ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্র হওয়ার সুবিধা-অসুবিধা


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৬ মে ২০২২, ২০:০০
ইউরোপে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার অজুহাতে ন্যাটো তার সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দরোজা খুলে রেখেছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন নতুন করে ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়ালে তাতে ন্যাটো অনেক সমস্যায় পড়ে যেতে পারে। বর্তমানে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর ফিনল্যান্ড ও সুইডেন নতুন করে ন্যাটোতে শামিল হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে রাশিয়া বলছে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের এই মনোভাবরে কারণে তাদেরকে ভয়াবহ সামরিক ও রাজনৈতিক পরিনতির মুখোমুখি হতে হবে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো আরো কিছু দেশও ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছে। ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্র হওয়ার উপকারিতা এবং এর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন। ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড যাতে যোগ না দিতে পারে সেই ব্যাপারে রাশিয়া নানাভাবে দেশটিকে সতর্ক করছে। কিন্তু রাশিয়ার হুমকির পরও ফিনিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানী ইলে একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ফিনল্যান্ডের ৫৩ শতাংশ নাগরিকই ন্যাটোতে যোগ দেয়া সমর্থন করে। ২৮ ভাগ মানুষ এর বিরোধিতা করে আর ১৯ শতাংশ মানুষ নীরব ছিলো। ন্যাটোতে কোনো দেশ সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে যোগ দিলে প্রথম সুবিধাটি পায় সামষ্টিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সুবিধা। ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানেইজেশন হলো একটি জোট যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্কসহ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ৩০টি দেশ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে। ২০২০ সালে উত্তর মেসোডোনিয়া ন্যাটোর সর্বশেষ সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে যোগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন সেভিয়েত হুমকি মোকাবেলা করা এবং ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে, গোটা পৃথিবী সন্ত্রাস ও সহিংসতা, মাদক পাচার, সাইবার যুদ্ধসহ নানা ধরনের বৈশ্বিক হুমকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এককভাবে একটি দেশের পক্ষে আর এই সমস্যা নিরসন করা সম্ভব নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যাটো সামষ্টিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছে। এর মূল নীতি হলো, যদি কোনো একটি ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র হামলার শিকার হয় তাহলে তা ন্যাটোভুক্ত সব দেশ নিজেদের ওপর হামলা হিসেবেই বিবেচনা করবে। ন্যাটোর কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই। সদস্য রাষ্ট্র নিজেদের প্রতিরক্ষা বাহিনী দিয়ে জোটের কার্যক্রমে ও নানা অভিযানে অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রতিটি দেশই নিজ নিজ সেনা ও সমরব্যয়ের জন্য দায়বদ্ধ থেকেই সম্ভাব্য হুমকিগুলো সামষ্টিকভাবে মোকাবেলা করে। বর্তমানে ন্যাটোর চারটি বহুজাতিক ব্যাটেলগ্রুপ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডে রয়েছে। এই ব্যাটেলগ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানী এবং যুক্তরাষ্ট্র। আর এতে সেনা সংখা ৪ হাজার ৯৫৭ জন। ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান শুরুর পর ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো আরো চারটি বহুজাতিক ব্যাটেলগ্রুপ চালু করতে রাজি হয়েছে। এগুলো বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী, রোমানিয়া এবং স্লোভাকিয়া থেকে কার্যকর হবে। এখন থেকে ন্যাটোর মোট ব্যাটেলগ্রুপের সংখ্যা ৮ এ উন্নীত হবে। ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রগুলো দ্বিতীয় যে সুবিধা পায় তাহলো এই দেশগুলো আলাপ আলোচনা ও সমঝোতার পথ অনেকটা সুগম হয়ে যায়। ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকায় ন্যাটোর মাধ্যমে আটলান্টিকের উভয়পাশেই আলাপ আলোচনার দুয়ার খোলা রয়েছে। ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। নতুন করে কাউকে সদস্যরাষ্ট্র করতে গেলে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যদিও এই সম্মত হওয়ার বিষয়টি কখনোই খুব সহজ হয় না। সদস্যরাষ্ট্রের পাশাপাশি ন্যাটো সদস্য নয় এমন দেশগুলোর প্রতিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি সুবিধা পাওয়া এই দেশগুলোকে ‘এনহ্যান্সড অপোরচুনিটি পার্টনার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই দেশগুলোও ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সামরিক অভিযান এবং মিশনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। ইউক্রেন সরাসরি ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র না হলেও আফগানিস্তান ও কসোভোসহ বিভিন্ন অভিযানে সেনা সদস্য পাঠিয়ে ইউক্রেন আগে থেকেই ন্যাটোর পার্টনার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ রকম আরো কিছু পার্টনার দেশ ন্যাটোর রয়েছে। যার মধ্যে আছে অস্ট্রোলিয়া, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, জর্ডান এবং সুইডেন। ইউরোপসহ গোটা উত্তর আটলান্টিক এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার অজুহাতে ন্যাটো তার সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দরোজা খুলে রেখেছে। তবে ন্যাটোতে যোগ দিতে গেলে আগ্রহী দেশকে কিছু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শর্ত পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে আছে দেশটিকে মুক্তবাজারকেন্দ্রিক একটি গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুশীলণ করা। যে কোনো সংঘাত শান্তি পূর্নভাবে মিমাংসা করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বদ্ধ থাকা। অনেকেই মনে করেন, ন্যাটোর এসব শর্তারোপের মূল উদ্দেশ্য হলো আগ্রহী দেশগুলোতে গনতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া এবং সার্বিকভাবে ইউরোপে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্টা। তবে এর বিপরীত মতও আছে। অনেক পর্যবেক্ষক দাবি করছেন, কোল্ড ওয়ারের সময় ও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ন্যাটোর কার্যক্রমের সাথে গনতান্ত্রিক বার্তার কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। এই বিশ্লেষকরা মনে করেন, ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করতে গেলে যে অর্থ ও ঝুঁকির মাত্রা বরং আরো বেড়ে যাবে। নতুন নতুন দেশ ন্যাটোতে চলে আসলে রাশিয়ার সাথে এই দেশগুলোর টানাপোড়েন আরো বাড়বে। বৈশ্বিক ইস্যুতে সামষ্টিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের সম্ভাবনাও কমে আসবে। ন্যাটোতে যোগ দিলে যেমন কিছু সুবিধা আছে তেমনি অসুবিধার পরিমাণও কম নয়। প্রথম সংকট হলো, ন্যাটোতে যোগ দেয়া মাত্রই রাশিয়ার সাথে সেই দেশের সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি হয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছেন, রাশিয়া যেকোনো মূল্যে ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রতিহত করবে। ন্যাটোর বিস্তৃতিকে রাশিয়া নিজেদের জন্য হুমকি বলেই মনে করে। সাবেক সেভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া ইতোমধ্যেই ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে। আর ইউক্রেন ও জর্জিয়া নন-মেম্বার পার্টনার। ন্যাটোর আরেকটি সংকট হলো, এই জোটে যেকোনো অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা খুব বেশি। ২০১৪ সালে ন্যাটো দেশগুলো তাদের মোট জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্র্রই শেষ পর্যন্ত তাদের কথা রাখতে পারেনি। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একা যত অর্থ ব্যয় করে, বাকি সবগুলো দেশ মিলে তার অর্ধেকও পারে না। সংস্থা হিসেবেও ন্যাটোর সামগ্রিক যে ব্যয় তারও দুই-তৃতীয়াংশই প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র। সমালোচকরা মনে করেন, মার্কিন অর্থের ওপর এই বিপুল নির্ভরতা ইউরোপের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ন্যাটোর সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই ইউরোপের অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সামরিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক অভিযানের পর জার্মানীসহ বেশ কিছু ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র গুলোকে সবসময়ই অর্থনৈতিক চাপের মুখে থাকতে হয়। সমরাস্ত্র গুলোকে ন্যাটোর নির্ধারিত মানে রাখার জন্য এই দেশগুলোকে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু ন্যাটো এই বিষয়টিকে অসুবিধা বা চাপ হিসেবে দেখতে রাজি নয়। তাদের মতে, সমরাস্ত্র আধুনিকায়ন করার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর নিরাপত্তা যেমন বাড়ছে, তেমনি হাতে থাকা অস্ত্রগুলোর যথাযথ ব্যবহারও নিশ্চিত হচ্ছে। এর ফলে সংস্থা হিসেবেও ন্যাটো আগের তুলনায় কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছে। একটি অভিযানে যদি অংশগ্রহণকারী সবগুলো দেশ একই মানের অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে অভিযানের ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া সহজ। যদিও ন্যাটো সামষ্টিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে সবগুলো মিত্রদেশের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তারপরও দেখা যায়, কোনো একটি দেশ আক্রমনের শিকার হলেও অন্যান্য দেশ তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে কিংবা যুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। ২০০১ সালের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পর ন্যাটো তড়িঘড়ি করে প্রথমবারের মতো আর্টিকেল ফাইভ সংযোজন করে। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মিত্রদেশগুলোর সম্মিলিত অবস্থান প্রকাশিত হয়। এর পর টুইন টাওয়ারে হামলার পর পরবর্তী সাত মাস ন্যাটো বিমান যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে টহল দিতে দেখা যায়। পরবর্তীতে ন্যাটো দেশগুলো তাদের নৌ সেনাদেরকেও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় পাঠায় । যেখানে এই সেনারা সন্ত্রাসবিরোধী বেশ কিছু কার্যক্রমে অংশ নেয়। সমালোচকরা বলছেন, ন্যাটোতে সদস্যরাষ্ট্র যোগ দেয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা যেমন বেড়েছে, তেমনি মিত্রদেশগুলোর মধ্যে ভিন্নতা ও সংঘাতের সম্ভাবনাও বেড়েছে। এতে সার্বিকভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। বর্তমানে ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। যদি ন্যাটো দেশগুলো এতে যোগ দেয় তাহলে উত্তেজনা এতটাই বেড়ে যাবে যে, গোটা ইউরোপেই তখন এ যুদ্ধটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।