বাইডেন কি ইউক্রেনে পরাজয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন - সংগৃহীত

  • মুনতাসীর মুনীর
  • ১৫ মে ২০২৩, ১৭:৫৭

রাশিয়ার দখল থেকে নিজেদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারে বসন্তকালীন অভিযান শুরু করেছে ইউক্রেন। কিন্তু এ যুদ্ধে কিয়েভ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে তার প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা কী হবে, তা নিয়ে এরইমধ্যে দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে বাইডেন প্রশাসনের অভ্যন্তরে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সেনা নেতৃত্ব সংশয়ে রয়েছে- আসলে ইউক্রেন কতটা সফল হতে পারবে। খোদ জেনারেল মার্কি মিলি নিজে শঙ্কার কথা বলেছেন।

ইউক্রেনের বসন্তকালীন পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হলে দেশে ও দেশের বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে বাইডেন প্রশাসনকে। এজন্য নীরবে প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছে হোয়াইট হাউস। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন প্রকাশ্যে ইউক্রেনকে অবিচলভাবে যতদিন প্রয়োজন ততদিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু আসন্ন অভিযানে ইউক্রেন যদি বেশি সাফল্য অর্জন করতে না পারে, তাহলে দুই দিক থেকে সমালোচনার তির ছুটে আসার বিষয়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরে এরইমধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ সমালোচনাকারীদের একপক্ষ বলবে, ওয়াশিংটন যদি কিয়েভের চাহিদামতো সব অস্ত্র বিশেষ করে দীর্ঘপাল্লার মিসাইল, যুদ্ধবিমান ও আরও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করত, তাহলে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ সফল হতো।

অন্যদিকে ইউক্রেন সামনের অভিযানে ব্যর্থ হলে অপর পক্ষ দাবি করবে, রাশিয়াকে নিজেদের অঞ্চল থেকে পুরোপুরি দূর করার সক্ষমতা ইউক্রেনের নেই। এ দুই পক্ষ বাদেও মাথাব্যথার কারণ রয়েছে বাইডেন প্রশাসনের। মার্কিন মিত্ররা ইউক্রেনের ব্যর্থতায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তাও ভাববার বিষয় হোয়াইট হাউসের জন্য। বিশেষত ইউরোপীয় মিত্ররা হয়তো রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনাকেই এ যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করবে।

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা অবশ্য জোর দিয়ে বলছেন, আসন্ন যুদ্ধে ইউক্রেনের সফলতার জন্য তারা সম্ভাব্য সবকিছু করছেন। হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাল্টা আক্রমণের জন্য ইউক্রেন যা যা চেয়েছে, তার প্রায় সবকিছুই তারা পাঠিয়েছেন। কিন্তু এরপরও ইউক্রেন কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কপালে।

কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ক ফাঁস হওয়া কিছু গোপন নথিতেও বলা হয়েছে, ইউক্রেনের বসন্তকালীন অভিযান কিয়েভের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হতে পারে। এছাড়া সম্প্রতি মার্কিন মূল্যায়নেও বলা হয়েছে, বসন্তকালীন পাল্টা আক্রমণে ইউক্রেন দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে কিছুটা সাফল্যের দেখা পেলেও গত বছরের মতো সফলভাবে রাশিয়াকে পরাভূত করতে পারবে না।
ইউক্রেন রাশিয়ার ক্রিমিয়ামুখী ব্রিজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু মার্কিন মূল্যায়নে এর সাফল্য নিয়ে সন্দেহ করা হয়েছে। তবে পেন্টাগন আশা করছে, ফ্রন্টলাইনে দুর্গ বানিয়ে আস্তানা গাড়া রুশ সেনাদের ওপর সম্পূর্ণ বিজয় লাভ করতে না পারলেও ইউক্রেন রাশিয়ার সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে।

মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যও ইঙ্গিত করছে, রুশ সেনাদের শক্ত অবস্থান থেকে সরানোর সক্ষমতা নেই ইউক্রেনের। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার বাহিনীকে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র এখনও দেয়নি, তাই তার আগ পর্যন্ত কোনো পাল্টাআক্রমণ শুরু করা সম্ভব নয়।

মার্কিন কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, কিয়েভ এর ভবিষ্যৎ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রাকে আগের চেয়ে ছোট করতে চাইছে যাতে তা অর্জনের মাধ্যমে সেটাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে অভিহিত করা যায়।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সর্বাধিনায়ক জেনারেল মার্ক মিলি ইউক্রেনের আলোচিত কাউন্টার অফেনসিভ অ্যাটাক নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জেনারেল মার্ক মিলি বলেছেন, সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হতে পারে ইউক্রেনের কাউন্টার অফেনসিভ অ্যাটাক। যদিও এই সাক্ষাতকারে তিনি স্বীকার করেছেন ইউক্রেনের কাউন্টার অফেনসিভ অ্যাটাকের জন্য ইউক্রেন আর্মিকে যাবতীয় প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা এবং অস্ত্র সবই সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা।

