যেসব কারণে এরদোয়ান জনপ্রিয়

রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান - আনাদুলু

  • হায়দার সাইফ
  • ০৪ মে ২০২৩, ১৯:২৪

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে কেউ অপছন্দ করেন, কেউ করেন অতিভক্তি। তাকে গৌরবোজ্জ্বল তুর্কি ইতিহাসের সুলতানদের সাথে যেমন তুলনা করা হয়েছে, তেমনি ফারাউদের সাথে তুলনা করতেও পিছপা হননি কেউ কেউ। পছন্দ করুন বা না করুন, বাস্তবতা হলো নিজের ব্যক্তিত্ব আর আগ্রাসী শাসন কৌশল দিয়ে বিগত ২০ বছর ধরে তুরস্ক শাসন করে আসছেন এরদোয়ান। কিন্তু এরদোয়ানের কোন পরিচয়গুলো সাধারণ মানুষকে নাড়া দিয়েছে? কোন পরিচয়গুলো তাকে ক্ষমতায় যেতে, বা দীর্ঘ ২০ বছর টিকে থাকতে সাহায্য করেছে? তার কোন পরিচয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি জল্পনা বা আলোচনা চলে?

প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এরদোয়ান। এরপর সংবিধানের অধীনে প্রবল শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট হন তিনি। তুরস্কের ইতিহাসে বেশ কয়েক প্রজন্মের মধ্যে এরদোয়ানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, তার সময়ে বিরোধী পক্ষের সাথে দূরত্বও তৈরি হয়েছে অনেক। সেই হিসেবে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাকে বিভেদ সৃষ্টিকারীও আখ্যা দিয়ে থাকে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এরদোয়ানের কোন পরিচয়গুলো বড় হয়ে উঠেছে? তার পাঁচটি গুণকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছেন কিছু বিশ্লেষক। এর প্রথমটিই হলো দেশের 'নির্মাতা' হিসেবে এরদোয়ানের ইমেজ।

তুরস্কে বহু ব্রিজ, মহাসড়ক নির্মাণ করেছেন এরদোয়ান। নির্মাণ করেছেন বিমানবন্দরও। উন্নয়নশীল একটা দেশে বড় ধরণের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশকে তিনি একবিংশ শতাব্দির উপযোগী করে তুলেছেন। এর মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধিও অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি।

এরদোয়ান নিজেই এই মেগা প্রকল্পগুলোর নাম দিয়েছেন 'ক্রেজি' প্রকল্প। বসফরাসের উপরে তৃতীয় বিশাল উঁচু একটা ব্রিজ হয়েছে। দ্বিতীয় একটি ব্রিজ বানানো হয়েছে মারমারা সাগরের এপার-ওপার। তৃতীয় ব্রিজটি তৈরি করা হয়েছে ডারডানেলিজ প্রণালীতে।

এগুলোর সবগুলোই এক একটা রেকর্ড গড়েছে। রেকর্ড গড়েছে ইস্তান্বুলের ক্যামলিকা মসজিদটিও। এখন তুরস্কের সবচেয়ে বড় মসজিদ এটা। ছয়টি মিনারে সাজানো এই মসজিদটিতে ৩০ হাজার মানুষ এক সাথে নামাজ পড়তে পারবে।

তবে, এরদোয়ানের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি সম্ভবত ইস্তান্বুল ক্যানেল। বসফরাসের ঠিক পশ্চিমেই এটা তৈরি করা হচ্ছে। শহরে বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে মানুষ যাতে আশ্রয় নিতে পারে, সেই ভাবনা থেকে এর আগে এই জায়গাটিকে নির্ধারিত রাখা হয়েছিল।

তবে এরদোয়ানের নির্মাণ তালিকায় আরও অনেক কিছু রয়েছে। উচ্চ গতির ট্রেন চালু ছাড়াও তৃতীয় ইস্তান্বুল বিমানবন্দর নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর হবে এটা। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ। এগুলোর মধ্যে একটি হবে পারমানবিক শক্তি চালিত, যেটা তৈরিতে সাহায্য করছে রাশিয়া।

