ইউক্রেন যুদ্ধ পুতিনের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে

-

  • মোতালেব জামালী
  • ২৬ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫৬

সম্প্রতি এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রুশ জনগণের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। রাশিয়ার নাগরিকরা তাদের দেশের প্রতি খুবই অনুগত। ৪৮ শতাংশ রুশ নাগরিক মনে করেন, তাদের দেশের কার্যকলাপ ও নীতি যদি ভুল পথেও পরিচালিত হয় তাহলেও তাদের উচিত হবে দেশকে সমর্থন করা। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশে^র কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে খুব বেশি কাবু করতে পারেনি। রুশ মুদ্রা রুবলের মানও ইউক্রেন যুদ্ধের আগের অবস্থান ফিরে পেয়েছে বলেও জরিপে বলা হয়েছে। পুতিনের ওপর রাশিয়ার জনগনের কেন এই আস্থা তা নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন।


ডাটা ফার্ম আরআইডব্লিউআই এবং অর্থনীতিবিদ ডেভিড উ’র যৌথ উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ রুশ নাগরিক বিশ^াস করেন, বিশে^ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাশিয়াই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। অন্যদিকে ৭২ শতাংশ মার্কিনী এবং ৬৪ শতাংশ চীনা নাগরিক মনে করেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের দেশই রাশিয়ার চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।
অর্থনীতিবিদ ডেভিড উ ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা ও মেরিল লিঞ্চের ম্যাক্রো অর্থনীতির প্রধান কৌশলবিদ ছিলেন। এরপর তিনি তার ডাটা ফার্ম আরআইডব্লিউআই প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি এর কোল্ড ওয়ার ইনডেক্স ২ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এই জরিপ পরিচালনা করে। যদিও বাইডেন প্রশাসন আশা পোষণ করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ক্ষমতা থেকে বিদায় নিশ্চিত করবে। কিন্তু জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এই যুদ্ধ রাশিয়ায় পুতিনের অবস্থানকে আরো সংহত করেছে।


রাশিয়ার কেন্দ্রিয় ব্যাংক ইতিমধ্যেই দেশটির মুদ্রা রুবলের অবস্থানকে সংহত করেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর আগে রুবলের যে মান ছিল কেন্দ্রিয় ব্যাংক রুবলকে আবার সেই অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফিতির হার কমিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের অবস্থায় নিয়ে এসেছে সরকার।
রুবলের শক্তিশালী অবস্থান এবং এর বিনিময় হার নিয়ন্ত্রনে রাখার ফলে ক্রেতাদেমধ্যে আতঙ্ক কমে এসেছে। রাশিয়ার বিভিন্ন অংশে দোকানগুলোতে পণ্যের মজুদ বেড়েছে। রেষ্টুরেন্টগুলো সব সময় খোলা রাখা হচ্ছে। ভোক্তাদের আনাগোনাও আগের মতো স্বাভাবিক রয়েছে।


জরিপে আরো দেখা গেছে, রুশ জনগণের মধ্যে এখন এই ধারণা প্রবল হচ্ছে, বিশে^ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আমেরিকা ও চীনের চেয়ে রাশিয়ার অবস্থান অনেক শক্তিশালী হবে। রাশিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষই একথা বিশ^াস করেন, ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বে রাশিয়াই জিতবে। অন্যদিকে চীনের ৬৪ শতাংশ এবং আমেরিকার ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এই দ্বন্দ্বে তাদের দেশই বিজয়ী হবে।


জরিপ পরিচালনাকারি প্রতিষ্ঠানটি বলছে তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে এই জরিপ কাজটি সম্পন্ন করেছে। রাশিয়ার ১৩০০, যুক্তরাষ্ট্রের ১৬০০ ও চীনের ২২০০ লোকের উপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে এ ধরণের জরিপ এটাই প্রথম বলে জানিয়েছে ডাটা ফার্ম আরআইডব্লিউআই।
এর আগে পশ্চিমা বিশে^ নিরপেক্ষ জরিপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত লেভাদা সেন্টার পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলের সাথে আরআইডব্লিউআই এর জরিপের তথ্যের অনেকটাই মিল আছে। গত ৩১ মার্চ লেভাদা সেন্টার পরিচালিত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৮৩ শতাংশ রুশ নাগরিক পুতিনকে সমর্থন করেন। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে তার প্রতি এই সমর্থন ছিল ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর থেকে রুশ জনগণের মধ্যে পুতিনের জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে।


