সাফল্যের পাল্লা রাশিয়ার দিকে : অসহায় ইউক্রেন

যুদ্ধের মাঠে ক্লান্ত ইউক্রেনীয় সেনা - আনাদুলু

  • মোতালেব জামালী
  • ৩১ মে ২০২২, ১৮:২০

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডোনবাসে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলের টার্গেট নিয়েই এই অভিযান শুরু করা হয়েছিল। তবে যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে রুশ বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের গতিপথ এখন আর ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে নেই, বরং ধীরে ধীরে রাশিয়ার দিকেই ঝুকে পড়ছে।

ডোনবাসে রুশ বাহিনী ও তাদের সমর্থিত বিদ্রোহী যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনের মুখে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছে ইউক্রেনের সেনারা। ইউক্রেনকে দেয়া পশ্চিমা সামরিক সাহায্যও সেখানে রাশিয়ার অগ্রাভিযানকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অভিযোগ করছেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধা করছে। তার সরকার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে দূরপাল্লার রকেট চেয়েছে। এগুলো পেলে যুদ্ধের মোড় এখনো ঘুরে যেতে পারে।

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার রাশিয়াকে কিছু ভূখন্ড ছেড়ে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউক্রেনের প্রতি যে আহবান জানিয়েছেন। তার সে আহবান প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। গত ২৪ মে পরিচালিত এক জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ৬৮ শতাংশ এবং দক্ষিনাঞ্চলের ৮৩ শতাংশ মানুষ রাশিয়াকে ভূখন্ড ছেড়ে দিয়ে শান্তি স্থাপনের ঘোর বিরোধী। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে তার দেশের প্রতি মিটার ভূখন্ড উদ্ধার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

 যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাস্তব পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভিন। রুশ বাহিনী পূর্ব ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলে যথেষ্ট সাফল্য পাচ্ছে। সেখানে রুশ বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের মুখে ইউক্রেনের সেনারা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ইউক্রনের উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালিয়ার বলেছেন,  আমাদের সেনারা এখনো কোন রকম ভাবে লড়াইয়ের ফ্রন্টলাইন আগলে রেখেছে। রুশ বাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। না হয় নিশ্চিহ্ন হওয়ার  পরিস্থিতির মুখে রয়েছে।

পূর্ব ইউক্রেনের পুরোনো শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ অঞ্চল ডোনবাস। ‘ডোনেট বেসিন’ বা ডোনেট নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে এই শহর। রাশিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা রুশ ভাষাভাষী ডোনবাসকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নিরস্ত্রীকরণ। ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে ডোনবাসে এই বিশেষ অভিযান শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। যুদ্ধের শুরুতেই দ্রুত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখল করে সেখানে রুশপন্থি একটি সরকার ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনাও ছিল পুতিনের। কিন্তু তার সেই চেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি।

যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনের সেনাদের পাল্টা আক্রমনে রাশিয়ার ১০ জনের বেশি জেনারেলসহ ২০ হাজারের বেশি সেনা সদস্য নিহত হয়েছে। ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত শত ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যান, যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম। এমনকি কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার নৌবাহিনীর গৌরবের প্রতীক হিসেবে পরিচিত যুদ্ধ জাহাজ মস্কোভা ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা। তাদের প্রবল পাল্টা আক্রমনের মুখে রাজধানী কিয়েভের আশপাশ থেকে পিছু হঁটতে বাধ্য হয় রুশ সেনারা।

এরপর থেকে রুশ বাহিনী ডোনবাস অঞ্চলকেই তাদের আক্রমনের প্রধান টার্গেটে পরিণত করেছে। এই অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা ইতিমধ্যেই তারা দখল করে নিয়েছে। রাশিয়ার প্রচন্ড হামলার মুখে ইউক্রেনের সেনারা তাদের প্রথম দিকের সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না।

একের পর এক শহর ও গ্রাম দখল করছে রুশ বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী মারিউপোলসহ বেশ কিছু শহর এখন রাশিয়ার দখলে। ডোনবাসে রুশ বাহিনী যে সাফল্য পাচ্ছে তা ইউক্রেনের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। রুশ বাহিনী যুদ্ধে তাদের প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠে এখন সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে। যুদ্ধের গতি এখন ক্রমেই রাশিয়ার দিকেই ঝুকে পড়তে শুরু করেছে বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ইউক্রেন সরকার বলছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় দুটি শহর সেভারোদোনেৎস্ক এবং লিসিচ্যানস্ক দখল করেছে।  রাশিয়া সেখানে হাজার হাজার অতিরিক্ত সৈন্য পাঠিয়েছে। সেভারোডোনেৎস্কের সামরিক-বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ওলেকজান্ডার স্ট্রিউক জানিয়েছেন, রুশ গোলার আঘাতে শহরের ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ওই শহরে আগে লোকসংখ্যা ছিল এক লাখের উপরে। বর্তমানে তা ১২ থেকে ১৩ হাজারে পৌছেছে। এসব মানুষ যুদ্ধের মধ্যে আটক পড়ে আছেন।

