আফগানিস্তানে কতটুকু প্রভাব থাকবে পাকিস্তান ও চীনের?


  • মোতালেব জামালী
  • ০১ অক্টোবর ২০২১, ১৪:১৪

আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে পাকিস্তান ও চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। কেননা তালেবান সরকার ও সংগঠনটির নেতারা নানা দিক থেকেই চীন ও পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে তালেবান সরকার চরম আর্থিক, খাদ্য ও মানবিক সহায়তার সংকটে আছে। এই জরুরি পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী এই দেশ দুটি তালেবান সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়সহ বিভিন্ন ইস্যুতেও পাকিস্তান ও চীনের সহায়তা প্রয়োজন হবে তালেবানের। যদিও তালেবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে এখনও কিছু বলছে না দেশ দুটি।

তবে নিজেদের সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকারের সহযোগিতা চীন ও পাকিস্তানের প্রয়োজন। গত দুই দশক আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উপস্থিতি চীন ও পাকিস্তানের জন্য ছিল ভীষণ পীড়াদায়ক। কিন্ত সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন পারস্পারিক প্রয়োজনের নিরিখেই তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তান ও চীনের সম্পর্ক সামনে এগিয়ে যাবে। দেশ দুটি সেভাবেই তালেবানের নতুন সরকারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

অবশ্য তালেবানের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের ভূমিকা অস্পষ্টই রয়েছে। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ওই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আবার পাকিস্তানই দেন-দরবার করে তালেবানের জন্য সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বীকৃতি আদায় করেছিল।

কিন্তু এবার তালেবান কাবুল দখলের এক মাস পরও স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ইসলামাবাদ চুপ করে আছে। কিন্তু কেন এই নীরবতা? এ ব্যাপারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভী মনে করেন, পাকিস্তান তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না। তারা এবার একা কিছু করতে চায় না। আরও পাঁচটি দেশের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে চায়।

তিনি বলেন, প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে চীনের সাথে সমন্বয় করে এবার এগোতে চাইছে পাকিস্তান। আফগানিস্তান এবং তালেবান প্রশ্নে আঞ্চলিক একটি ঐক্য চাইছে ইমরান খানের সরকার। সম্ভবত সে কারণেই ইসলামাবাদের উদ্যোগে সম্প্রতি চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠক করেছেন।

ওই বৈঠকের দুদিন পর আবারও পাকিস্তানের উদ্যোগেই এসব দেশের গোয়েন্দা প্রধানরা বৈঠক করেন বলে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন খবর দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও গোপনে পাকিস্তান কথা বলছে বলে ডনের খবরে বলা হয়েছে।

বিশ্লেষক ও পাকিস্তানের কর্মকর্তারা এটা বিশ্বাস করেন যে, তালেবানের বিজয় পাকিস্তানের দুটো উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করবে। আফগানিস্তানের নতুন সরকারের দায়িত্ব বন্ধুপ্রতীম একটি গ্রুপের হাতে থাকার ফলে দেশটিতে পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে কাবুলে ভারত সরকারের প্রভাব সীমিত করে দেওয়া সম্ভব হবে।

ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে, ভারত আফগানিস্তানের মাধ্যমে পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং জাতিগত পশতুন ও বালুচ জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোকে ভারত সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার এসব সংগঠনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। পাকিস্তান আশা করছে, তালেবান ক্ষমতায় আসার ফলে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার অবসান ঘটবে।

ইসলামাবাদ আরও আশা করে, তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকার পাকিস্তানকে তার ভূঅর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী ও সম্প্রসারণ করার সুযোগ তৈরি করে দেবে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন থেকেই চেষ্টা করছে মধ্য এশিয়ার স্থলবেষ্টিত দেশগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেন আফগানিস্তান হয়ে তার গদর বন্দরের মাধ্যমে আরব সাগরে প্রবেশ করতে পারে। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে গদর বন্দর থেকে পাকিস্তানের রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাবে।

কিন্তু এতদিন সেটা সম্ভব হয়নি আফগানিস্তানে বৈরী সরকার ক্ষমতায় থাকায়। এছাড়া দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উপস্থিতিও পাকিস্তানের জন্য বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। এখন সব বাধা দূর হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর পর তালেবান আবার ক্ষমতায় আসায় পাকিস্তান এখন এ ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে।

যদিও গত ২০ বছরে তালেবানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে নানা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউটের গবেষক উমের করিম বলেন, পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে সাধারণভাবে একটি বিশ্বাস কাজ করছে যে এবার তারা কিছু সাফল্য অর্জন করেছেন।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের সাথে রেষারেষিকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাকিস্তানের অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তালেবানের ক্ষমতা দখলে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব অনেক কমবে।

