চীনের সঙ্গে অনন্ত সংঘাতে ভারত?


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২১ নভেম্বর ২০২১, ১৯:১০

একসময় পাকিস্তানকে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করত ভারত। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরাই বলছেন, চীন এখন তাদের বড় শত্রু। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের সঙ্গে ভারত দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এটা ভারতের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে, ব্যাহত হবে দেশটির অবনতিশীল মানব উন্নয়ন পরিস্থিতির।

ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত সম্প্রতি খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেছেন, তার দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর সীমান্ত বিরোধ নিরসনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে আস্থার অভাব ও ক্রমবর্ধমান সন্দেহ।

জেনারেল বিপিনের এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূূর্ণ। তিনি ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রধান। বিজেপি সরকারেরও অত্যন্ত আস্থাভাজন তিনি। সুতরাং তার বক্তব্য নরেন্দ্র মোদি সরকারের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।

দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ উপরে উঠছে। ২০২০ সালে হিমালয় অঞ্চলে দুই দেশের সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হন। তখন থেকেই হিমালয় সীমান্তে সামরিক সরঞ্জাম, অবকাঠামো নির্মাণ ও সেনা মোতায়েন করে দুই দেশ। এরপর সংকট নিরসনে বেইজিং ও নয়াদিল্লির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৩ দফায় বৈঠক হলেও কোনো সমাধান মেলেনি।

জেনারেল বিপিন রাওয়াত বলেছেন, একদিকে কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তানের মদদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, অন্যদিকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চীনা সেনাবাহিনীর আগ্রাসী আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে ভারত।

নয়াদিল্লি এরই মধ্যে চীন সীমান্ত সুরক্ষায় কয়েক হাজার সেনা ও সমরাস্ত্র মোতায়েন করেছে। এ সেনাদের খুব শিগগিরই ঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলেও জানান বিপিন রাওয়াত। তিনি বলেন, চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর তাদের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য গ্রাম নির্মাণ করছে। পাশাপাশি সেনাদের জন্যও নির্মাণ করছে ভারী অবকাঠামো।

ভারতের এই প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারক বলেন, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করায় ভারত নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন। তালেবান সরকারের সহায়তায় জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা বাড়ার আশঙ্কাও করেন তিনি।

বিপিন রাওয়াত যখন এ মন্তব্য করেন তার আগেই জানা যায় , ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একটি জেলায় চীন গড়ে তুলেছে পুরোদস্তুর একটি গ্রাম। অথচ ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিল আসাম রাইফেলসের শিবির। দুই দেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার ভেতরে ওই গ্রাম তৈরি করে চীন।

সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের একটি প্রতিবেদনে ভারতীয় ভূখন্ডে চীনা বাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং গ্রাম নির্মাণের তথ্য জানানো হয়েছে। প্রকাশ করা হয়েছে ওই গ্রামের উপগ্রহচিত্র।

আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের গত বছরের বার্ষিক রিপোর্টে ওই ঘটনার কথা জানিয়ে বলা হয়েছিল, তাসরি চু নদীর তীরে বানানো ওই হ্রামে প্রায় ১০১টি ঘর তৈরি করেছে চীনা সেনা। তাদের বক্তব্যের সমর্থনে একটি উপগ্রহ চিত্রও প্রকাশ করা হয়। ছবিটি ২০২০ সালের ১ নভেম্বর তোলা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

রিপোর্ট বলা হয়, ষাটের দশকের গোড়তেই আসাম রাইফেলসকে হটিয়ে তাসরি চু নদীর তীরের ওই এলাকা দখল করেছিল চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ। পরে তারা সরে যায় । কিন্তু পরবর্তী পাঁচ দশকে ধীরে ধীরে ওই অঞ্চল চীনা সৈন্যরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে চীন।

গত বছর নভেম্বরে অরুণাচলের এক বিজেপির পার্লামেন্ট সদস্য অভিযোগ করেছিলেন, আপার সুবনসিরি জেলায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে স্থায়ী অবকাঠামো বানাচ্ছে চীন। অরুণাচল নিয়ে চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালে মাসব্যাপী যুদ্ধে ভারত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। অনেকে মনে করেন ভবিষ্যতে দুই দেশের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে অরণাচল।

গত অক্টোবরের দুটি ঘটনা ভারতের চরম দুশ্চিন্তায় ফেলেছে । প্রথমটি হলো ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য চীনের সমঝোতা চুক্তি সই। এই চুক্তি সইয়ের ১৫ দিন না যেতে চীনা সংসদে পাস হয়েছে স্থলসীমান্ত আইন। এই আইন সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা সেনাবাহিনীকে প্রবল ক্ষমতাধর করে তুলবে।

