কারা থামাতে চায় আল জাজিরাকে?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১১ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৪৮

নভেম্বরের এক তারিখে ২৫ বছর পূর্ণ করেছে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংবাদমাধ্যমটি বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর একতরফা সাংবাদিকতার বিকল্প হয়ে উঠেছে আল জাজিরা। তবে এসব করতে গিয়ে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। অফিসে বিমান হামলা হয়েছে, অনেক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গ্রেফতার, নির্যাতনের ঘটনাও কম নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবেও আল জাজিরা বন্ধের চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও সব প্রতিকূলতা সামলেই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে চলেছে।

কাতারের রাজধানী দোহায় ১৯৯৬ সালে আরবি ভাষার স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে আল জাজিরার যাত্রা শুরু হয়। আরব বিশ্বের প্রথম স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদ ও সরাসরি বিতর্ক অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয় চ্যানেলটি। এরপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক, যার অধীনে বর্তমানে রয়েছে বিভিন্ন ভাষার বেশ কয়েকটি চ্যানেল, সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।

কাতার সরকারের অর্থায়নে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করা আল জাজিরা তার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রুত সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুত আন্তর্জাতিক কাভারেজে নেতৃত্ব দিয়েছে আল জাজিরা। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ, ২০১১ সালের আরব বসন্তসহ অনেক ইভেন্টে প্রশংসা কুড়িয়েছে আল জাজিরার সাহসী সাংবাদিকত। ইসরাইল ফিলিস্তিন সংকট, আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও সরাসরি সংবাদ সরবরাহ করেছে চ্যানেলটির সংবাদকর্মীরা।

ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কিন বাহিনীর সরবরাহ করা সংবাদই যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার করা হতো, তখন আল জাজিরা সেই পকেট সাংবাদিকতার বাইরে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্র তুলে ধরেছে বিশ্ববাসীর কাছে।

এসব করতে গিয়ে আল জাজিরাকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের সরকারই প্রতিষ্ঠানটিকে শত্রু হিসেবে দেখে। অভিযোগ আছে, ২০০৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সাথে এক বৈঠকে আল জাজিরার হেড অফিসে বোমা হামলার প্রস্তাব তুলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ।

গণমাধ্যমের সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নলিস্টের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর শেরিফ মনসুর বলেন, এই চ্যানেলটি সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়েছে আরব শাসকদের দ্বারা। তারা আল জাজিরাকে বন্ধ করতে অনেক চেষ্টা করেছেন। আরব বসন্তের পর থেকে মিসর, সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ আল জাজিরার বিরুদ্ধে বিরোধীপক্ষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার অভিযোগ তোলে। এছাড়া সন্ত্রাসবাদে সমর্থন, গুজব ছড়ানো ও অবমাননাকর সংবাদ প্রকাশেরও অভিযোগ তোলে তারা। আল জাজিরার বিরুদ্ধে তারা তাদের নিজস্ব চ্যানেল ও সাংবাদিকদেরও ব্যবহার করতে শুরু করে।

পথচলার এই দীর্ঘ ২৫ বছরে আল জাজিরাকে অনেক চাপ ও আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অনেক অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, পুলিশি তল্লাশি, গুলি ও বোমা হামলা হয়েছে। সাইবার হামলাও হয়েছে আল জাজিরার নেটওয়ার্কে একাধিকবার।

অতি সম্প্রতিও তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে আল জাজিরার ব্যুরো অফিসে ঢুকে একদল পুলিশ সব কর্মীদের বের করে দেয়। গত জুলাইয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ সরকারকে বরখাস্ত করার পর এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ সব কর্মীদের মোবাইল ফোন বন্ধ করে বের হয়ে যেতে বাধ্য করে, যাতে কেউ ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণ করতে না পারে। এমনকি তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও সঙ্গে নিতে দেয়া হয়নি। ২০২০ সালে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশের পর মালয়েশিয়ার পুলিশ আল জাজিরা অফিস রেইড দেয়। তারা অফিসের দুটি কম্পিউটারসহ কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে যায়। এছাড়া সুদান ও ইয়েমেনেও আলজাজিরার অফিস বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।

