তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র


  • হায়দার সাইফ
  • ২২ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪১

তালেবানের ব্যাপারে মনোভাব বদলাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এতদিন আফগানিস্তানের তহবিল আটকে রেখেছিল তারা। অথচ এখন তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রোডম্যাপ নিয়ে এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি ব্রাসেলসে যখন এই তথ্য প্রকাশ করা হয়, তখন অনেকেই অবাক হয়েছেন। রোডম্যাপের অংশ হিসেবে পাকিস্তান ও মস্কো সফরে বেরিয়েছেন আফগানিস্তানে নিযুক্ত নতুন মার্কিন দূত। পাকিস্তানে ট্রয়কা প্লাসের সাথে বৈঠক হয়েছে তার। ওই বৈঠকে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও যোগ দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

কৌশল পাল্টে ফেলার একটা স্থায়ী অভ্যাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যখন তারা বুঝতে পারে যে কৌশলে কাজ হচ্ছে না। সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তখনই তারা কৌশল পাল্টাবে। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে যে, তালেবানের ওপর জোর খাটিয়ে কাজ হবে না। কারণ, তাদের বিপুল সমর্থন রয়েছে পশতু জাতিয়তাবাদীদের মধ্যে। পানশির স্টাইলে প্রতিরোধের ব্যাপারেও আগ্রহ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। তাই তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়েই ভাবছে ওয়াশিংটন। পেছন ফিরে তাকালে মনে হবে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসলে দোহা শান্তি প্রক্রিয়াটাই পুনরায় শুরু করছেন। অনেকে মনে করেন, সেনা প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তির অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল।

সাবেক মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদের মন্তব্যটাই ধরা যাক। তিনি বলেছেন, দোহা চুক্তিতে কাবুলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের যে বোঝাপড়া হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র আর তালেবান সেখান থেকে সরে গেছে। অবশ্য, শেষ মুহূর্তে আশরাফ ঘানি আর তার সাঙ্গপাঙ্গরাই পরিস্থিতি ঘোলা করে গেছেন।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিশেষ প্রতিনিধি এখন টম ওয়েস্ট। সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, আফগানিস্তানে আইসিস সংশ্লিষ্টদের হামলা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। তাছাড়া আল কায়েদার অবস্থান এখনও সেখানে রয়েছে, যেটা খুবই উদ্বেগজনক।

ব্রাসেলসে ন্যাটো মিত্রদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠকে ওয়েস্টও উপস্থিত ছিলেন। তালেবানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার অগ্রগতি জানান তিনি। আফগান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার রোডম্যাপ নিয়েও আলোচনা করেন তারা।

ওয়েস্ট বলেছেন, তালেবানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ বেশ পরিস্কার আর খোলামেলাভাবেই জানিয়েছে। তারা চায়, আন্তর্জাতিক সহায়তা আবার চালু হোক। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা কাবুলে ফিরে যাক। আফগান সরকারের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এর কোনোটাই একা একা করতে পারবে না।

ব্রাসেলস থেকে পাকিস্তানে যান মার্কিন বিশেষ দূত। সেখান তিনি ট্রয়কা প্লাসের সাথে বৈঠকে অংশ নেন। ট্রয়কা প্লাসের দেশগুলো হলো রাশিয়া, চীন, আর পাকিস্তান। পাকিস্তা থেকে ওয়েস্টের যাত্রা ছিলো দিল্লি । সেখানে ওয়াশিংটনের কোয়াড মিত্রকে নতুন চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবগত করবেন তিনি। তালেবানের ব্যাপারে কি ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র, সেই বার্তা পৌঁছানো হবে ভারতকে। দিল্লি থেকে মস্কো যান ওয়েস্ট। বার্তা সংস্থা তাস রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সূত্রে এ তথ্য জানিয়েছে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ জানিয়েছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দূত জামির কাবুলভের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন ওয়েস্ট। সেখানে তিনি বলেছেন, তিনি মস্কো আসতে চান এবং রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। সেই অনুযায়ী মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে ওয়েস্টের।

পাকিস্তানী মিডিয়া এই ইস্যুতে যথারীতি সরব রয়েছে। ওয়েস্ট আসার আগেই পাকিস্তানি মিডিয়া জানিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করতে যাচ্ছে ইসলামাবাদ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, আর চীনের বিশেষ দূতরাও সেখানে থাকবেন। গণমাধ্যম বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, তার ভিত্তি প্রস্তুত করাই ছিলো এই বৈঠকের লক্ষ্য।

আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমীর খান মুত্তাকি যথারীতি ইসলামাবাদ সফর করেছেন। সাথে ছিল উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। এটা ছিল তার প্রথম আনুষ্ঠানিক পাকিস্তান সফর।

ইসলামাবাদের বৈঠকটা ছিল ট্রয়কা প্লাস ফরমেটের। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলো রাশিয়া, চীন, আর পাকিস্তান। এই বৈঠকে মুত্তাকির অংশগ্রহণ ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তবতা হলো ট্রয়কা প্লাস আসলে তালেবান কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করছে।

তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর দেশের বাইরে তাদের তহবিল জব্দ করা হয়। আমেরিকান ব্যাংকগুলোতে যে তহবিল রয়েছে, সেগুলো এখন ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই তহবিলের পরিমাণ প্রায় ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিষয়ে যথেষ্ট আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে। মস্কো ফরমেটে সম্প্রতি যে আঞ্চলিক বৈঠক হয়েছে, সেখানেও এই দাবি জানানো হয়েছে।