নতুন আইনের বলে নতুন ইংরেজি বছরের প্রথম দিন থেকে চীনের সীমান্তের যাবতীয় নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পিপলস লিবারেশন আর্মি ও পিপলস আর্মড পুলিশ ফোর্সকে। এছাড়াও সীমান্তে বিমানঘাটি ও রেল লাইনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের অনুমিত দেওয়া হয়েছে। এ আইন বলে সীমান্তে গ্রাম গড়ে তুলবে এবং সেই গ্রামবাসীদের প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ দেবে চীন।

তিব্বতে ইতিমধ্যেই এ ধরনের ৬০০ গ্রাম তৈরি করেছে চীন। বেইজিং ভুটানেও এ ধরনের গ্রাম তৈরি করেছে বলে স্যাটেলাইট চিত্রে উঠে এসেছে। গত এক বছরেই ভুটানে চারটি গ্রাম গড়ে তুলেছে চীন। যদিও ভুটানের সীমান্ত রক্ষার কথা ভারতের।

ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত তিন হাজার ৪৬৮ কিলোমিটারের। ভুটানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত ৪০০ কিলোমিটার। ভুটানের সঙ্গে নতুন আইন চালু হওয়ার আগেই উত্তর লাদাখে এবং অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তে চীনা সেনা মোতায়েন ভারতের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন কিছুদিন পরপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন দাবি জানিয়ে আসছে। অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় নেতাদের আসা- যাওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়েছে দেশটি।

চীনের সীমান্ত আইন দেশটির সেনাবাহিনীকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অবমাননায় উৎসাহিত করবে বলে আশঙ্কা ভারতের। এটা আগামীতে দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

এসব কারণে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বেশিরভাগ এখন চীনকে লক্ষ্য করে। ফ্রান্স থেকে কেনা অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমানের বেশিরভাগ পূর্ব ভারতে মোতায়েন করা হয়েছে। অরুণাচল সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি চিনুক যুদ্ধ হেলিকপ্টার, কামান, এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা এবং সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। জোরদার করা হয়েছে নজরদারি ব্যবস্থা।

ভারতের ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের গবেষক ও চীন বিশেষজ্ঞ জগন্নাথ পান্ডা মনে করেন, ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিপদ পাকিস্তানের দিক থেকে যতটা, তার চেয়েও অনেক বেশি চীনের দিক থেকে। চীনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও মনে করেন, ভারত ও চীনের চলমান সীমান্ত বিরোধ শীঘ্রই সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণে দুই দেশের সীমান্ত এখনো পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি।

চীনের সঙ্গে এই রণপ্রস্তুতি ভারতের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঢেকে আনবে। করোনাভাইরাস মহামারিতে এমনিতেই ভারতের অর্থনীতি ধুঁকছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতি ৭ দশমিক ৭শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাক্স বলছে, সংকোচনের এই হার হবে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ২৪ শতাংশ, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এটা দেশটিকে মন্দার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

ভারতের ক্রমসংকুচিত অর্থনীতি দেশটির বৈশি^ক উচ্চাভিলাসে বড় ধরনের বাধা। ভারত ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী হওয়ার বাসনা ত্যাগ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে অবনতিশীল অর্থনীতি বড় সমস্যা তৈরি করছে দেশটির দারিদ্র দূরীকরণ ও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে।

মানব উন্নয়নের সূচকে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এমনকি ক্ষুধা সূচকে ভারত পাকিস্তান ও মিয়ানমারের চেয়েও পিছিয়ে। মানে ভারতে অনাহার পরিস্থিতি এই দুই দেশের চেয়ে খারাপ। ভারত চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে দেশটির জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশই সামরিক খাতে ব্যয় করতে হবে। এতে ভারতের অবস্থা আরও খারাপ হবে। চীনের অর্থনীতির আকার ভারতের প্রায় ৫ গুন।

সম্প্রতি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসি অ্যান্ড কোম্পানির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে সবচেয়ে ধনী দেশ এখন চীন। সম্পদের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলেছে দেশটি। ২০২০ সালে চীনের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২০ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯০ ট্রিলিয়ন ডলার। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, করোনা সংকটে ভারত অর্থনৈতিকভাবে ৫ বছর পিছিয়ে গেছে। অন্যদিকে চীন পাঁচ বছর এগিয়ে গেছে।