২০১৭ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে চারটি আরব দেশ কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করার পর আল জাজিরা চ্যানেল বন্ধ করার দাবি তুলেছিল। এই চ্যানেলটির মাধ্যমে কাতার সন্ত্রাসবাদে সহযোগিতা করে বলে অভিযোগ ছিলো তাদের। ওই দেশগুলো কাতারের সাথে সমঝোতার শর্ত হিসেবে যে ১৩টি দাবি করেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিলো আল জাজিরার চ্যানেল বন্ধ করা। যদিও কাতার সরকার সেই অন্যায় দাবির কাছে মাথা নত করেনি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে আল জাজিরার ১১ জন কর্মীকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। ২০০৩ সালের এপ্রিলে ইরাকের রাজধানী বাগাদাদে আল জাজিরার অফিসে বোমা ফেলেছিল মার্কিন যুদ্ধবিমান। ওই হামলায় আহত হয়ে কয়েকদিন পর মৃত্যুবরণ করেন বাগদাদ প্রতিনিধি তারিক আইয়ুব। ২০০৪ সালে ইরাকের কারবালায় মার্কিন বাহিনীর সাথে জইশ আল মাহদি গ্রুপের যোদ্ধাদের লড়াই কাভার করতে গিয়ে নিহত হন রাশিদ ওয়ালি নামের আল জাজিরার এক সাংবাদিক।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বেনগাজিতে ২০১১ সালে দায়িত্ব পালন করে ফেরার সময় সশস্ত্র যোদ্ধাদের অ্যামবুশে নিহত হন আলী হাসান নামের এক ক্যামেরাপার্সন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সিরিয়ার দেরা এলাকায় রিপোর্টিং করার সময় স্নাইপারের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে মোহাম্মাদ আল মাসলমাকে। ইদলিবে যুদ্ধের নিউজ কাভার করে অফিসে ফেরার সময় হত্যা করা হয়েছে আব্বাস নামের আরেক সাংবাদিককে। ২০১৬ সালে সিরিয়ার রুশ যুদ্ধবিমানের হামলায় নিহত হয়েছেন আল জাজিরার আরেক সাংবাদিক ইব্রাহিম আল ওমর। এমনিভাবে এখন পর্যন্ত ১১ জন নিবেদিত প্রাণ সংবাদকর্মীকে হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

নিহত এসব সাংবাদিকের সম্মানে দোহায় আল জাজিরা হেডকোয়ার্টার্সের চত্বরে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। লোহার একটি গাছ, যার প্রতিটি পাতায় লেখা রয়েছে একেক জন সংবাদকর্মীর নাম ও মৃত্যুর তারিখ। আল জাজিরা অফিসে ঢুকলেই সবার আগে চোখ পড়ে এই ভাস্কর্যটিতে, যা স্মরণ করিয়ে দেয় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য আল জাজিরাকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে।

এছাড়া আল জাজিরার বহু সাংবাদিক বিভিন্ন হামলায় আহত হয়েছেন। অনেকেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, হুমকি দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার ও জেলখাটার ঘটনাও কম নয় প্রতিষ্ঠানটির সাংবাদিকদের জন্য। পাকিস্তান থেকে গ্রেফতার হওয়া সামি আল-হাজ নামের এক ক্যামেরাপারসনকে ছয় বছর বন্দী করা রাখা হয়েছিল কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে কারাগারে। অথচ সুদানি নাগরিক এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই আনা যায়নি।

মিসরের সাংবাদিক মোহাম্মাদ হুসাইনকে কোন বিচার ছাড়াই চার বছর কারাগারে রেখেছে দেশটির জান্তা সরকার। গ্রেফতারের সময় মিথ্যা সংবাদ প্রচারের অভিযোগ তোলা হলেও তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। ২০১৬ সালে গ্রেফতারের পর সপ্তাহে একদিন পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে দিলেও তাকে কোন আইনি সহযোগিতা গ্রহণ করতেও দেয়নি স্বৈরশাসক গোষ্ঠি। এছাড়া গত কয়েক বছরে আল জাজিরার আরো কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছে মিসরের সরকার।

আল জাজিরার ওপর হামলা-নির্যাতনের এখানেই শেষ নয়। ২০২১ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিেিনর গাজা উপত্যকায় আল জাজিরা অফিস ভবনটি মিসাইল হামলায় গুড়িয়ে দেয় ইসরাইলি যুদ্ধবিমান। একই ভবনে আরো ছিলো মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির অফিস। হামলার এক ঘণ্টা আগে ইসরাইলি বাহিনী ভবনটির মালিককে নির্দেশ দেয় লোকদের সরিয়ে নিতে। এরপর হামলা করে ভবনটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়।

গাজায় ১১ দিন ধরে চলা হামাসের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধ নিয়ে আলোচিত কিছু সংবাদ প্রচার করেছিল আল জাজিরা। প্রতিষ্ঠানটির গাজা ব্যুরো চিফ ওয়ায়েল আল দাহদুহ বলেন, আমরা তখন খুব কাছের একটি জায়গা থেকে যুদ্ধের লাইভ সম্প্রচারে ছিলাম, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজেরাই খবরের আইটেম হয়ে গেলাম। সারা বিশ্ব দেখেছে কিভাবে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ হয়েছে প্রকাশ্যে।

আল জাজিরার সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়েই ইসরাইল প্রতিষ্ঠানটিকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। এমন হামলা সেটাই প্রথম নয়। ২০০২ সালে আফগানিস্তানের কাবুলে আল জাজিরার অফিসে মিসাইল হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। সৌভাগ্যবশত কোন সংবাদকর্মী সে সময় অফিসে ছিলো না। মার্কিন বাহিনী পরে বলেছে, তারা জানতো না সেখানে গণমাধ্যমের অফিস আছে। সন্ত্রাসী আস্তানা সন্দেহ করে মিসাইল হামলা চালানো হয়েছিল বলে দাবি করে তারা।

প্রতিষ্ঠানের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এসব ঘটনার কথা স্মরণ করে আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কের মহাপরিচালক মোস্তফা সুয়াং বলেন, আজকের দিনে পানি আর অক্সিজেনের মতোই মানুষের কাছে তথ্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই সাংবাদিকতা কোন অপরাধ নয়। পরিস্থিতি যেমনই হোক, আল জাজিরা অবাধ ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রচারের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।