অন্যদিকে পশিচমা বিশে^র আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও রাশিয়ার অর্থনীতিকে খুব একটা কাবু করতে পারেনি বলেই আরআইডব্লিউআই এর জরীপে উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে। সেই দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ^কে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পর সম্ভবত, এবারই সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখে ফেলেছেন প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন।


তিনি পশ্চিমা বিশে^র গড়ে উঠা ঐক্য, তাদের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম কানুন ও সামরিক শক্তির সক্ষমতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।। ন্যাটো গঠনের পর থেকে পশ্চিমাদের এই সামরিক জোট এবারের মতো এতো কঠিন কৌশলগত সংকটের মোকাবেলা আর কখনোই করেনি।


রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের জেরে পশ্চিমারা ইউক্রেনের সমর্থনে একজোট হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মাধ্যমে তারা রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে এক ঘরে করে ফেলেছে। এর ফলে, ভূ-রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। বাড়ছে মুদ্রাস্ফিতি। জ¦ালানী তেল ও গ্যাসের দাম ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করেছে। মোট কথা, পুরো বিশ^ আর্থিক ব্যবস্থাই অস্থির হয়ে উঠেছে। তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া একাই যে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সংকটে পড়ে গেছে পশ্চিমা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোও। কারণ, রাশিয়ার নানা সরকারি-বেসরকারি কোম্পানীর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের। অন্যদিকে এই সংকটে চীন নিরব থাকলেও রাশিয়ার সাথে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বের দরজা খোলা রেখেছে। দুই দেশের এই অংশিদারিত্ব পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় রাশিয়াকে অনেকটাই সহযোগিতা করেছে।


ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর পশ্চিমা সব দেশের এক বাক্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে থাকার কথা ছিল। কিন্তু পুতিনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহনে পশ্চিমা বিশে^র দুর্বলতা স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাসের আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে রাজী হয়নি। কেননা হঠাৎ করেই এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়া এসব দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। পুতিন পশ্চিমাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তাদের প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চাইছেন।
এই পরিস্থিতি বর্তমান বিশ্বব্যব¯’াকে প্রবলভাবে ঝাকুনি দিয়েছে। গত ২৫ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব বৈশি^ক শাসন ব্যবস্থা পুনর্র্নিমাণের একটি স্পষ্ট মুহূর্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।


ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর মতে, চীন এবং রাশিয়া পশ্চিমা বিশে^র প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করছে। অর্থনৈতিক শক্তিধর চীনের সহযোগিতা রাশিয়ার উপর পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার শক্তিকে স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস করে দিয়েছে।
রাশিয়া ২০১২ সাল থেকে চীনের সাথে তার অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে এবং গত এক দশকে রাশিয়াকে চীনের সাথে বাণিজ্যের উপর ক্রমবর্ধমানভাবে নিভরশীল হয়ে পড়েছে। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিন দিন আরো বাড়ছে।


বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভøাদিমির পুতিন ঐতিহ্যগত সামরিক শক্তিভিত্তিক রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে পশ্চিমা প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত আছেন। মুক্ত বাণিজ্য, গনতন্ত্র ও অর্থনৈতিকভাবে পরস্পর নির্ভরতার এই সময়ে পশ্চিমা বিশে^র নেতারা পুতিনের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থান করছেন। তারা একথা বিশ^াস করছেন যে, তাদের দেয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুতিনের উপর মারাত্বক চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল।

পুতিন সব সময়ই বাস্তবতার নিরিখেই সিদ্ধান্ত নেন ও সে অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি তার প্রতিপক্ষকে কোন কৌশলগত প্রক্রিয়ায় প্রতিহত করবেন সেটা তিনি খুবই ভাল বোঝেন। তার দীর্ঘ শাসনামলের বিভিন্ন সময়ে এটা দেখা গেছে।
পশ্চিমা বিশে^র কঠোর নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমি পুতিন তার দেশের তেল-গ্যাস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি পশ্চিমা বিশে^র বিরুদ্ধে পাল্টা অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করতে চাইছেন।


একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ^ অর্থনীতিকে একটা ঝাকুনি দেয়ার ক্ষমতা পুতিনের আছে। কিন্তু তা পশ্চিমাদের সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অবরোধের মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে অবশ্য শেষ কথা বলার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি। তবে পুতিন নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহন করার মাধ্যমে রুশ অর্থনীতিকে অনেকটা চাঙ্গা করে তুলেছেন। এতে দেশের জনগণের মধ্যে পুতিনের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। ডাটা ফার্ম আরআইডব্লিউআই এর জরিপের ফলাফল সেটাই প্রমান করে।