ইউক্রেনকে সাহায্য দেওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে মতবিরোধ আছে তা আর গোপন কোনো বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান মিখাইল ম্যাককল বলেছেন, কাউন্টার অফেনসিভ অ্যাটাকে সফলতা ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করছে ইউক্রেনকে পরবর্তী সহায়তার বিষয়। এ অভিযানে ইউক্রেন যদি সাফল্য লাভ করলে পরবর্তী সহায়তা লাভের ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা অর্জন করবে ইউক্রেন। আর যদি তারা ব্যর্থ হয় তাহলে পশ্চিমা সাহায্য অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

মার্কিনীদের তথ্যমতে, শান্তি আলোচনাকে যুদ্ধবিরতি হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে, যাতে ইউক্রেনের হাতে ভবিষ্যতে নিজেদের ভূমির অধিকার ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া মার্কিন কর্মকর্তারা এখনো চীনকে দিয়ে পুতিনকে আলোচনার টেবিলে বসানোর বিষয়ে আশা হারাননি। যদিও জেনারেল মিলি বলেছেন, এক থেকে দুই বছরের মধ্যে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সাথে শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান লক্ষ্য রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে কোনো কৌশলগত সামরিক মিত্রতা প্রতিষ্ঠিত হতে না দেওয়া।

কিন্তু পাল্টা আক্রমণ পরিকল্পনামাফিক না হলে প্রয়োজনের সময় যথাযথ অস্ত্র সরবরাহ না করার দায় মার্কিন প্রশাসনকেই নিতে হবে, এমনটা মনে করেন ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ইউক্রেনের বিশেষ দূত কার্ট ভলকার। কিয়েভ ব্যর্থ হলে মার্কিন বাদে অন্য মিত্ররাও কিয়েভকে আর কতটুকু সাহায্য দেবে সে বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

ইউরোপে এনার্জি ও অর্থনৈতিক খাত এখনও শক্ত হতে পারেনি। এমন অবস্থায় ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপে জনসমর্থন কমে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিল-এর পরিচালক ও ফেলো ক্লিমেন্টাইন স্টার্লিং।

ইউরোপের অনেক দেশ কিয়েভকে যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপ দিতে পারে। পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হলে এ যুদ্ধের চূড়ান্ত সম্ভাব্য পরিণতি এবং সামরিক সহায়তার মাধ্যমে কোনো সমাধান পাওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেনস্টার্লিং ।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জেলেনস্কিকে প্রকাশ্যে পরামর্শ দিয়েছিলে, জেলেনস্কির কেবল তখনই শান্তি আলোচনা শুরু করা উচিত, যখন তিনি নিজেকে প্রস্তত মনে করবেন। তবে ওয়াশিংটন কিয়েভকে কিছু রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়েও আগাম ধারণা দিয়ে রেখেছে। হাউস অভ রিপ্রেজেন্টেটিভের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে থাকলে এক পর্যায়ে ইউক্রেনে মার্কিন সাহায্যে পরিমাণ কমে যাবে।

জেলেনস্কির দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আন্দ্রি সিবিহা দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছিলেন, ইউক্রেন ক্রিমিয়া পর্যন্ত তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগোতে চায়। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করলে এবং ক্রিমিয়ার প্রশাসনিক সীমানা পর্যন্ত পৌঁছানোর পর এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করতে প্রস্তুত হব।

চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় পক্ষই ছোট ছোট মাত্রায় একে অপরের ওপর তীব্র হামলা করতে সক্ষম হয়েছে । কিন্তু কেউই কাউকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারেনি। প্রায় ১৪ মাসের যুদ্ধে দুই পক্ষই বহু সংখ্যক সৈন্য হারিয়েছে। ইউক্রেনের অভিজ্ঞ ও দক্ষ সেনাদের অনেকেই নিহত বা আহত হয়েছেন। যারা এখনো যুদ্ধেক্ষেত্রে আছেন, এক বছরের যুদ্ধের ক্লান্তি তাদের ওপরও ভর করেছে।

যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত উচ্চাকাক্সক্ষা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদেরকে বেশি বড় এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মোতায়েন করার ঝুঁকি নিয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইউক্রেনের বসন্তকালীন অভিযান থেকে সরে আসার সম্ভাবনা আর নেই।

ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন মনে হচ্ছে ইউক্রেন যে জিততে পারে তা প্রমাণ করার জন্য দেশটির সামনে এটাই একমাত্র ও শেষ সুযোগ। কিন্তু তা বাস্তবতা নয় বলে মনে করেন সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি আ্যানালাইসিস-এর প্রধান আলিনা পলিয়াকোভা।