ইউক্রেন যুদ্ধ : কে কেমন অস্ত্র ব্যবহার করছে?

-

  • হায়দার সাইফ
  • ০৬ মে ২০২২, ২০:১০
ইউক্রেনের যুদ্ধ তৃতীয় মাসে পড়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমা বহু দেশ ইউক্রেনকে বিভিন্ন ধরণের সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ন্যাটো মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার সাথে সরাসরি সঙ্ঘাত এড়াতে চায়। তাদের আশঙ্কা হলো, রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে সেটা পারমানবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এই আশঙ্কার কারণে বহু পশ্চিমা দেশ বলার চেষ্টা করছে যে, তারা ইউক্রেনকে শুধুমাত্র রক্ষণাত্মক অস্ত্র দিচ্ছে, আক্রমণাত্মক অস্ত্র দিচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই দুই ধরণের অস্ত্রের পার্থক্যটা খুবই অস্পষ্ট। অনেক আক্রমণের অস্ত্রই সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করা যায়। আবার রক্ষণাত্মক হিসেবে পরিচিত অস্ত্রও হামলায় ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া আধুনিক ট্যাকটিক্যাল যুদ্ধে সাধারণত দুই ধরণের অস্ত্রই সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা হয়। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে। যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনকে যে সব অস্ত্র ও সরঞ্জাম সহায়তা দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ছিল স্বল্পপাল্লার ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী এবং বিমান বিধ্বংসী সিস্টেম। ছোট ক্যালিবারের অস্ত্রের উপযোগী গোলাবারুদ, ব্যক্তিগত সরঞ্জাম, এবং যোগাযোগের যন্ত্রপাতি। পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করছে, তারা রক্ষণাত্মক অস্ত্রাদি দিয়েছে, তার সাথে এই অস্ত্রগুলোর মিল রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ যখন দীর্ঘায়িত হতে থাকলো, তখন পশ্চিমাদের দেয়া সামরিক সহায়তার মধ্যে সাঁজোয়া যান, কামান, দূরপাল্লার সার্ফেস-টু-এয়ার বা ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল, জঙ্গি বিমান ও হেলিকপ্টারও যুক্ত হয়েছে। ইউক্রেন দাবি করেছে , তারা রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু অস্ত্র সরাবরাহের তালিকা যেভাবে বদলে গেছে, সেটা তাদের দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আক্রমণাত্মক অস্ত্রের সরবরাহ বাড়লে এবং সেগুলোর ব্যবহার শুরু হলে যুদ্ধ পারমানবিক সঙ্ঘাতে রূপ নিতে পারে। এই সতর্কবার্তা প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আগেই দিয়েছেন। অন্যেরা বলার চেষ্টা করছেন যে, আক্রমণাত্মক অস্ত্র সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত সঠিক এবং এটা এই মুহূর্তে দরকার ছিল। কিন্তু এই দুটো মতের কোনটাই আসলে ঠিক যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ আক্রমণাত্মক আর রক্ষণাত্মক অস্ত্রের পার্থক্যটা এতই অস্পষ্ট যে, তা কার্যকরভাবে চিহ্নিত করাটা সহজ নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন , কিছু অস্ত্রের রেঞ্জ বা পাল্লা, স্থানান্তরের উপযোগীতা, এবং সুরক্ষা সিস্টেমের কারণে সেগুলোকে আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বিবেচনা করা যায়। নিজেদের সীমান্ত রক্ষার চেয়ে প্রতিবেশী কোন দেশের উপর হামলায় এগুলো বেশি কাজে লাগবে। ট্যাঙ্কের কথা বলা যায়। ট্যাঙ্ককে সব সময় আক্রমণাত্মক অস্ত্র বিবেচনা করা হয়। কারণ এগুলো