দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় চীন-যুক্তরাষ্ট্রের কিসের প্রতিযোগিতা?

চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের লড়াইও তীব্র হবে - সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ১৫ আগস্ট ২০২২, ২২:২০

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো সম্প্রতি চীন সফরে গিয়েছিলেন। উইডোডো সেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সাথে বৈঠক করেছেন। প্রেসিডেন্ট শি বলেছেন, এই সফরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। ইন্দোনেশিয়া আর আসিয়ান চীনের আঞ্চলিক কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। ১০ সদস্যের আসিয়ানের অবস্থান পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আর আফ্রিকাকে সংযুক্তকারী জলপথের উপর। এশিয়াতে তৃতীয় বৃহত্তম আর বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক ব্লক হয়ে উঠেছে আসিয়ান। ৭০০ মিলিয়ন জনসংখ্যা আর বহির্মুখী নীতি এই অঞ্চলে বিপুল প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

চলতি বছরে এই অঞ্চলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হবে। কম্বোডিয়ায় আসিয়ান, ইন্দোনেশিয়ায় জি-২০, আর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে ২১ সদস্যের এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশান অর্গানাইজেশানের সম্মেলন।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে কি কূটনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে আসিয়ান। বেইজিংয়ের চায়না ইন্সটিটিউট অব কনটেম্পোরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান্সের, অধ্যাপক লুও ইয়োংকুন মনে করেন, মহামারি আর যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ার নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কোন সঙ্ঘাতে জড়াতে চায় না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাজের প্রক্রিয়া থমকে গেলে কি সমস্যা তৈরি হবে, সেটা নিয়েও তাদের শঙ্কা রয়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা এবং কূটনৈতিক চেষ্টার মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার নীতিকে সাধারণভাবে মেনে নিয়েছে চীন, আসিয়ানসহ এশিয়ার দেশগুলো। তবে বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন, চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের লড়াইও তীব্র হবে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইউসুফ ইসহাক ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর চোই শিং কুওক মনে করেন, আসিয়ান দেশগুলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক চায়, এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোন পক্ষ নিতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিগত ৩০ বছর দক্ষিণপূর্ব এশিয়া যে শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল, সেই দিন শেষ হয়ে এসেছে। চোই বলেন, আগামীতে বিভিন্ন ইস্যুতে কোন একটা পক্ষ নেয়ার জন্য তাদেরকে ঠেলে দেয়া হবে। ভবিষ্যৎটা এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য কঠিন হয়ে উঠছে।


চীন আর যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কারণে এখানে সহযোগিতারও একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির প্রতিষ্ঠাতা ডিন কিশোর মাহবুবানি মনে করেন, এই অঞ্চলের জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের একসাথে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে তারা একসাথে কাজ করতে পারে।
উইডুডুর চীন সফরে ইন্দোনেশিয়া ও চীনের মধ্যে বেশ কিছু সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। দুই দেশ ভ্যাকসিন ও জিন গবেষণায় সহযোগিতায় সম্মত হয়েছে। আঞ্চলিক ভ্যাকসিন উৎপাদন কেন্দ্র তৈরিতে ইন্দোনেশিয়াকে সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। সেই সাথে দুই দেশ শিক্ষা বিনিময়, এবং পর্যটন কর্মসূচি জোরদারের বিষয়েও একমত হয়েছে।
চীন আর ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে যখন সহযোগিতা জোরদার হচ্ছে, তখন অন্যদিকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কৌশলগত বিভিন্ন অবস্থানে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতাও তীব্র হচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসন সাম্প্রতিককালে এশিয়াতে প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করেছেন। ২০২১ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ইন্দো- প্রশান্ত অ্যাফেয়ার্সের সমন্বয়ক কুর্ট ক্যাম্পবেল বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিনিময় বাড়ানো দরকার। এতে ইন্দো- প্রশান্ত কৌশল আরও কার্যকর হবে।
২০২১ সালের শেষ দিকে সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ধারাবাহিক সফর করেছেন। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিন। মে মাসে ওয়াশিংটনে প্রথম মার্কিন-আসিয়ান সম্মেলনের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আসিয়ানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।

ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি চীন আর আসিয়ানের মধ্যেও উচ্চ পর্যায়ের বিনিময় বেড়ে গেছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই পুরো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় দুই সপ্তাহের কূটনৈতিক সফরে বেরিয়েছিলেন। এই সফরে তিনি আমেরিকার ইন্দো- প্রশান্ত কৌশলের বিকল্প তুলে ধরেন।

মে মাসে জাপান সফরকালে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি বা আইপিইএফ-এর প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। মূলত চীনের নেতৃত্বে গৃহীত আরসিইপি'র মোকাবেলার জন্যই এটা প্রস্তাব করা হয়েছে।


দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে আইপিইএফ প্রস্তাব কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এর মধ্যে বাণিজ্য বাধা দূর করার কোন প্রতিশ্রুতি নেই। আমেরিকান কর্মসংস্থান ধরে রাখার জন্য আসিয়ানের কাছে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে আরসিইপিতে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, ৯০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক আগামী ১০ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে।


আইপিইএফ এখন ধারণার পর্যায়ে রয়েছে, এবং এই বিষয়ে এখনও দর কষাকষি বাকি আছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই চুক্তি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে খুব একটা ভারসাম্য আনতে পারবে না। অনেকে মনে করেন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে বাইডেন প্রশাসন দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে খুব বেশি কিছুর প্রস্তাব দিতে পারেনি। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার কৌশলগত অগ্রাধিকার হলো নিরাপত্তা, রাজনীতি, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অন্যদিকে, চীনের অগ্রাধিকার হলো মূলত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এই অঞ্চলের দেশগুলোর চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই চীন সেটা করতে চায়।


এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হলো চীন। ২০২১ সালে চীন আর আসিয়ানের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৭৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র আর আসিয়ানের বাণিজ্যের চেয়ে এটা প্রায় দ্বিগুণ। ২০০৯ সাল থেকে চীন আসিয়ানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে চলে আসছে। অন্যদিকে, ২০২০ সালে ইউরোপিয় ইউনিয়নকে ছাড়িয়ে চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে আসিয়ান।বিশাল আকারের বাজার, তুলনামূলক যুব- প্রধান জনসংখ্যা এবং বহির্মুখী নীতির কারণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখানকার অতিমাত্রার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র ও উন্নয়নের তারতম্যের কারণে ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আসিয়ান দেশগুলোর গড় বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ১০ বছরের মধ্যে আসিয়ান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক মনে করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আসিয়ান অঞ্চলের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠি মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এতে ব্যাপক ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি হবে এবং আগামী এক দশকের মধ্যে এই অঞ্চলে চার ট্রিলিয়ন ডলারের ভোক্তা বাজার তৈরি হবে।
যদিও অর্থনীতির দিক থেকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে একটা সমন্বিত বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভাষা ও সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পরিবেশ, এবং আর্থিক ও মুদ্রা ব্যবস্থার দিক থেকে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।


বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে দেখা গেছে, ২০২১ সালে এই অঞ্চলের সবচেয়ে উন্নত দেশ সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ৭২ হাজার ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, সবচেয়ে স্বল্প উন্নত দেশ কম্বোডিয়ার মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ হলো মাত্র ১৫৯১ ডলার। অর্থাৎ, কম্বোডিয়ার তুলনায় সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৪৫ গুণ বেশি।
হংকংয়ের চাইনিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টেরেন্স তাই লিউং মনে করেন, ইউরোপিয় ইউনিয়নে বিচার, আইন, ও নির্বাহী বিভাগের যে ক্ষমতা রয়েছে, আসিয়ান দেশগুলোতে সেটা নেই। এই জোটে শক্তিশালী নেতারও অভাব রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারলে আসিয়ানের পক্ষে ইউরোপিয় ইউনিয়নের মতো হওয়া, এবং সেই উন্নয়ন অর্জন করাটা কঠিন হবে।