ভারত-যুক্তরাষ্ট্র জোট কার্যকর হবে না যে কারণে


  • মোতালেব জামালী
  • ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৫০

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে রাশিয়া। একাধিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে চারদেশীয় নিরাপত্তা জোট কোয়াডে যুক্ত হয়েছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কেনাসহ নানা ক্ষেত্রে ভারত ওয়াশিংটনের কৌশলগত অংশীদার। কিন্তু এরপরও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জোট টেকসই হবে না।

নয়াদিল্লির যুক্তরাষ্ট্রমুখিতা মস্কোর জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির মূল কারণ হচ্ছে, ভারতের নিকট প্রতিবেশী চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রবল উত্থান। চীনের এই উত্থানে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে ভারত। সে কারণেই দেশটি চীনবিরোধী বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গাটছড়া বেঁধে চীনকে মোকাবিলা করতে চাইছে।

৫০ বছর আগে ভারত হয়তো এককভাবে চীনকে মোকাবিলা করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে। এই দুই ক্ষেত্রে চীন ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। চীনের যে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি, তা এককভাবে মোকাবিলা করার ক্ষমতা ও শক্তি ভারতের নেই। অদূর ভবিষ্যতেও ভারত এই ব্যবধান কমিয়ে দুই দেশের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য তৈরি করতে পারবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বিদেশি মিত্র প্রয়োজন ভারতের। এই কৌশলের মাধ্যমেই ভারত হয়তো চীনের সাথে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে।

রাশিয়ার সাথে ভারতের এক সময় খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বর্তমানে নয়াদিল্লিতে এমন একজন রাজনীতিক নেই, যিনি মস্কোর সাথে আগের সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়া একজোট হওয়ায় ভারত মস্কোর কাছ থেকে আরও দূরে সরে যায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে ভারত ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রতিটি দেশ তার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নির্ধারণ করে থাকে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেকটাই ঢিলে হয়ে গেছে।

বাণিজ্যের পরিমাণ, যৌথ সামরিক মহড়া কিংবা শীর্ষ সম্মেলনের সংখ্যা বিবেচনা করলে দেখা যায়, চীন রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি থেকে ভারতকে ছিটকে ফেলেছে। বর্তমানে চীন ও ভারতের মধ্যে যেকোনো বিরোধে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে রাশিয়া। রাশিয়ার এই অবস্থান ভারতের সাথে যেকোনো বিরোধে চীনের অবস্থানকেই শক্তিশালী করেছে। ফলে চীন ও ভারতের মধ্যে শক্তির যে ভারসাম্যহীনতা, সেটা আরও বেড়ে গেছে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই দুই মেরুতে বিভক্ত। ফলে ভারতের নেতৃত্বের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে রাশিয়া ও চীন আরও কাছাকাছি যেতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফল হিসেবে রাশিয়া-চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে ওঠার কথা।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টোটা। যুক্তরাষ্ট্র তিনটি দেশ ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে চারদেশীয় সামরিক জোট ‘কোয়াড’ গঠন করেছিল। কিন্তু অতিসম্প্রতি সেই জোটকে পাশ কাটিয়ে ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে নতুন সামরিক জোট ‘অকাস’ গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা কোয়াডের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে, যা ভবিষ্যত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেবে। এমনকি দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।

যুক্তরাষ্ট্র কখনও ভারতের সাথে সত্যিকারের একটি ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ার উদ্যোগ নেয়নি, চেষ্টাও করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যেসব জোট গঠন করেছে, সেখানে সদস্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে কাজ করেছে। এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি ভারতের নীতি নির্ধারকরা মেনে নিতে রাজি নন। যুক্তরাষ্ট্রের এই মনোভাব ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমমর্যাদার ভিত্তিতে জোট গড়তে চান।

যুক্তরাষ্ট্র তার পুরনো নীতি পরিবর্তন করে ভারতের সাথে সমমর্যাদার ভিত্তিতে জোট গড়তে মোটেও আগ্রহী নয়। দেশটি বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের ভূমিকা, মর্যাদা ও অবস্থানকে দীর্ঘদিন ধরে উপভোগ করে আসছে। নিজেদের এই অবস্থানের বাইরে ওয়াশিংটন যাবে না। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে নিয়ে গড়ে ওঠা চারদেশীয় সামরিক জোট কোয়াড রেখে ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে নতুন সামরিক জোট অকাস গঠন করেছে। নতুন এই জোটের দুই সদস্য ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া কখনও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে না। সব সময়ই মেনে চলবে।

রাশিয়া ও চীন গত ২০ বছর ধরেই নিজেদের মধ্যে স্বার্থের কোনো সঙ্ঘাত দেখা দিলে দ্রুত সমাধান করে কৌশলগত ঐক্য ধরে রেখেছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে এ ধরনের কোনো সম্পর্ক আজও গড়ে ওঠেনি। ফলে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গাঢ় হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই দেশের মূল্যবোধের ফারাক। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ক্ষেত্রে মিল ছিল। দুইজনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলা নরেন্দ্র মোদির পক্ষে সম্ভব হবে না।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত। ভারতের কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার দেশটির মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে নিবর্তনমূলক নীতি অনুসরণ করছে, তার সমালোচনায় মুখর হয়েছে বাইডেন প্রশাসন। অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতের নীতিও সমর্থন করে না বাইডেন প্রশাসন।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মতের অমিল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর ভারত হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারত তার কার্বণ নিঃসরণের মাত্রা ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য অঙ্কে নামিয়ে আনার অঙ্গিকার করুক। অন্যদিকে ভারতের দাবি হচ্ছে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থে উন্নত দেশগুলোকে তাদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। এই ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ কমার সম্ভাবনা নেই।

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা হচ্ছে পুরনো মিত্রদের কাছ থেকে ভারতের সরে না আসা। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। রাশিয়ার সাথে ভারতের সামরিক-কারিগরি সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে ইরানের কাছ থেকে জ¦ালানি তেল কেনে ভারত।

ইরান ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না। আন্তর্র্জাতিক ভূরাজনীতিতে এই দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ। ইরানের তেল ও গ্যাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ভারতের বেশ কিছু কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মিলিয়ে রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে না ভারত। উল্টো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে এই দুই মিত্র দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনা এর প্রমাণ। একইভাবে ভারত আঞ্চলিক সংগঠন ব্রিকস বা এসসিও-র সাথেও সম্পর্কচ্ছেদ করবে না দিল্লি।

এসব নানা কারণেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র্রের মধ্যে ভবিষ্যতে কখনও ঘনিষ্ঠ কৌশলগত কোনো জোট গড়ে উঠবে না। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভারত সবসময় অবিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে পরিচিতি পাবে। যাকে প্রয়োজনের সময় চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। কিন্তু ভারতের প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকে খুব কমই কাছে পাওয়া যাবে। এর প্রমাণ লাদাখে ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত সংঘর্ষের সময় যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে।