এত সব কিছুর পরও ভারতীয় বাহিনীর ভেতরকার অবস্থা খুবই নাজুক। হিন্দুস্তান টাইমসের তথ্যমতেই দেশটির বিমানবাহিনীতে এখন কমপক্ষে ৪০৫ জন পাইলটের ঘাটতি রয়েছে। পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি পার্লামেন্টকে অবহিতও করা হয়েছে। ভারতের জুনিয়র প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীপদ নায়েক পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে একটি ভাষণে জানান, ভারতীয় বিমানবাহিনীতে এই মুহুর্তে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ন্যূনতম ৪২৩৯ জন পাইলটের প্রয়োজন থাকলেও দেশটির হাতে মাত্র ৩ হাজার ৮শ জন পাইলট রয়েছে।

শুধু পাইলটেরই ঘাটতি নয়, জানা গেছে, বিমানবাহিনীতে বিমানেরও সংকট রয়েছে। বর্তমানে যেসব বিমান সচল রয়েছে সেগুলো বেশ পুরনো হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে এগুলোর বেশিরভাগ বিমান বাতিল ঘোষণা করার প্রস্তুতি চলছে। এ বিমানগুলোর মেয়াদও বেশ আগেই শেষ হয়ে গেছে। সার্বিকভাবে ভারতের বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন শক্তিও বেশ কমে গেছে। দেশটির বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন শক্তি হওয়ার কথা ছিল ৪২ অথচ সেখানে এই শক্তির মাত্রা এখন মাত্রা ৩০ এ অবস্থান করছে।

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সর্বশেষ অবস্থানটি ইংগিত দিচ্ছে দেশটির বিমানবাহিনীতে আগামীতেও যুদ্ধবিমান চালানোর মতো পাইলটের তীব্র অভাব থাকবে। বিগত ৫ বছরে দেশটির বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাইলট অবসরে চলে যাওয়ায় এ সংকট এতটা ঘনীভূত হয়েছে।

গত বছর একটি নিউজ আউটলেট রাইটস টু ইনফরমেশন এ্যাক্টের আওতায় দেশটির বিমানবাহিনীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে চায়। সেই আবেদনের জবাবে মন্ত্রনালয় জানায়, গত ৫ বছরে বিমানবাহিনীর ৭৯৮ জন পাইলট অবসরে চলে গেছেন। যার মাধ্যমে ২৮৯ জন আবার প্রাইভেট বিমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেটও লাভ করেছেন। মন্ত্রনালয় আরো জানায় শুধু ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেই দেশটির বিমানবাহিনী থেকে যথাক্রমে ১শ জন এবং ১১৪ জন পাইলট অবসর গ্রহণ করেছিল। গড়ে প্রতি বছর ৮০ জন পাইলট বিমানবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে ভারতীয় বিমানবাহিনী তার স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।

যুদ্ধবিমানের বিপরীতে পাইলটের সংখ্যার অনুপাত আশংকাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ভারতের তুলনায় দেশটির দুই প্রতিদ্বন্দী চীন ও পাকিস্তানে বিমান ও পাইলটের অনুপাত ভালো অবস্থায় রয়েছে। প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজের পরিমাণ বেশ কম কিন্তু সেই অনুযায়ী বেতন খুব বেশি। ফলে অনেক পাইলট ভারতীয় বিমানবাহিনী ছেড়ে প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগ দিচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরে যে কয়জন পাইলট পদত্যাগ করেছেন বা অবসরে গিয়েছেন, তাদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি প্রাইভেট এয়ারলাইন্সে কাজ করার ছাড়পত্র পেয়েছেন।

অবশ্য পাইলটদের স্বেচ্ছা অবসর ও বিমানবাহিনী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা কমিয়ে আনতে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। কুলিং-অফ পিরিয়ড এবং অবসরকালীন ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি প্রদানের ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পাইলটদের এভাবে বেরিয়ে যাওয়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য অশনি সংকেত। কেননা এই ধরনের পাইলট তৈরি করার জন্য বাহিনী বড়ো অংকের অর্থ ব্যয় করে। পাইলটদের প্রশিক্ষন এবং তাদেরকে সর্বাধুনিক বিমানের সাথে পরিচিত করানোর জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর তারা যখন চলে যায় তখন গোটা বাহিনীর অপারেশনাল দক্ষতাই ঝুঁিকর মুখে পড়ে ।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর আরো কিছু সংকটও রয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী সামরিক সরঞ্জামের দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ একটি বাহিনী। কিন্তু এর অপারেশনাল সক্ষমতা বিগত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত নীচের দিকে নামছে।

২০০২ সালে এর স্কোয়াড্রন শক্তি বেশ ভালো মানে থাকলেও ২০২১ সালে এসে এই শক্তির মাত্রা মাত্র ৩০ এসে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাফালের দুটো স্কোয়াড্রন যুক্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে বিমানবাহিনীর মূল যে ঘাটতি তা খুব একটা পূরণ হয়নি। ভারতের অর্থনীতি বেশ অনেকদিন ধরেই অস্থিতিশীল। এ কারণে বিমানবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন সমরাস্ত্র, পাইলটদের প্রশিক্ষন ও সুযোগ সুবিধা প্রত্যাশা অনুযায়ী দেয়া যাচ্ছে না। বাহিনীর আধুনিকায়ন কার্যক্রমও অনেকটাই থমকে আছে।

দেশটির বিমানবাহিনী ধারণা করছে, ২০২৪ সালের মধ্যেই হাতে থাকা মিগ-টোয়েন্টি ওয়ানের সবগুলো স্কোয়াড্রন অবসরে চলে যাবে। এর বিপরীতে কয়েকটি স্কোয়াড্রন যুক্ত হলেও সার্বিকভাবে বাহিনীর শক্তি আগের মানে যাওয়া বেশ কঠিনই হবে।

বিমানবাহিনীর বহরে রাফালের ৩৬টি যুদ্ধবিমান যুক্ত হওয়ার পর ভারত বেশ বড়ো আকারের অর্জন বলে প্রচার করছে। বিশ্লেষকরা এর সাথে পুরোপুরি একমত হতে নারাজ। তাদের মতে চীনের ওয়েস্টার্ন কমান্ড যারা ভারতের সাথে কোনো যুদ্ধ শুরু হলে সবার আগে সম্পৃক্ত হবে। শুধু তাদের হাতেই ২শরও বেশি আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান রয়েছে। চীনের একেকটি কমান্ডের কাছে যতগুলো স্কোয়াড্রন আছে, তা ভারতের জন্য বড়ো আকারের হুমকি ও উদ্বেগের কারণ।

ভারতের আরেক প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের হাতে এই মুহুর্তে আছে ৩৫০টি যুদ্ধবিমান যা ভারতের জন্য বড়ো আকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশপথে চীন ও পাকিস্তানের এ সক্ষমতাকে ভারত চাইলেও অগ্রাহ্য করতে পারবে না। পাশাপাশি, চীন ও পাকিস্তান উভয় দেশই বেশ অনেকগুলো এয়ারবর্ন ট্যাংকার্স এবং নজরদারি বিমান সচল রেখেছে। ভারত এক্ষেত্রেও অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। এ ধরনের বিমান যুদ্ধক্ষেত্রে যে দেশের হাতে যত বেশি থাকবে সেই দেশের বিমানবাহিনী তত বেশি সফলতা অর্জন করতে পারবে।

ভারত বিগত দুই যুগে বিমানবাহিনীর দিকে খুব একটি নজর দেয়নি। ভারতের সামরিক বাহিনীর উন্নয়ন প্রকল্পের অধিকাংশই ছিলো সেনাবাহিনীকে ঘিরে। ফলে বিমানবাহিনীর নানা সংকট সমাধানে মনোযোগ দেয়া হয়নি। বিমানবাহিনীর কাজের দক্ষতাও তাই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।

দেশটির প্রতিরক্ষা কৌশলের ফ্রন্টলাইনে আগাগোড়াই সেনাবাহিনী থাকায় বিমানবাহিনী নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তাছাড়া বিমানবাহিনীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা সিংগেল ইঞ্জিনের বিমানগুলোকে ডবল ইঞ্জিনে রূপান্তর করার জন্য ২০০৫ সাল থেকেই নিরবিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল হওয়ায় বিনিয়োগের বিপরীতে সফলতার মাত্রা তুলনামূলক কম। ভারতের বিমানবাহিনী এখনও প্রথাগত যুদ্ধবিমানের ওপর আস্থা বেশি রেখেছে। যেখানে নিকট অতীতে অনেক দেশই মনুষ্যবিহীন ড্রোন ও হাইপারসনিকসহ নানা ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছে। বর্তমান সময়ে এসে রণকৌশল অনেকটাই পাল্টে গেছে। নানা দেশ বরং ভূমিতে বিনিয়োগ কমিয়ে আকাশভিত্তিক সমরাস্ত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। একারণে ভারতীয় নীতি নির্ধারকদেরকেও আকাশপথের সক্ষমতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন কৌশল প্রণয়ণ করা প্রয়োজন বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন। কিন্তু ভারতের সে প্রস্তুতি কতটুকু আছে সেটি বড় প্রশ্ন।