তুরস্ক ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বের পরিণতি কী?


  • মোতালেব জামালী
  • ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৩

তুরস্কের সঙ্গে নানা ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। দেশটির বিতর্কিত একজন ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী ওসমান কাভালার মুক্তির দাবি জানিয়ে তুরস্কে ১০টি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতের ১৮ অক্টোবর দেওয়া বিবৃতি নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই রাষ্ট্রদূতদের তুরস্ক থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। এতে বেকায়দায় পড়ে পশ্চিমা দেশগুলো। ফলে নতুন করে দেওয়া বিবৃতিতে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেন তারা। এসব দেশ তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। এতে দুইপক্ষের মধ্যে বিরোধের আপাতত অবসান হলো বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্কসহ ১০টি দেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে ২৫ অক্টোবর দেওয়া বিবৃিততে বলা হয়েছে, তারা ভিয়েনা সনদের ৪১ নম্বর ধারা মেনে চলবে। ৪১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাদের এই বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ফলে এই রাষ্ট্রদূতদের আর বহিষ্কার করা হবে না। এর মাধ্যমে তুরস্ক ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বড় ধরনের কূটনৈতিক সংকট তৈরির আশঙ্কা দূর হলো।

কিন্তু পশ্চিমারা তাদের এই অপমানের কথা সহজে ভুলে যাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না। তারা তুরস্কের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইবে। সেটা সামরিকভাবে সম্ভব না হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তুরস্ককে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মনে করছেন।

তুরস্কের বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী ওসমান কাভালার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবিতে গত ১৮ অক্টোবর বিবৃতি দেন দেশটিতে নিযুক্ত ১০টি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত।

এই ১০ দেশের মধ্যে আছে- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তাদের বিবৃতিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দেয় এবং অসন্তোষ প্রকাশ করে। এরপরই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই রাষ্ট্রদূতদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও তাদের কূটনৈতিক মর্যাদা বাতিল করে তাদেরকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।

দশ রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওসমান কাভালার বিচার প্রক্রিয়া ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ বিলম্বিত করা হচ্ছে। এর ফলে তুরস্কের বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিবৃতিতে তুরস্ক সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তারা যেন কাউন্সিল অব ইউরোপের রায় মেনে নেয়। তুরস্ক এই মানবাধিকার সংগঠনে ১৯৫০ সালে যোগ দিয়েছিল।

ইউরোপের প্রধান মানবাধিকার নজরদারি সংস্থা কাউন্সিল অব ইউরোপ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, আগামী ৩০ নভেম্বর তাদের পরবর্তী বৈঠকের আগে কাভালাকে মুক্তি দেওয়া না হলে তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তুলবে এবং ব্যবস্থা নেবে। এর প্রতিক্রিয়ায় গত ২৪ অক্টোবর তুরস্কের কেন্দ্রীয় এস্কিশেহির প্রদেশে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে এরদোয়ান বলেন, আমি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছি এবং কী করতে হবে তা বলে দিয়েছি।

অনুষ্ঠানে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশে এরদোয়ান বলেন, তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে আমাদের ওপর নির্দেশ জারির সাহস আপনারা দেখাতে পারেন না। তাদেরকে তুরস্ককে জানতে ও বুঝতে হবে। এটি তেমন কোনো উপজাতীয় রাষ্ট্র নয়, এটা তুরস্ক। যেদিন থেকে তারা তুরস্ককে জানবে না, সেদিনই তাদের চলে যাওয়া উচিত। উল্লেখ্য, এর আগেও তুরস্কের বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে এসব দেশের রাষ্ট্রদূতদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সতর্ক করা হয়েছিল।

পশ্চিমা মিডিয়া, রাষ্ট্রদূত, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকরা উসমান কাভালাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন ‘সমাজকর্মী’ ও ‘জনহিতৈষী ব্যক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু তার আসল পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা শেষে বাবার ব্যবসার হাল ধরেন কট্টর বামপন্থী হিসেবে পরিচিত কাভালা।

পরবর্তীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। তার এনজিগুলোকে অর্থ সহায়তা দিত পশ্চিমা অনেক বড় বড় সংস্থা। যাদের মধ্যে জর্জ সরোসের ওপেন সোসাইটি অন্যতম। মূলত সংখ্যালঘু যেমন কুর্দি বামপন্থী সংগঠন, আর্মেনীয় খ্রিস্টান গ্রুপ, সমকামী অধিকার প্রতিষ্ঠা গ্রুপসহ আরও অনেক গোষ্ঠী কাভালার এনজিও থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা পেত।