স্থানান্তকরযোগ্য এবং এতে শক্ত সুরক্ষা সিস্টেম রয়েছে। ডিপ-স্ট্রাইক মিসাইল বা জঙ্গি বিমানকেও সাধারণত আক্রমণাত্মক অস্ত্র মনে করা হয়, কারণ এগুলোর দীর্ঘ দূরত্বে আঘাত হানার সক্ষমতা রয়েছে। একই কারণে এক সময় যুদ্ধজাহাজ ও বিমানবাহী রণতরীগুলোকেও আক্রমণাত্মক অস্ত্র মনে করা হতো। ১৯২২ সালের ওয়াশিংটন নেভাল ট্রিটি এবং ১৯৯০ সালের কনভেনশনাল ফোর্সেস ইন ইউরোপ এগ্রিমেন্টে এর আক্রমানতœক ও রক্ষনাতœক অস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে কিছু অস্ত্রকে আক্রমণাত্মক এবং অন্য কিছু অস্ত্রকে রক্ষণাত্মক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের সুর্দীর্ঘ ইতিহাসে এই ধরণের পার্থক্যগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে বিভিন্ন যুদ্ধের ঘটনা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, জোট গঠন প্রক্রিয়া, এমনকি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মারাত্মক কিছু ধারণাগত সমস্যার কারণে এই চেষ্টা খুব একটা কাজে লাগেনি। এর একটি বড় কারণ হলো, অধিকাংশ অস্ত্রই আসলে আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক দুই কাজেই ব্যবহার করা যায়। ট্যাকটিক্যাল পর্যায়ে যেখানে আলাদাভাবে যুদ্ধ হয়, যেখানে প্রায় যে কোন অস্ত্রই হামলা করা বা সুরক্ষা দুই কাজেই ব্যবহার করা যায়। যেমন ট্যাঙ্ক দিয়ে হামলা যেমন করা যায়, তেমনি শত্রুর ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষাও পাওয়া যায় এই ট্যাঙ্কের মাধ্যমে। ট্যাঙ্ক যে হারে গুলি চালাতে পারে, এবং যে পরিমাণ গোলা বহন করতে পারে, সেটা অধিকাংশ পদাতিক বাহিনীর ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী অস্ত্রের চেয়ে বেশি। তাছাড়া ট্যাঙ্কের আর্মার সুরক্ষা সিস্টেম পরিচালনাকারী সেনাকে সুরক্ষাও দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, জ্যাভেলিন বা এনএলএডাব্লিউ এর মতো ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী সিস্টেম যারা পরিচালনা করে, তারা সহজেই শত্রু পক্ষের হামলার শিকার হতে পারে। ১৯৭৩ সালে গোলান মালভূমির যুদ্ধে ইসরাইলের সেনা সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু সিরিয়ার ট্যাঙ্কগুলোর বিপক্ষে তারা মূলত ট্যাঙ্ক দিয়েই নিজেদের রক্ষা করেছিল। পদাতিক বাহিনী দিয়ে নয়। পদাতিক বাহিনীও সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। পদাতিক সেনারা নিজেদের সহজে লুকিয়ে রাখতে পারে, এবং ছোট পরিসীমার এলাকায় তারা হামলা করতে পারে। এটা আবার ট্যাঙ্ক পারবে না। ২০০৯ সালে তালেবান হামলাকারীরা সিওপি কিটিং এলাকার মার্কিন ঘাঁটিকে প্রায় মুছে দিয়েছিল। সেখানে যুদ্ধ করেছিল শুধু পদাতিক সেনা, এবং সেখানে কোন ট্যাঙ্ক ছিল না। দূরপাল্লার মিসাইল বা বিমান শত্রুর ভূখন্ডে হামলা চালাতে পারে। আবার এগুলো সুরক্ষার কাজেও সাহায্য করতে পারে। শত্রু সেনার সরবরাহ বিমান ধ্বংস করে বা শত্রুর হামলার মুহূর্তে বাধা সৃষ্টি করে, তাদের হামলার তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে এই অস্ত্রগুলো। ১৯৪৩ সালে জেনারেল রোমেল যখন উত্তর আফ্রিকায় হামলা চালাতে যাচ্ছিল, তখন মিত্র বাহিনী জার্মান সেনাবাহিনীর পেছনের লজিস্টিক্স বহনকারী জাহাজে হামলা করেছিল। ফলে জার্মানিকে তখন রোমেলের হামলা স্থগিত করতে হয়েছিল। বিমান-বিধ্বংসী মিসাইল দেশকে শত্রুর বিমান হামলা থেকে রক্ষা করতে পারে। আবার একই সাথে এই মিসাইল আক্রমণকারী স্থল বাহিনীকে প্রতিপক্ষের বিমান হামলা থেকেও বাঁচাতে পারে। ১৯৭৩ সালে যে মিশরীয় বাহিনী ইসরাইলে আক্রমণ করেছিল, তারা সিনাই এলাকায় আক্রমণকারী বাহিনীকে রক্ষার জন্য স্থল-ভিত্তিক বিমান সুরক্ষা সিস্টেম ব্যবহার করেছিল। আধুনিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে খুব কম অস্ত্রই আলাদাভাবে সমন্বয়ের বাইরে ব্যবহার করা হয়। সেই ১৯১৭ সাল থেকেই সমন্বিত অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল যুদ্ধক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে দক্ষ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সফল হতে হলে ট্যাঙ্কের মতো আক্রমণাত্মক অস্ত্রের সাথে পদাতিক বাহিনীর মতো রক্ষণাত্মক শক্তিকে সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার অভিযানে সীমাবদ্ধতা ছিল ট্যাঙ্কগুলোকে সহায়তা করার মতো পদাতিক সেনা সেখানে ছিল না। ট্যাঙ্কের বহরের সাথে সহায়ক শক্তি না থাকায় সেগুলো অসহায় হয়ে পড়েছিল। ইউক্রেনের লুকিয়ে থাকে সেনাদেরকে ট্যাঙ্কের ক্রুরা দেখতে না পাওয়ায় তাদের মোকাবেলা করতে পারেনি। সফলভাবে হামলার জন্য রাশিয়ার আক্রমণাত্মক ট্যাঙ্কগুলোর সাথে তাদের রক্ষণাত্মক পদাতিক বাহিনীর সমন্বয় করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের যে কোন ট্যাকটিক্যাল অভিযানে আক্রমণ ও সুরক্ষা দুটো উপাদানই থাকে। আক্রমণকারীকে হয়তো আমরা কোন একটা পয়েন্টে আক্রমণ করতে দেখি। কিন্তু একই সময়ে তারা অন্য ক্ষেত্রে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় থাকে। রক্ষণাত্মক বাহিনী সাধারণত আক্রমণকারীর হামলার পয়েন্টে সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। সেই বাহিনীই আবার আক্রমণকারীদের অন্য কোন ফ্রন্টে হামলা চালায়। খারকিভসহ আরও কিছু জায়গায় ইউক্রেনের বাহিনী এই কাজ করেছে। আক্রমণকারীরা সাধারণত হামলার কারণে ভূখন্ডের দখল নিয়ে নেয়। কিন্তু হারানো ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য রক্ষণশীল বাহিনীকে আবার পাল্টা হামলায় যেতে হয়। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকায় জার্মান হামলার মুখে ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। সেই হারানো ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল সময়ে তাদেরকে বড় ধরণের পাল্টা হামলায় যেতে হয়েছিল। যে কোন অস্ত্রের কার্যকারিতার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করে। তা হলো অস্ত্র বা সিস্টেম ব্যবহারকারী সেনাদের দক্ষতা ও কৌশল। কৌশল, দক্ষতা, এবং উদ্দমের পার্থক্যের কারণে বহু অস্ত্র ও সরঞ্জামের ব্যবহারে পার্থক্য দেখা যায়। ১৯৩৯ ও ১৯৪০ সালে যে নতুন ট্যাঙ্ক, বিমান ও রেডিও প্রযুক্তি দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে বিজয় এসেছিল। সেই অস্ত্রগুলোই আবার পরে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কারন প্রতিপক্ষ সেগুলোর প্রকৃতি বুঝে গিয়েছিল। এতে সন্দেহ নেই যে, ইউক্রেনকে দেয়া অস্ত্রের মধ্যে বৈচিত্র আসলে সেটা তাদের আক্রমণ ও সুরক্ষা উভয় সক্ষমতাই বাড়াবে। তবে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মিসাইলের বদলে ট্যাঙ্ক এবং বিমান বিধ্বংসী মিসাইলের বদলে বিমান দেয়া হলে পরিস্থিতি অনেক জটিল হবে। এতে ইউক্রেন আর রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের ধরনের মধ্যে পার্থক্যটা কমে আসবে। মনে রাখতে হবে, অস্ত্র আক্রমণাত্মক না কি রক্ষণাত্মক, অধিকাংশ সময় তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেগুলো ব্যবহারের দক্ষতা আর কৌশল।