হঠাৎ মুখোমুখি ইরান-তুরস্ক, নেপথ্যে কে?


  • ফারজানা তানিয়া
  • ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৮:০৪

ইরান-তুরস্ক সম্পর্কের ধরনটা বিচিত্র। কখনও টানাপড়েন, কখনও বন্ধুত্ব। মধ্যপ্রাচ্যে দুই দেশই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, যেখানে প্রক্সি লড়াইয়ে মুখোমুখি তারা। সিরিয়া, লিবিয়া ও ককেসাস অঞ্চলে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত নিয়ে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে মতবিরোধ দীর্ঘদিনের। আবার, ভৌগলিক সান্নিধ্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও রয়েছে। বড় বাণিজ্য রয়েছে তাদের মধ্যে। বলা যায়, সারাবিশ্বে মুসলিমদের যেভাবে কোণঠাসা করে রাখার পশ্চিমা চেষ্টা চলছে, তার বিপরীতে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বেশ আশা-জাগানিয়া মুসলিমদের জন্য। ইসলামফোবিয়া কিংবা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হামলা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই দেশই সোচ্চার। এ কারণে, দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা দেখতে চান মুসলিমরা। কিন্তু অনেককে আশাহত করে সম্প্রতি তাদের সম্পর্কে বেশ ছন্দপতন হয়েছে। তেহরান-আঙ্কারা সম্পর্ক এখন শীতল। এ শীতলতার দৃশ্যমান কারণ আজারবাইজান হলেও সম্পর্কে চিড় ধরানোর মূল উপাত্ত জুগিয়েছে ইসরায়েল।

অতীতেও, ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আঙ্কারা ও তেহরানের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি করেছে। অবশ্য, ইসরায়েল ও ইরান যখন সঙ্ঘাতে অবতীর্ণ হয়, তখন তুরস্ক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। এ-কারণে উত্থান-পতন থাকলেও তেহরান ও আঙ্কারার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভাঙেনি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যেভাবে দ্রুত গতিতে বাড়ছে, তাতে পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়াতে দুই দেশই আগ্রহী বলে মনে করা হয়।

ইরানের জন্য আনন্দের বিষয় হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ২০০৮-২০০৯ সালের গাজা যুদ্ধ এবং ২০১৪ সালে ইসরায়েল-গাজা সঙ্ঘাতের পর থেকে খুব একটা গতিশীল হয়নি। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এরপর ২০১৬ সালের ২৮ জুন তুরস্ক এবং ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এক শর্তযুক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। গাজাভিত্তিক ফ্লোটিলা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত তুর্কি পরিবারগুলোকে ২০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ আরও কিছু শর্তে ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। কিন্তু, সর্বশেষ ২০২১ সালে ইসরায়েল যখন গাজার ওপর নির্বিচার বিমান হামলা শুরু করে, তখন ইসরায়েলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছে তুরস্ক। গাজাবাসীকে বিপুল সহযোগিতাও দিয়েছে দেশটি। আবার, এ সঙ্ঘাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের যথারীতি কৌশলগত সহযোগিতা দিয়েছে ইরান। এ ঘটনায় দুই দেশের যুথবদ্ধ অবস্থান মুসলিমদের আশ্বস্ত করেছে।

কিন্তু, আবার ছন্দপতন ঘটেছে ইরান-তুরস্ক সম্পর্কে। এবার কারণ আজারবাইজান ও ইসরায়েল।

ইরান থেকে আজারবাইজান হয়ে আর্মেনিয়া যাওয়ার সময় ইরানি ট্রাকগুলো থেকে ফি আদায়কে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সমস্যার দৃশ্যমান সূচনা হয়। এরপর কারাবাখ যাওয়ার পথে কয়েকজন ইরানি ড্রাইভারকে আটক করে আজারবাইজান। আজারবাইজনের পক্ষ থেকে বলা হয়, আর্মেনিয়া থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাদের আটক করা হয়েছে। ড্রাইভারদের মুক্তির দাবি জানায় ইরান। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও হয়। কিন্তু, এর সুরাহা হয়নি, মুক্তি মেলেনি ড্রাইভারদের।

বিষয়টি নিয়ে সরব হয় ইরানি গণমাধ্যম। আজারবাইজান, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একজোট হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে বলে সম্প্রতি ইরানি দৈনিকগুলোতে মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ইরান ও রাশিয়া মিলে এই খেলা মোকাবিলা করবে বলেও বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ প্রেক্ষাপটে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে সামরিক মহড়ার আয়োজন করে ইরান। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ। তিনি বলেন, ‘এখন কেন এই মহড়া? আমাদের সীমান্তের কাছে কেন এ মহড়া করা হচ্ছে? খবরে বলা হয়, প্রায় ৩০ বছর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আজারবাইজান স্বাধীন হওয়ার পর তাদের সীমান্তের কাছে কখনও মহড়া করেনি ইরান।

আজারবাইজানের আপত্তি উপেক্ষা করে সীমান্তে বড় ধরনের সামরিক মহড়া শুরু করে ইরান। সাঁজোয়া যান, অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার, গোলাবারুদ ও ড্রোন ব্যবহার করে পরিচালিত হয় এ মহড়া। মহড়ায় প্রথমবারের মতো অনেক উঁচুতে দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম, এমন ড্রোনের পরীক্ষা চালানো হয়। এদিকে, আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসে দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায়। এ হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে তেহরান।