উমের করিম বলেন, বিশেষ করে জালালাবাদ এবং কান্দাহারের মতো সীমান্তবর্তী আফগান শহরগুলোতে ভারতের কনস্যুলেটগুলো নিয়ে পাকিস্তান খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। পাকিস্তান মনে করে ভারত উত্তরে পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠী টিটিপি এবং দক্ষিণে বালুচ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর প্রধান উস্কানিদাতা। আফগানিস্তানের ভারতীয় কনস্যুলেটগুলোর মাধ্যমে এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে নানা সাহায্য সহযোগিতা করা হতো।

এই গবেষক বলেন, পাকিস্তান বিশ্বাস করে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে ভারতের এই তৎপরতা বন্ধ হবে।

আফগানিস্তানের প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্য হয় পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। চাল, আটা, সবজি থেকে শুরু করে সিমেন্ট এবং নির্মাণ সামগ্রীও পাকিস্তানের ভেতর দিয়েই আফগানিস্তানে যায়। ফলে পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারণেও বিভিন্ন ইস্যুতে বিশেষ করে নিরাপত্তা ইস্যুতে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী হবে তালেবান। সেই সাথে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে একটি বাণিজ্য করিডোর তৈরি নিয়েও পাকিস্তান খুবই আগ্রহী।

উমের করিম আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি না পেলে তালেবানের সরকার বিশ্বে একঘরে হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এজন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন। এই অবস্থায় পাকিস্তানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা যেতে পারবে না।

তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে পাকিস্তান ‘ধীরে চলো’ নীতি নিলেও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আটক রাখা আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো শর্ত ছাড়াই আফগানিস্তানে মানবিক সাহায্য দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। এছাড়া ৮ সেপ্টেম্বর শাহ মেহমুদ কোরেশি আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথেও কথা বলেছেন।

জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এরইমধ্যে বিমানবোঝাই করে আফগানিস্তানে খাবার এবং ওষুধও পাঠিয়েছে ইমরান খানের সরকার। এছাড়া ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থা পিআইএ-র একটি বিমান কাবুলে নেমে যাত্রী নিয়ে এসেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে, এখন থেকে নিয়মিত এই রুটে পিআইএ-র বিমান চলবে। মোট কথা, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও পাকিস্তান তালেবান সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে চীনও নানাভাবে তালেবান সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। তালেবানের কাবুল দখলের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল চীন। তালেবান সরকার গঠনের পরদিনই তারা এই সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েন বিন একে অরাজকতা বন্ধের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, কাবুলে চীনা দূতাবাস সচল। আমরা নতুন আফগান সরকার এবং তাদের নেতাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে এখনও কোনো কথা বলেনি চীন। অনেক পর্যবেক্ষক একে তালেবানের প্রতি পরোক্ষ স্বীকৃতি হিসাবে দেখলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দিনক্ষণের কোনো ইঙ্গিত চীন দেয়নি।

চীন আফগানিস্তানের জন্য তিন কোটি মার্কিন ডলারের জরুরি খাদ্য এবং ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আফগানিস্তানে বিনিয়োগ নিয়ে দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সাথে চীনা কর্মকর্তাদের কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ তাই বলছেন, তালেবান সরকারের প্রতি পাকিস্তান, চীন বা কাতারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অনেকটাই এখন অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তালেবান সরকারের সাথে এসব দেশের সম্পর্ক শুরু হয়ে গেছে।

এতদিন আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি চীনের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জাজনক বিদায় চীনকে সেই শঙ্কা থেকে স্বস্তি দিয়েছে। এখন আফগানিস্তানে চীন অনেকটা স্বাধীনভাবে নিজের চাওয়া পূর্ণ করতে পারবে।

আফগানিস্তান ঘিরে চীনের অর্থনৈতিক অভিলাষ যেমন আছে, তেমনি নিরাপত্তার জন্যও আফগানিস্তান চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর চীনা কোম্পানিগুলোর আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদে হাত দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মাইক্রোচিপসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহার হয় এমন বিরল খনিজের মজুদ আফগানিস্তানে রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ রয়েছে। তবে আফগান সরকার মনে করে, বাস্তবে এর পরিমাণ তিনগুণ বেশি।

কৌশলগত দিক থেকে আফগানিস্তানে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে চীনের যুক্তি রয়েছে। সিল্ক রোড নামে এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত প্রাচীন যে স্থল বাণিজ্য রুটটি পুনরুদ্ধারে চীন বদ্ধপরিকর, আফগানিস্তান সেই রুটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আফগানিস্তানের দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং ইরানে চীন এরইমধ্যে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করছে। আফগানিস্তানকেও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় আনতে চায় চীন ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তান ও চীন চাইবে না নিজেদের সীমান্তে তাদের চিরবৈরী একটি দেশের তৎপরতা আবার শুরু হোক। এ কারণে নিজেদের স্বার্থেই দীর্ঘদিনের বন্ধুপ্রতীম এই দেশ দুটি তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ও সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও দেশটির ভবিষ্যত পথচলা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তান হিসাব-নিকাশ করেই সামনে এগোচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।