তুরস্ক-ইরান সম্পর্ক : বাইরে শত্রু ভেতরে বন্ধু

-

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৭ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৪৯

ইতিহাসের দুই বিখ্যাত সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী তুরস্ক ও ইরান। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় সেই অতীত ইতিহাস ধরে রাখতে না পারলেও দেশ দুটির আছে নিজ নিজ প্রভাব। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের রাজনীতিতে দেশ দুটির রয়েছে শক্ত অবস্থান। তুরস্ক ও ইরানের মাঝে সম্পর্ক বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানান সমীকরণের সাথে সম্পর্কিত। অনেক ইস্যুতে দেশ দুটি পরস্পর বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। তবে সরাসরি নিজেরা বিরোধে লিপ্ত হয় না কখনও।

সিরিয়া থেকে ইরাক, ককেশাস থেকে উত্তর আফ্রিকা- অনেক ইস্যুতে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে ভূরাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে দেশ দুটি নিজেদের মধ্যে শান্তি ধরে রেখেছে। জ¦ালানি ও বাণিজ্যিক খাতে দেশ দুটি পরস্পরের সাথে জোরালো সম্পর্ক রেখে চলেছে, এমনকি যৌথ স্বার্থ আছে এমন আঞ্চলিক ইস্যুতে হাতে হাত রেখে চলেছে তারা।

একদিকে ইরান শিয়া ও কঠোর ধর্মীয় শাসনের দেশ, অন্যদিকে সেক্যুলার ভাবধারার তুরস্ক দিনে দিনে বিশ্বের সুন্নি মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করেছে। হিজবুল্লাহ, হুথিদের মতো শিয়া মিলিশিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ইরান, আর তুরস্ক সম্পর্ক রক্ষা করছে মুসলিম ব্রাদারহুড, আন-নাহদার মতো ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। যেটি দুই দেশকে দুই মেরুতে নিয়ে গেছে।

আবার দুটি দেশের মাঝে মিলও আছে অনেক কিছুতে। দুটি দেশই কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে টেনশনে আছে। ইরাকি কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে, আইএস দমনেও একই সুরে কথা বলেছে। কাতারের ওপর সৌদি আরবের অবরোধের সময় তারা এক হয়ে দেশটিকে সহযোগিতা করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসে ইরাক, সিরিয়াসহ কিছু আঞ্চলিক ইস্যুতে দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অতীতেও যে এই বিরোধ ছিল না তেমনটি নয়, কিন্তু দেশ দুটি পরস্পরের মৌলিক স্বার্থকে সম্মান করায় পাশাপাশি পথ চলতে পেরেছে।

আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি অবশ্য দুটি দেশকে দুুই প্রান্তে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর থেকে। সিরিয়া ও ইরাক এক্ষেত্রে ছিল প্রধান উপলক্ষ। তবে সরাসরি তেহরান আর আঙ্কারা কখনও বিবাদে জড়ায়নি। এর একটি কারণ হতে পারে উভয়ই পশ্চিমা বিশ্ব থেকে চাপে রয়েছে। নিজেদের মধ্যে মতোবিরোধ থাকলেও তাই সেসব বাড়তে দিচ্ছে না তুরস্ক ও ইরান। পশ্চিমাদের মোকাবিলায় কীভাবে টিকে থাকা যায়, সেটি নিয়ে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতাও কাজ করছে।

ইতিহাস বলছে, তুরস্কের আজকের যে সীমান্ত, তার ভেতরে কিছু অংশ এক সময় ইরানি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। বিশেষ করে তুরস্কের আনাতোলিয়ার বেশ কিছু এলাকা বিভিন্ন সময় শাসন করেছে ইরানি শাসকরা। আবার তুরস্কের ওসমানীয় ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শাসকরা আজকের ইরানের ভূখণ্ডে তাদের সাম্রাজ্য প্রসারিত করেছিলেন। জাতিগত মিলও রয়েছে ইরান ও তুরস্কের মাঝে। পার্সিয়ানদের পর ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠি হলো আজারবাইজানি, যারা মূলত তুর্কি জনগোষ্ঠি। তুর্কি ও ইরানিদের মধ্যে বহুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক মিলও রয়েছে, যা তুর্কো-পার্সিয়ান ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত। যুগে যুগে গজনভি, সেলজুক, সাফাদি, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মাঝে এ ঐতিহ্যের উপস্থিতি বর্তমান ছিল।

তুরস্ক ও ইরানের সীমান্ত রয়েছে ৫৩৪ কিলোমিটারের। এ সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সীমান্তগুলোর একটি, যাতে ১৫১৪ সালের পর উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তিন হয়নি। আধুনিক বিশ্বে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯২৬ সালে তেহরানে সম্পাদিত ট্রেটি অব ফ্রেন্ডশিপ নামের এক চুক্তির মাধ্যমে। ওই চুক্তির মূল উপাদান ছিলো বন্ধুত্ব, নিরপেক্ষতা ও পরস্পরের প্রতি আগ্রাসী না হওয়া এবং উভয় দেশে সরকারের প্রতি হুমকি হতে পারে এমন গোষ্ঠিকে সমর্থন না দেওয়া। মূলত এর মধ্যেমে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষয়ে উভয় দেশ একটি সমঝোতায় পৌঁছায়।

১৯৩৪ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের আমন্ত্রণে ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহলভি তুরস্ক সফর করেন। ওই সফরের পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক আরও জোরদার হতে থাকে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ১৯৩৭ সালে দুই দেশ ইরাক ও আফগানিস্তানকে সাথে নিয়ে একটি শান্তি চুক্তি করে। মধ্যপ্রাচ্যকে শান্ত ও স্থিতিশীল রাখতে ওই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল। ওসামনীয় খিলাফত থেকে ব্রিটেনের সহযোগিতায় বের হয়ে স্বাধীনতা লাভ করা আরব রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের প্রতি নেতিবাচক মানসিকতা পোষণ করত। যে কারণে অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক জোরালো হয়। আঙ্কারা-তেহরান সুসম্পর্কের সেটিও অন্যতম কারণ।

তবে ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর এ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থবির হয়ে যায়। তুরস্কের পশ্চিমাপন্থী সেক্যুলার সরকার ইরানের ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলকে সহজভাবে নিতে পারেনি। যে কারণে দেশ দুটি পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠতা রক্ষায় খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। ইরানের ওই বিপ্লব পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকেই আমূল পাল্টে দেয়। এরপর থেকেই মূলত ইরান ও তুরস্কের সম্পর্ক ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ স্টাইলে চলতে শুরু করে।

উভয় দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরের সাথে প্রয়োজনীয় সম্পর্ক রক্ষা করেছে ঠিকই; কিন্তু গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। আবার বিরোধেও জড়ায়নি দেশ দুটি। সন্ত্রাস দমন, মাদক চোরাচালান রোধসহ অনেক ইস্যুতে একে অন্যকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাটুকু দিয়েছে। আবার ইরাক ও মধ্য এশিয়ায় স্থিতিশীলতা আনতেও দেশ দুটি একসাথে কাজ করেছে।

২০১০ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অনির্ধারিত এক সফরে তেহরান যান ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার জন্য। ওই সফরের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে আলোচনা। এর কিছুদিন পরই ইরান থেকে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে তুরস্কে একটি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম স্থাপন করে ন্যাটো। যেটি নিয়ে তেহরানের সাথে আঙ্কারার সম্পর্কে অবনতি ঘটে। যেটি আরও বেড়ে যায় আরব বসন্তের পর।

দেশ দুটির আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা ১৯৯০ এর দশকে শুরু হলেও সেটি আরব বসন্তের পর প্রবল হয়। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় টেকাতে মাঠে নামে ইরান, অন্যদিকে দেশটির বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় তুরস্ক। ইরাকের শিয়া গ্রুপগুলোকে ক্ষমতায় আনতে ইরান বেপরোয়া হয়ে ওঠে, সেখানেও তুরস্ক অবস্থান নেয় সুন্নিদের পক্ষে। ইয়েমেনেও দেশ দুটির অবস্থান ছিল পরস্পর-বিরোধী। আবার নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষ নিলেও আর্মেনিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল ইরান।

২০১৫ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ইরান এরদোয়ান সরকারের পাশে দাঁড়ায়, যা দেশ দুটির সম্পর্ক উন্নতির আভাস দেয়। আবার ইরানে গণবিক্ষোভের সময়ও দেশটির সরকারকে সমর্থন দেয় তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে আবার অবরোধ আরোপ করলে তুরস্ক তার বিরোধিতা করে। তারা জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায়ও নিন্দা জানায়। অন্যদিকে উত্তর ইরাকে তুরস্কের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সমর্থন দিয়েছে তেহরান। যে কারণে দেশ দুটির সম্পর্ক সব সময়ই একটি ভারসাম্য নিয়ে অগ্রসর।

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থা যাই থাকুক, তুরস্ক ও ইরানের মাঝে রয়েছে জোরালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক। দুটি দেশই অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থার সদস্য। আমদানি ও রফতানিতে রয়েছে পরস্পর নির্ভরতা। তুর্কি পণ্যের যেমন বড় বাজার রয়েছে ইরানে, তেমনি ইরানি পণ্যও নিয়মিত পাওয়া যায় তুরস্কে।

তুরস্কে একে পার্টির সরকার ক্ষমতায় আসার পর দু দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে আরও উন্নতি হয়েছে। ২০০০ সালে দেশ দুটির পারস্পরিক যৌথ বাণিজ্য ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের, কিন্তু ৫ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। আর বর্তমানে এ বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারে। আঙ্কারা ও তেহরানের টার্গেট সেটিকে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া।

তুরস্ক তার গ্যাস চাহিদার ৩০ শতাংশ আমদানি করে ইরান থেকে, যা প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটারের বেশি। তারা ইরানের সাউথ পার্স গ্যাস ফিল্ডের উন্নয়নে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনার করছে বলে জানা গেছে। যা বাস্তবায়িত হলে এখান থেকে পাওয়া গ্যাস, পুনরায় ইউরোপে রফতানি করতে পারবে তুরস্ক। এছাড়া ২০০৮ সালে ইরানের একটি পেট্রোক্যামিক্যাল কোম্পানির ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের বেসরকারিকরণের টেন্ডারও পেয়েছে তুরস্ক।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অবরোধের কারণে ২০১৯ সালে ইরান থেকে তেল কেনা বন্ধ করতে বাধ্য হয় তুরস্ক। যেটি ছিল দুই দেশের যৌথ বাণিজ্যের জন্য একটি বড় আঘাত। আর পরের দুই বছরে করোনাভাইরাসের কারণে স্থলসীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়াতেও বাণিজ্য সেক্টরে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে উভয় পক্ষ।