আফগান শরণার্থীদের নিয়ে রাজনীতি করছে ইউরোপ


  • মোতালেব জামালী
  • ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:০৬

কয়েক দশকের যুদ্ধ ও পশ্চিমা দখলদারিত্বের কারণে আফগানিস্তান আজ একটি বিপর্যস্ত দেশ। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে ইউরোপ। ফলে সঙ্গতভাবেই এটা ধরে নেওয়া যায় যে, আফগান নাগরিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে ইউরোপীয় সমাজগুলো ও রাজনীতিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। বিষয়টির প্রতি তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা। এটি তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

কিন্তু ইউরোপীয় রাজনীতিকরা সেই দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন ও করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তালেবান গত আগস্ট মাসে ক্ষমতা দখলের পর হাজার হাজার আফগান নাগরিক নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশ ছাড়ার জন্য কাবুল বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিলেন। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এসব লোকদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কাবুলে একটি সেফ জোন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, ‘কাবুল থেকে এসব লোকজনকে সরিয়ে আনা, জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদান ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন সহায়তা নিয়ে জি-৭-এর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।’

আফগানিস্তান যেখানে চরম মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন এবং হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দেশ ছাড়ছে, সেখানে এ ধরনের কথাবার্তা কি পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট? বরং ইউরোপের কিছু রাজনীতিক আফগান ইস্যুকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উপলক্ষ বানিয়েছেন।

ব্রিটেন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে তিনটি যুদ্ধ করেছে। ২০০১ সালে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সেখানে চতুর্থ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। দেশটির কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক নাইজেল ফারাজ আফগান শরণার্থীদের গ্রহণ করার প্রশ্নে খুব দ্রুতই ইসলাম ও সন্ত্রাসকে আফগান ইস্যুর সাথে যুক্ত করে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা এখন দেখবেন অসংখ্য মানুষ আফগানিস্তান ছাড়ছে। আমরা ইতোমধ্যে অনেক লোকজনকে আশ্রয় দিয়েছি। নতুন করে আর কোনো শরণার্থী গ্রহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কি করে জানব যে তালেবান ও অন্য সন্ত্রাসী গ্রপগুলো শরণার্থীদের সাথে তাদের লোকজনকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেবে না?’

ইতালির কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনিও নাইজেল ফারাজের মতো একই সুরে কথা বলেছেন। গত ১৮ আগস্ট এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘বিপদে পড়া নারী ও শিশুদের জন্য মানবিক করিডোর দেওয়া আমি সমর্থন করি। কিন্তু সম্ভাব্য সন্ত্রাসীসহ হাজার হাজার পুরুষের জন্য ইউরোপের দরজা কোনোভাবেই খুলে দেওয়া যাবে না।’

কেবল ইউরোপের কট্টর ডানপন্থীরাই শরণার্থী সমস্যার মতো একটি নিছক মানবিক ইস্যুকে রাজনীতিকরণ করছে না। বরং মহাদেশটির মধ্য ডানপন্থী রাজনীতিকরাও একই সুরে কথা বলছেন। তারাও বিষয়টি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করছেন। তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে ইসলাম বিদ্বেষী ও ইমিগ্র্যান্ট-বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। গত ১৭ আগস্ট ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ফ্রান্সের উচিত হবে আফগানিস্তানের শরণার্থীর স্রোত থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা।

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্টিয়ান কার্জ গত ২২ আগস্ট আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ইউরোপের উচিত হবে ইউরোপগামী আফগান শরণার্থীভর্তি বিমানগুলো তৃতীয় কোনো দেশে পাঠিয়ে দেওয়া। আফগান জনগণকে প্রতিবেশী দেশগুলোরই সহযোগিতা করা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে গত ৩১ আগস্ট তাদের বিশেষ বৈঠকে একই ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তারা স্পষ্ট করেই বলেছেন, তাদের প্রধান অগ্রাধিকার হবে অবৈধ শরণার্থীদের আগমন ঠেকানো। বৈঠকের পর দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা ঘোষণা করেছেন, ইইউ ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের বহিঃসীমান্ত কার্যকরভাবে সুরক্ষিত রাখতে বদ্ধপরিকর এবং তারা অননুমোদিত প্রবেশ প্রতিহত করবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইইউ-র উচিত হবে আফগানিস্তানের নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি জোরালো সমর্থন দেওয়া, যাতে প্রাথমিকভাবে শরণার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা এই অঞ্চলেই পেতে পারে।