এরদোয়ানের আরেকটি পরিচয় হলো ফুটবলের প্রতি তার আকর্ষণ। ইস্তাান্বুলের কর্মজীবী মানুষদের বাসস্থান কাসিমপাশা জেলায় বড় হয়েছেন তিনি। জনশ্রুতি রয়েছে, তরুণ বয়সে ফুটবল ছাড়া অন্য কিছুর স্বপ্ন ছিল না তার। ছেঁড়া কাগজ আর কাপড়ে জড়িয়ে বল বানিয়ে সেটা দিয়েই দিনরাত খেলে বেড়াতেন তিনি।

এরদোয়ানের শারীরিক উচ্চতা ১ দশমকি ৮৫ মিটার। অর্থাৎ ছয় ফুটেরও সামান্য বেশি। সব মিলিয়ে তরুণ বয়সে অল্প সময়েই ফুটবল মাঠের গুরুত্বপূর্ণ সেন্টার-ফরোয়ার্ড হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিভিন্ন পেশাদার ফুটবল ক্লাব থেকে আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন তিনি। এগুলোর মধ্যে ইস্তান্বুলের ফেনেরবাহচে-ও রয়েছে।

কিন্তু এরদোয়ানের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন তারা বাবা। কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলের খুবই সাদামাটা এক নাবিক ছিলেন তিনি। এরদোয়ানকে ধর্মীয় শিক্ষার দিকে তিনিই ঠেলে দিয়েছিলেন। কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েই পেশাদার ফুটবল ছাড়লেও ক্যারিয়ারের পুরো সময়টাতেই ফুটবলারদের সাথে যোগাযোগ ছিল তার। ফুটবলের বড় ফ্যানও ছিলেন তিনি সবসময়।

২০১৪ সালে এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বাসাকসেহির ফুটবল ক্লাবটি কিনে নেন। ইস্তান্বুলের ছয়টি ক্লাবের একটি হলেও, এই ক্লাবটির আগে তেমন নাম ডাক ছিল না।

কিন্তু এরদোয়ানের দল-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এই ক্লাবটি কেনার পর সেটা খুব দ্রুতই ফুটবলের অন্যতম বড় শক্তি-কেন্দ্র হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, ২০২০ সালে ফুটবল লিগও জিতে নেয় ক্লাবটি।

এরদোয়ানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো ধর্মের প্রতি তার অনুরক্তি। বলা যায়, ধর্মের প্রতি এই আগ্রহ আসলে তার পরিবারই তাকে গড়ে দিয়েছে। অনেকে এটাও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট না হয়ে এরদোয়ান যদি একজন ইমাম হতেন, তাতেও খুশি হতেন এরদোয়ানের বাবা।

মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের গড়ে তোলা সেক্যুলার তুরস্কের প্রথম ধর্মীয় সরকারী স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন এরদোয়ান। সেখানে কোরআনের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু হয়। পরবর্তীতে এরদোয়ান যে নতুন আন্দোলন গড়ে তোলেন, সেখানেও মানুষকে জড়ো করার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ইসলাম। এই আন্দোলনই এখন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি নামে পরিচিত।

এরদোয়ান সবসময় ধার্মিক জীবন যাপনের প্রচারণা চালিয়েছেন। ধূমপান ও মদ্যপানের মতো বিষয়গুলোকে তার দলের মধ্যে অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। আবার পশ্চিমের তথাকথিত বিভিন্ন সমকামী আন্দোলনের বিপরীতে ঐতিহ্যগত পারিবারিক মূল্যবোধকে তিনি বেশি মূল্য দেন।

আধুনিক পশ্চিমা নারীবাদীদের অনেকে যেখানে মাতৃত্বকে নারীদের উন্নয়নের পথে বাধা মনে করেন, সেখানে এরদোয়ানের একেপি দল মাতৃত্বকে উদযাপন করে। সরকারী বিভিন্ন পেশাসহ স্কুল বা অন্য কর্মক্ষেত্রে যে সব নারী হিজাব ব্যবহার করে, তাদেরকেও সাধুবাদ জানায় একেপি। আতাতুর্ক যখন ১৯২৩ সালে তুরস্ক গঠন করেছিলেন, তখন নারীদের এই হিজাব পড়ার অধিকারকে বাতিল করা হয়েছিল।