তুরস্ক সরকারের দাবি হচ্ছে, কাভালা ও তার এনজিওগুলো ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে এবং ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। এরদোয়ানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পশ্চিমাদের সহযোগিতায় এবং মদদে এ কাজ করেছেন কাভালা ও তার এনজিও। ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টাকালে কাভালা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র একজন গুপ্তচরের সঙ্গে বৈঠক করেন বলেও দাবি করছে এরদোয়ানের সরকার।

এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাভালার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৭ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি এরইমধ্যে দুটি মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন। কিন্তু এখনও কিছু মামলা আদালতে চলমান রয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, বাকি মামলাগুলো থেকেও আগামী ২৪ নভেম্বর কাভালার অব্যাহতি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

পশ্চিমা ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূতের বিবৃতি তার বিচার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের এই বিবৃতিকে তুরস্ক সরকার তাদের স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে। এ কারণে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেন এরদোয়ান। ১০ দেশের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ছিল তুরস্কের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর আগে কখনও এতোগুলো বিদেশি কূটনীতিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি তুরস্ক। যদিও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যেহেতু কাভালার বিচার প্রক্রিয়া চলছে, সে কারণে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা বা বিবৃতি দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কাজেই, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও নিউজিল্যান্ডের একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে এসব দেশ যেখানে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়ে অন্ধ হয়ে আছে, সেই অবস্থায় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোই উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ান্তানামো বে কারাগারের কথা এখানে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। এটি এখনও একটি উন্মুক্ত বিষয়। কিউবার একটি অংশ দখল করে যুক্তরাষ্ট্রের বানানো এই কারাগারে এখনও এমন অনেক বন্দি রয়েছেন, যাদেরকে ২০ বছর আগে আটক করে এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিচার প্রক্রিয়াই এখনও শুরু হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকরা এসব বন্দির মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সব সময়ই অস্বীকার করে আসছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কথাও এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের আকাশপথ ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজনকে অপহরণ করে এনে বিনাবিচারে বছরের পর বছর ধরে কারাগারে রাখছে। তাদের ওপর চরম নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু ইউরোপের সরকারগুলো এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখছে। তারা টু শব্দটিও করছে না।

তুরস্ক এখন আর আগের সেই তুরস্ক নেই। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাাইয়েপ এরদোয়ানের আমলে অনেক বদলে গেছে দেশটি। সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুর্কি প্রেসিডেন্টের সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল খুব দ্রুত ও কার্যকর। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে যখন সামরিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার তুর্কি জাতিগত মিত্র আজারবাইজানের সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেও সামরিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তুরস্কের। এর বাইরে উত্তর ইরাকে কুর্দি গেরিলা গোষ্ঠি পিকেকে-র বিরুদ্ধে ব্যাপক সেনা অভিযান চালিয়েছেন এরদোয়ান। এছাড়াও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি ইদলিব প্রদেশে তুর্কি সামরিক শক্তি বাড়িয়েছেন তিনি। কাতার, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। বলকান অঞ্চলে তুরস্কের সৈন্যরা শান্তিরক্ষীর দায়িত্ব পালন করছেন। উসমানিয়া খেলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের শাসনামলেই প্রথমবারের মতো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তুরস্কের জোরালো সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যেমন বিশ্বস্ত বন্ধু তৈরি হয়েছে, তেমনি শত্রুরও অভাব নেই। শত্রুরা সব সময়ই এরদোয়ানকে বিপদে ফেলতে তৎপর রয়েছে। যে ১০ দেশের রাষ্ট্রদূত বিবৃতি দিয়েছেন, তার মধ্যে সাতটি দেশই ন্যাটোর সদস্য। এই ১০ রাষ্ট্রদূত সংঘবদ্ধভাবে তুরস্কের ওপর পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। সামরিক শক্তির পরিবর্তে তাদের এই ‘সফট পাওয়ার’ চর্চার উদ্দেশ্য তুরস্ককে চাপের মুখে রাখা। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দ্রুত পাল্টাব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন। কিন্তু তা কতদিন সামাল দিয়ে চলতে পারবেন, সে প্রশ্নও উঠছে। তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এই সুযোগ নিয়ে তুরস্কের অর্থনীতিতে আঘাত করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বেকয়দায় ফেলার চেষ্টা করবে। এরদোয়ান তা সামাল দিতে কতটুকু সক্ষম হবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।