এর কয়েকদিন আগে আজারবাইজানে পাকিস্তান ও তুরস্কের যৌথ সামরিক মহড়া হয়েছে; অস্ত্রের ঝনঝনানির মাধ্যমে ওই মহড়ার জবাবও দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইরানি সূত্র। একইসঙ্গে ইসরায়েলকেও নিজেদের সামরিক শক্তির জানান দিয়েছে তেহরান।

ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত ইরান। দুই দেশের সামরিক চুক্তি নিয়ে অনেক দিন ধরেই সমালোচনা করে আসছিল দেশটি। সীমান্তে ইসরায়েলের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেন, ইরান তার জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ইসরায়েল সরকারের কার্যকলাপ সহ্য করবে না। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে তার দেশ।

ইরানের বক্তব্য হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর আজারবাইজানে ইসরায়েলি উপস্থিতি বেড়েছে। তারা সেখানে বসে ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ প্রেক্ষাপটে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তার দেশ কোনো অবস্থায় ইরান সীমান্তের আশপাশে ইসরায়েলের উপস্থিতি সহ্য করবে না।

ইরান-আজারবাইজান সম্পর্কে টানাপড়েন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসরায়েলের পাশাপাশি কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করছে। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে গত বছরের যুদ্ধে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে এ অঞ্চলে আনা হয় এবং ইসরায়েল ওই যুদ্ধের ডামাডোলে নিজের অবৈধ স্বার্থ উদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে।

তিনি বলেন, গত বছর ইরান কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে বিষয়গুলো আজারবাইজানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তেহরান বাকুকে একথা স্পষ্ট করে জানিয়েছে, আর্মেনিয়ার কাছ থেকে নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল পুনরুদ্ধারে বাকুকে সহযোগিতা করলেও তেহরান কোনো অবস্থায় নিজের সীমান্তের কাছে ইসরায়েলের উপস্থিতি সহ্য করবে না।

এরপর উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করে তুরস্ক ও আজারবাইজান যৌথভাবে ইরান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সামরিক মহাড়া শুরু করে। মহড়ার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য স্টেডফাস্ট ব্রাদারহুড, টু থাউজেন্ড টোয়েন্টি ওয়ান’। এতে অংশ নেন আজেরি ও তুর্কি সেনারা। ইরানও মহড়া অব্যাহত রাখে। যুদ্ধ-যুদ্ধ অবস্থার মধ্যে এ মহাড়ার যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব তুলে ধরেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি।

খামেনি বিশেষ কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের উচিত, বিদেশি সামরিক শক্তি এড়িয়ে প্রতিবেশী সামরিক শক্তিকে সহায়তা দেওয়া; পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে বিজ্ঞতার সঙ্গে এর সমাধান করা। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি বাহিনীর উপস্থিতি মানে ধ্বংসের উৎস। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিজেদের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করারও আহ্বান জানান।

মহড়াকে ঘিরে ইরান-আজারবাইজান উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন এতে নতুন মাত্রা যোগ করে আজারবাইজানের একটি সিদ্ধান্ত। দেশটির একটি রাষ্ট্রীয় আদেশের মাধ্যমে রাজধানী বাকুতে ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাকুতে হুসেইনি মসজিদে রয়েছে আয়াতুল্লাহ খামেনির কার্যালয়। এক বিবৃতিতে আজারবাইজানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এহসান জাহিদভ জানান, করোনার কারণে বাকুতে ইরানি শীর্ষ নেতার কার্যালয়টি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আয়াতুল্লাহ খামেনির কার্যালয়ের সঙ্গে ওই মসজিদটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

জবাবে, আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীর জন্য নিজেদের আকাশপথ বন্ধ করে দেয় ইরান। ইরানের ওপর দিয়ে আজারবাইজানের স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র নাখচিভানে সামরিক সরঞ্জামাদি বহন করত আজারবাইজান।

এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সহায়তা কামনায় মস্কো যান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মস্কোয় তিনি বৈঠক করেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে। সেখানে আবদুল্লাহিয়ান বলেন, ইরান-আজারবাইজান সীমান্তে জঙ্গি কর্মকাণ্ড চলছে বলে ইরানি গোয়েন্দাদের কাছে খবর আছে। সেখানে ইহুদিরাও আছে বলে তাদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে। এর থেকেই স্পষ্ট, আজারবাইজান ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরানকে অপদস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইরানের বক্তব্য, ককেশাস অঞ্চলে কেউ যদি মানচিত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করে, তাহলে তার ফল ভালো হবে না।

ইরান-সীমান্তে বহু আজেরি জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। তারা নিজেদের আজারবাইজানের সঙ্গে যুক্ত করতে চান। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সঙ্গে আজারবাইজানের সংঘাত রয়েছে। সম্প্রতি সংঘাত আরও বেড়েছে, কারণ, ইরানের চরম শত্রুরা আজারবাইজানের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ড্রোন ব্যবহার করে তারা সাফল্য পেয়েছে। আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল আজারবাইজানকে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, তুরস্কের সঙ্গেও আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের বক্তব্য, আজারবাইজান তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।

দৃশ্যত, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তার একদিকে অবস্থান করছে ইরান, রাশিয়া ও আর্মেনিয়া। অন্যদিকে, আজারবাইজান, তুরস্ক ও ইসরায়েল। এ উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়ছে; সুরাহার কোনো লক্ষণ নেই।

মুসলিম বিশ্বের শক্তিধর দেশ ইরান ও তুরস্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকুক, এটাই কামনা করেন মুসলিমরা। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে; মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায় তুরস্ক ও ইরানের যুগপৎ পদক্ষেপ থাকবে কিনা; এসব এখন সময়ই বলে দেবে।