স্রষ্টা প্রদত্ত বক্তা হিসেবেও এরদোয়ানের রয়েছে বিশেষ সুনাম। পাবলিক বক্তা হিসেবে তিনি অসামান্য। মঞ্চে উঠলে তিনি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেন। আজ পর্যন্ত কোন জাতীয় নির্বাচনে তিনি হারেননি। সেই অর্জনও রয়েছে তার ঝুড়িতে।

সাম্প্রতিককালে পেটের পীড়ার কারণে আগের মতো আর ব্যাপক সফর করতে পারেন না এরদোয়ান। কিন্তু আগের বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেখা গেছে, এক দিনে আটটি শহরেও বক্তৃতা করেছেন তিনি। বক্তৃতা দিয়ে সমর্থকদের তিনি দারুণ উজ্জীবিত করতে পারেন।

বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তৃতায় কখনও তিনি হয়তো বেতন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কোথাও হয়তো কোন শিশুকে চুমু দিয়েছেন। প্রবীণ নারীদের শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখিয়েছেন। অথবা শিশুদের মাঝে ঈদ সেলামির মতো উপহারও বিলিয়েছেন। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো তুরস্কেও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শিশুদের এই সেলামি দেওয়ার রীতি রয়েছে।

সরকার-পন্থী মিডিয়াগুলো এরদোয়ানের এই সমস্ত কর্মকান্ডের ব্যাপক প্রচার করে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার কোন সভা হলে সেগুলো সবসময়ই এই মিডিয়াগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়।

আঞ্চলিক ক্ষমতার অন্যতম প্রতীক হিসেবেও এরদোয়ানের একটা ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তুরস্ক। একদিকে তারা কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ উপকূল পাহারা দিচ্ছে, অন্যদিকে ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূলও রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই কৌশলগত অবস্থানকে এরদোয়ান সবসময়ই কূটনীতিতে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন।

রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছিলেন এরদোয়ান। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কিছু নেতার একজন হয়ে ওঠেন, ভøাদিমির পুতিন আর রাশিয়ার সাথে যার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে, ন্যাটোর অংশীদার হিসেবে কিয়েভকে তাদের অস্ত্রও দিতে হয়েছে। দুই দেশের সাথেই এই সম্পর্কের কারণে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রফতানির ব্যাপারে সফলভাবে মধ্যস্থতা করতে পেরেছিলেন এরদোয়ান। আন্তর্জাতিক মহলে তার এই ভূমিকা বেশ প্রশংসিতও হয়েছে।

এদিকে, সিরিয়ায় অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে পশ্চিমাদের ক্ষোভের মুখেও পড়েছেন এরদোয়ান। একটা পর্যায়ে মনে হয়েছিল, প্রতিপক্ষ সবগুলো দেশের সাথেই যেন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক থেকে নিয়ে ইউরোপের গ্রিস - সবার সাথেই উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল আঙ্কারার।

ইসরাইল আর মিশরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এরদোয়ান। লিবিয়া যুদ্ধে তিনি হস্তক্ষেপও করেছেন। নাগার্নো- কারাবাখ নিয়ে ২০২০ সালে যে যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে জেতার ক্ষেত্রে আজারবাইজানকে সাহায্যও করেছে তুরস্ক।

এই মুহূর্তে এরদোয়ানকে অবশ্য নতুন অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সেজন্য অনেকের সাথে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছেন তিনি। বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি এমনকি গ্রিসের সাথেও কূটনীতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছেন তিনি।

ফেব্রুয়ারিতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ভূমিকম্পের পর অনেক দেশের সাথে ‘ভূমিকম্প কূটনীতি’ শুরু করেছেন এরদোয়ান। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই ভূমিকম্প শুধু মানুষই মারেনি, এরদোয়ানের বিপুল জনপ্রিয়তাকেও সে অনেকটা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।