ইইউ-র এই অবস্থান থেকে এটা স্পষ্ট যে, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ও দেশটির শরণার্থীদের ব্যাপারে সংস্থার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিকদের থেকে আলাদা কিছু নয়। ইতালির নব্য ফ্যাসিবাদী দল ব্রাদার্স অব ইতালির নেতা জর্জিয়া মেলোনি সম্প্রতি বলেছেন, লাখ লাখ আফগান নাগরিক এই ধারণা পোষণ করেন যে, তারা সবাই পশ্চিমাবিশ্বে চলে যেতে পারবেন। এটি অবাস্তব চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়। তারও মত হচ্ছে, আফগান শরণার্থীদেরকে প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে দেখাশোনা করতে পারে, সেজন্য এসব দেশকে ইইউ-র প্রয়োজনীয় সহযোগিত দেওয়া উচিত।

ইইউ-র বাইরের কোনো দেশে অভিবাসন ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব অবশ্য নতুন কিছু নয়। ইইউ ২০১৬ সালে তুরস্কের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় তুরস্ক অভিবাসীদের ইউরোপে প্রবেশ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে। এমনকি যেসব অভিবাসী তুরস্ক থেকে গ্রিসে প্রবেশ করেছে, তাদেরকেও ফেরত নেবে তুরস্ক। এসব কাজের বিনিময়ে ইইউ তুরস্ককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। এছাড়াও ইইউ তুরস্ককে আরও কিছু সুবিধা দেবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই চুক্তি সেভাবে কার্যকর হয়নি। তুরস্ক বারবার অভিযোগ করতে থাকে যে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইইউ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। এক পর্যায়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান হুমকি দিয়ে বলেন, ইউরোপ যদি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না দেয়, তাহলে তিনি সব শরণার্থীকে ইউরোপে পাঠিয়ে দেবেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু গত পহেলা সেপ্টেম্বর স্পষ্ট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেই অবস্থায় তার দেশ নতুন করে আর কোনো বিপর্যয়কর চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। তিনি বলেন, আফগান শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপের সাথে তুরস্ক আর কোনো সহযোগিতা করবে না।

লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে শত শত অভিবাসন প্রত্যাশী ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে। প্রায়ই নৌকা ডুবে শরণার্থীদের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু তারপরও সমুদ্রপথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা বন্ধ হয়নি। এ কারণে ইইউ লিবিয়ার কোস্টগার্ডকে গত কয়েক বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে আসছে, যাতে তারা শরণার্থীদেরকে লিবিয়ার উপকূলেই আটকে দেয়।

কিন্তু দেখা গেছে যে, ইউরোপে অভিবাসন-প্রত্যাশী এসব লোকজনকে কোস্টগার্ড ধরে নিয়ে লিবিয়ায় ডিটেনশন সেন্টারে অমানবিক পরিবেশে রাখে। সেখানে তাদের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় বাধ্যতামূলক শ্রম ও চাঁদা আদায়ের ঘটনাও ঘটে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বিভিন্ন এনজিও ও অন্যান্য মাবাধিকার কর্মী এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু তারপরও ইইউ লিবিয়ার কোস্টগার্ডকে অভিবাসন-প্রত্যাশী ও আশ্রয়প্রার্থীদের আটকানোর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। আফগানিস্তানে সৃষ্ট সংকটের পর ইইউ-র একই ধরনের ভুল কাজ করা উচিত নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ইইউ-র বেশ কিছু সদস্য দেশ ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানোর সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সেখানে গিয়েছিল। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই তারা আফগানিস্তান ছেড়েছে। ফলে আফগানিস্তানে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দায় এসব দেশেরও আছে। তারা এখন সবকিছু অস্বীকার করে যদি বলে আফগানিস্তানে সৃষ্ট পরিস্থিতির সব দায়-দায়িত্ব কেবলই যুক্তরাষ্ট্রের, তাহলে সেটি কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

আফগান শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় ইইউ বিভিন্ন উপায়ে খুব দ্রুত ও কার্যকরভাবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু তারা সেটি না করে আফগান শরণার্থীদের দায়িত্ব যদি তৃতীয় কোনো দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের এই কৌশল সাময়িকভাবে কাজ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ হবে না। ইউরোপকে সুরক্ষিত দুর্গ বানানোর চেষ্টা করা হলে তা ইইউ-র নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করবে না। এর মাধ্যমে বরং ইউরোপ পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এছাড়া এ ধরনের পদক্ষেপ ইউরোপীয় দেশগুলোতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ আরও বাড়িয়ে দেবে।

একটি যুক্তিসঙ্গত ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন করা ইউরাপের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। কেননা ইউরোপের দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির বিরূপ প্রভাবে যেসব মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করা এসব দেশেরই কর্তব্য। আফগান সংকট ইউরোপের সামনে এমন একটি নতুন ইউরোপ বিনির্মাণের সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে সব মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো যাবে।