তালেবানের পুনরুত্থান: পাকিস্তান কি বিপাকে পড়তে যাচ্ছে?

-

  • মোতালেব জামালী
  • ৩০ অক্টোবর ২০২১, ১৭:২৫

আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই ভালো। প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে ১৬০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। তারা পরস্পরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারও। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই একবার দুই দেশকে ‘অবিচ্ছেদ্য ভাই’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তালেবানের এই পুনরুত্থান পাকিস্তানের জন্য কতটুকু ভালো আর কতটুকু মন্দ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সেই হিসাব-নিকাশও করতে শুরু করেছেন দেশটির অনেক বিশ্লেষক।

কাবুলের পতন ও তালেবানের ক্ষমতা দখল পাকিস্তানের রাজনৈতিক এলিট শ্রেণিকে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়েছিল। কারণ, পাকিস্তানের বেসামরিক-সামরিক নেতৃত্ব তালেবানকে ইসলামাবাদের কৌশলগত সম্পদ ও এই অঞ্চলে তাদের দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা স্বার্থের অভিভাবক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আফগানিস্তানে তালেবানের উপস্থিতি পাকিস্তানকে আঞ্চলিক একটি শক্তি হিসবে ভূমিকা পালনের পথকে প্রশস্ত করে দেয়।

পাকিস্তান আশা করে, আফগানিস্তানে তালেবানের সরকার থাকলে তারা পাকিস্তানের উগ্রপন্থী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি ও পশতুন জাতীয়তাবাদীদেরকে প্রতিহত করতে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করবে। একইসঙ্গে তালেবান সরকার ডুরান্ড লাইনকে দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে মেনে নেবে। এছাড়াও আফগানিস্তানে ভারতের উপস্থিতির অবসান ঘটিয়ে সেখানে পাকিস্তানের কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সেভাবে পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য অনুকূলে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর জেমস রিশসহ ২১ জন সিনেটর ২৯ সেপ্টেম্বর তালেবান ও তাদের সমর্থক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করেছেন। এই বিলে তালেবানের ভূমিকা এবং তাদেরকে পাকিস্তানের সমর্থন, আর্থিক ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কৌশলগত দিক নির্দেশনা প্রদানের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

পাকিস্তান এরইমধ্যে চরম আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করছে। দেশটির জিডিপির প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। মার্কিন কংগ্রেসে উত্থপিত বিলটি যদি পাশ হয়ে যায়, তাহলে তা পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য খারাপ খবরই বয়ে আনবে। অন্যদিকে বিশে^ পাকিস্তানের ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পাকিস্তানের গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব পিস স্টাডিজের মনিটরিং রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি তালেবান এ পর্যন্ত সারা দেশে ৫৫টি ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে এবং টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর বাইরেও মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের নেতৃত্বে টিটিপি পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যেও তার সশস্ত্র তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিবেদনেও একথা বলা হয়েছে যে, টিটিপি পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের শক্তি ও প্রভাব বাড়ানোর জন্য আল কায়েদা ও আইএসকে-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরায় ক্ষমতায় আসার ফলে পাকিস্তানের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক যে বিরূপ প্রভাব পড়বে সেটি হচ্ছে, দেশটির সীমান্ত এলাকায় আইএসকে-র তৎপরতা বেড়ে যাবে। আইএস-কে ও তালেবানের মধ্যে বৈরীতার সম্পর্ক আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলতে পারে।

আফগানিস্তানে অতিকট্টরপন্থী সংগঠনগুলোর আবির্ভাব সরাসরি পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে। দেশটির কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আইএস-কে এরইমধ্যে পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলে উগ্রপন্থীদেরকে তাদের দলে টানছে। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের ওরাকজাই জেলায় সংগঠনটির এসব তৎপরতা বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এমনকি সংগঠনটি পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে বলে মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে। এ ধরনের সম্পর্ক পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে।

পাকিস্তানের অনেকে তালেবানের বিজয়কে ইসলামের বিজয় হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে মুজাহেদিনরা তালেবানের বিজয়কে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে উদযাপন করেছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় তালেবানের বিজয়ের পর। তারা আনন্দঘন পরিবেশে তালেবানের এই বিজয় উদযাপন করে।