বাইডেন প্রশাসন এই ধারণা দিতে চাচ্ছে যে, তারা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তালেবান সরকার যাতে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে পারে, সে ব্যাপারেও সাহায্য করতে চায় তারা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু তারা করবে।

সন্দেহ নেই , বাইডেন প্রশাসনের এই কৌশল সঠিক। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট। আর তাই, এই কৌশল নিয়েও বিতর্ক উঠতে পারে। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের যে এ ব্যাপারে সম্মতি আছে, সেটা এরই মধ্যে বোঝা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে বেইজিং কিছুটা অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

চীনা সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে তেমনটাই মনে হয়েছে। ইসলামাবাদে যে ট্রয়কা প্লাসের বৈঠকে পরিস্থিতির নাটকীয় বাঁক বদল হতে যাচ্ছে, সেটা নাকি তারা জানতোই না।

গ্লোবাল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মুত্তাকির সফরের পেছনে হয়তো বিনিময়ের কোনো ইস্যু রয়েছে। পারস্পরিক উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে হয়তো আলোচনা হবে। পাকিস্তান সরকার আর পাকিস্তানি তালেবানের মধ্যে আলোচনায় আফগান তালেবান যে মধ্যস্থতা করছে, সেটাও হয়তো থাকবে ইস্যুর তালিকায়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সম্প্রতি তালেবান সরকারের সাথে পাকিস্তানের বেশ ঘন ঘন বিনিময় হচ্ছে। তবে তালেবানকে বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি এখনও বহু দূরে রয়ে গেছে। তালেবানের সামনে অনেকগুলো ইস্যু রয়েছে এখন। তাদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া সীমান্ত ও বাণিজ্য রুটের ইস্যুগুলোও তাদের সামনে রয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে একটা অনুমানও করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ রকম হতে পারে যে, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, আর অন্যান্য আঞ্চলিক দেশগুলো প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে সংলাপে বসবে। এরপর সবগুলো দেশ হয়তো এক সাথে বা আলাদা আলাদাভাব তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে।

বাইডেন প্রশাসন তালেবান আর ইসলামাবাদের সাথে সরাসরি কথা বলে আসছে। তবে এই আলোচনা থেকে বেইজিংকে দূরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, বেইজিংও ওয়াশিংটনকে সহায়তা করতে চাচ্ছে না। কাবুলে কিংমেকারের ভূমিকায় থাকতে চায় বেইজিং। ওয়াশিংটন নিরবে সেখানে প্রবেশ করার কারণে তারা একটা বাধার মুখে পড়েছে। গ্রেট গেমের মাত্রা বদল হতে শুরু করেছে।

এই সব ঘটনা প্রবাহ আঞ্চলিক সমীকরণকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। সামনের দিনগুলোর জন্য নতুন রোডম্যাপ নিয়ে এগুচ্ছে ওয়াশিংটন। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের জায়গায় আবার উঠে আসছে পাকিস্তান। সেখানে শর্ত হলো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হলে পাকিস্তানের সহায়তা তাদের লাগবেই।

পাকিস্তানের যুক্তির মুখে দোলাচলে আছে বাইডেন প্রশাসন। পাকিস্তান বলেছে, তালেবান সরকারের সাথে আলোচনা বারবার পিছিয়ে দেওয়া হলে বিপদ হতে পারে। আবার ঊনিশশ নব্বই দশকের মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা না হলে জটিলতা বাড়বে। আইসিসের শক্তি সেখানে বেড়ে যেতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে হচ্ছে কিছু বিষয়ে ব্রিটেনের মনোভাব সমর্থন করে। সেটা হলো- প্রগতিশীল ইস্যুগুলোতে তারা তালেবানকে সমর্থন দেবে।

ব্রিটেনের হাউজ অব কমনস ডিফেন্স কমিটিতে সম্প্রতি তালেবানকে নিয়ে কথা বলেছেন চিফ অব ব্রিটিশ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল নিক কার্টার। তিনি বলেছেন, এবারের তালেবানরা আলাদা। তালেবানের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা আরও আধুনিকতার সাথে শাসনকাজ চালাতে চান। তবে তাদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির সেটা থাকতেই পারে।

তিনি বলেন, তালেবানের মধ্যে যারা উদারপন্থী, তাদের নিয়ন্ত্রণ যদি বাড়ে, তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আফগানিস্তান আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, আফগান ইস্যুতে কার্টারের ভূমিকা ছিল সীমিত। কিন্তু সেখানে জয়-পরাজয় নিয়ে মন্তব্য করেছেন তিনি। আফগান যুদ্ধে কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে- এই ধারণা তিনি নাকচ করে দেন। তিনি বলেছেন, কেউ হেরে গেছে- বলার সময় এখনও আসেনি। সবকিছুর ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে, সেটা দিয়ে বিজয় মাপতে হবে। সামরিক শক্তির মাপকাঠিতে সেটা করা যাবে না।

তবে কিছু কৃতিত্ব এখানে বাইডেনকে দেওয়া যেতে পারে। আগে যা ঘটেছে, সেটা চলে গেছে। এখন আগামী দিনের মার্কিন স্বার্থের কথা মাথায় রেখে নতুন পাতা উল্টাতে চাচ্ছেন তিনি। আফগানিস্তানে অন্তত সেটা যাতে সুদিন আনতে সাহায্য করে, সেটাই এখন কাম্য।