লিসিচ্যানস্ক শহরে রুশ হামলায় নিহত মানুষদের গণকবর দেয়া হচ্ছে। লুহানস্কের গভর্নর সেরহি হাইদাই বলেছেন, ওই এলাকা দখল করার জন্য রাশিয়া পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। এই শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় পুরো অঞ্চলটি রাশিয়ার হাতে চলে যাবে। এর ফলে এসব শহরকে রক্ষার জন্য ইউক্রেনের বাহিনী যেসব জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে তারা অকার্যকর হয়ে পড়বে। ডোনবাসে রুশ বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে ইউক্রেনের সৈন্যরা চাপের মুখে আছে বলে স্বীকার করেছে কিয়েভের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও।

রুশ বাহিনী বিপুল সৈন্য, কামান, সাঁজোয়া যান, এবং বিমানবাহিনীর শক্তি সব ক্ষেত্রেই রাশিয়া সংখ্যার দিক থেকে ইউক্রেনকে পেছনে ফেলেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ডোনবাস অঞ্চলে তাদের একজন সেনার বিপরীতে রাশিয়ার সাতজন করে সেনা আছে।

লুহানস্ক প্রদেশের গভর্নর সেরহি হাইদাই বলেন, ওই রাস্তাটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ চলছে, কিন্তু এটি এখনো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, দিনরাত গোলাবর্ষণ, মিসাইল নিক্ষেপ ও বিমান থেকে বোমা ফেলে সেভারোদোনেৎস্ক শহরটিকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।

রুশ বাহিনী এখন এতটাই কাছে চলে এসেছে যে তারা রকেটের পাশাপাশি মর্টারও ব্যবহার করছে। এছাড়া এখান থেকে অনেকটা দূরে ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়া এবং ক্রিভি রিহ শহর দুটির ওপরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী।

কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ট্রেসি জার্মান বলছেন, এটি একটি অনেক বড় এলাকা এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ভৌগলিক জটিলতাগুলো উপেক্ষা করার মত নয়। রুশ সীমান্তের দক্ষিণের খারকিভ শহরটি ইউক্রেনের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইজিয়াম শহর। এটি হচ্ছে একটি প্রধান মোটরওয়ে সংলগ্ন এলাকা যা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলে যাওয়া যায়।

 রুশ বাহিনী এখন ইজিয়ামের আশপাশের প্রধান হাইওয়েগুলো ধরে ধরে এগুচ্ছে। এর কারণ হলো, তাদের যুদ্ধসরঞ্জামের বেশিরভাগই তারা নিয়ে যাচ্ছে সড়ক ও রেলপথ দিয়ে।

রুশ বাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে শ্লোভিয়াানস্ক শহর। এমওথ্রি রাস্তা দিয়ে এই শহরটিতে যেতে হয় এবং এর লোকসংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার। ২০১৪ সালে এটি রুশ-সমর্থিত বাহিনী দখল করলেও পরে তা হাতছাড়া হয়ে যায়। তাদের আরও একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে ক্রামাটরস্ক দখল করা।

ডোনবাস অঞ্চলে রুশ বাহিনীর অভিযান চলতে থাকার মধ্যেই সেখানকার রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বলছে, তারা লিমান নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করেছে। শ্লোভিয়ানস্ক শহরে যাবার রাস্তার ওপর লিমান শহরটির অবস্থান এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল-সংযোগস্থল।

রাশিয়া পুরো ডোনবাস এলাকা দখল করার যে চেষ্টা করছে তাতে এ শহরটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উপদেষ্টা ওলেক্সেই আরেস্টোভিচ লিমান শহর রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখল করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গত এক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার জন্য এটি দ্বিতীয় বড় সাফল্য। এর আগে তাদের হাতে আরো দক্ষিণের সিভটলোডারস্ক শহরটির পতন হয়।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী মনে করে, পুতিন শুধু ডোনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণই নিতে চান না, বরং দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন, ক্রিমিয়ার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল এবং জাপোরিঝিয়ার কিছু অংশও নিয়ে নিতে চান তিনি। এর ফলে তিনি রাশিয়ার দক্ষিণ উপকুল বরাবর একটি ভূ-সংযোগ তৈরি করতে পারবেন। আর এটা করতে পারলে তিনি ক্রিমিয়ার পানির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। রুস্তর মিনেকায়েভ নামের একজন রুশ জেনারেল বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ওডেসা ছাড়িয়ে কৃষ্ণসাগর উপকুল পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের সমুদ্রতীরবর্তী সব এলাকা দখল করে দেশটিকে  স্থবেষ্টিত একটি ভূখন্ডে পরিণত করা যাতে ইউক্রেনকে সহায়তা করতে পশ্চিমাদের যুদ্ধ জাহাজ কৃষ্ণসাগর এলাকায় আর ভিড়তে না পারে।