গত মাসে পাকিস্তানে গ্যালাপ অ্যান্ড গিলানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, আফগানিস্তানে তালেবানের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষই খুশি। অবশ্য জরিপে অংশগ্রহণকারী ২৫ শতাংশ মানুষ পাকিস্তানে তালেবান স্টাইলের সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ১৬ শতাংশ বলেছেন, কী ঘটবে তা তারা জানেন না। চার শতাংশ মানুষ কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।

আঞ্চলিক দৃশ্যপট খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক পাকিস্তানের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে চীনের সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই-এর সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত ও বানচাল করতে তৎপর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো মূল্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রবেশ ঠেকাতে চায়। অন্যদিকে চীন চাইছে সারা বিশে^ নিজেদের অবস্থান সংহত করার মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে এই অঞ্চলে আরেকটি প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধের মোকাবিলা করতে হতে পারে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধে পাকিস্তান কোন দেশের পক্ষ নেবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ইসলামাবাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এক দেশের পক্ষ নিলে আরেক দেশের শত্রুতার সম্মুখীন হতে হবে পাকিস্তানকে। দেশটির অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ কারণে কোনো দেশের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন অবশ্যই হতে হবে কৌশলী ও সুনির্দিষ্ট।

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকেও পাকিস্তানকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পাকিস্তানে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব শুধু দেশটি নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের উপজাতীয় ও সীমান্ত অঞ্চলে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি-র সশস্ত্র তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। সংগঠনটি আফগনিস্তানের সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি ভূখণ্ডে বিশেষ করে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান মূলত পাঠান মাদ্রাসা ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠনের একটি জোট। ২০০৭ সালে বাইতুল্লাহ মেহসুদ নামের এক উপজাতীয় নেতার নেতৃত্বে টিটিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। জোট গঠনের পর থেকেই টিটিপি-র মধ্যে কোন্দল শুরু হয়। এর জেরে সংগঠনটি কয়েকটি উপদলে ভাগ হয়ে যায়। তবে ২০২০ সালে এসে টিটিপি আবার এক হয়। এরপর থেকে সংগঠনটি পাকিস্তানের কয়েকটি অঞ্চলে মারাত্মক হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতরের তথ্য অনুযায়ী টিটিপি-র সদস্য সংখ্যা তিন হাজার থেকে চার হাজারের মতো।

পাকিস্তান বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে, একটি বৈরী প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতায় ও উস্কানিতে টিটিপি ও অন্যান্য উগ্রপন্থী সংগঠন এ ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। এ দেশটি সর্বদা পাকিস্তানের ক্ষতিসাধনের তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। দেশটি বালুচিস্তানকেও পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সেখানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। তারা স্পষ্টভাবে ভারতের দিকে ইঙ্গিত করছে।

সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার জন্য পাকিস্তান তার চিরশত্রু ভারতকে দোষারোপ করলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জানিয়েছেন, টিটিপিকে ঠান্ডা রাখতে তার সরকার সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে আফগানিস্তানে আলোচনা শুরু করেছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন-এর এক খবরে বলা হয়েছে, টিটিপি-র সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের গোপন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেল টিআরটি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও ইমরান খান বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

আফগান তালেবান এই আলোচনায় মধ্যস্থততা করছে। তবে সামরিক পন্থা অবলম্বন করে তিনি এই সংকটের সুরাহা করতে চান না বলেও স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। ইমরান খান বলেছেন, টিটিপি যদি আত্মসমর্পণ করতে চায়, তাহলে সরকার তাদের অতীতের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ক্ষমা করে দেবে। কিন্তু টিটিপি সরকারের এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে এবং আলোচনার জন্য কিছু শর্ত আরোপ করেছে। এ কারণে শান্তি আলোচনা শেষ পর্যন্ত সফল হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ইমরান খান। ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা এখনই স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।

এ অঞ্চলে যে দ্রুত মেরুকরণ ঘটছে, তাতে পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে অচিরেই হয়তো দেশটি বড় আকারে অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।