উপসাগরীয় অঞ্চলের ছোট্ট দেশ কাতারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তানের নতুন শাসক গোষ্ঠি তালেবানের সুসম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গ্যাস-সম্পদে সমৃদ্ধ কাতারের সম্পর্ক অনেক দিনের। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান কাতারকে তাদের বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে মর্যাদা দেয়। এ-কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ও তালেবানের মধ্যে যোগাযোগ ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের একটি চমৎকার অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে কাতার।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের সব সেনা ও অন্যান্য নাগরিক আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার আগেই তালেবান ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করে। এরপর হাজার হাজার আফগান নাগরিক নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশ ছাড়ার জন্য কাবুল বিমানবন্দরে এসে জড়ো হন। এসব লোকজন ও মার্কিন নাগরিকদেরকে সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে সরিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা দেয় কাতার। দেশটি তাদের এয়ারলাইন্স কাতার এয়ারওয়েজের বিমান দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে কাবুল বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেয়।
এ সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ৭ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় বলেছেন, কাবুল বিমানবন্দর থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিতে অনেক দেশই সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কাতার যা করেছে, তা আর কারও পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। বিস্তৃত অঞ্চলে রাজনৈতিক মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে কাতার নিজের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
তিনি আরও বলেন, কাবুল বিমানবন্দর থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিতে সহযোগিতা দেওয়ার ঘটনায় কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্ক আগামী বহু বছর ধরে চলতে থাকবে এবং তা দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার পথকে প্রশস্ত করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার তালেবানের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক দেশগুলোর মধ্যে একটি নতুন জোট গঠনের সম্ভাবনা জোরালো করে তুলবে। এসব দেশের মধ্যে কাতার, তুরস্ক ও পাকিস্তান অন্যতম।
জেমস ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ শাহ মাহমুদ হানিফি বলেন, কারও জরুরি প্রয়োজনের মুহূর্তে যদি কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধটি থাকে অনেক বেশি। কাতারের ক্ষেত্রেও তাই ঘেেটছে। কাতার এখন তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতাবোধকে কাজে লাগিয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা লাভের চেষ্টা করবে।
তালেবানের সাথে কাতারের যোগাযোগ ও সম্পর্ক এক দশকেরও বেশি সময় আগের। ২০১১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগান সরকারের সাথে আলোচনা করার সুবিধার্থে তালেবান নেতাদের একটি গ্রুপকে কাতারের রাজধানী দোহায় যাওয়ার অনুমতি দেন। এরপর ২০১৩ সালে তালেবান দোহায় আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের একটি অফিস খোলে। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তালেবানের সাথে সরাসরি আলোচনা শুরু করে। এই আলোচনায় আফগান সরকারকে ডাকা হয়নি।
শাহ মাহমুদ হানিফি বলেন, এক্ষেত্রে কাতারের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ও সক্ষমতার পরিচয় হলো- তারা দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কূটনৈতিক উপস্থিতি ও তালেবানের উপস্থিতিকে একসাথে করতে পেরেছে। দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর তারা ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যহার করার ব্যাপারে একমত হন। এ ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর তিনি এই সময়সীমা আরও চার মাস পিছিয়ে দেন।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের এই চুক্তি তালেবান এবং আফগান সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু করার পথকেও সুগম করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কাতার। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে তালেবান আফগান বাহিনীর সাথে লড়াই অব্যাহত রেখেছিল। তারা খুব দ্রুত আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে এবং রাজধানী কাবুলের উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হয়। এ সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। এরপর গত ১৫ আগস্ট তালেবান একটি গুলিও খরচ না করে কাবুল দখল করে।
তালেবান ও কাতারের মধ্যে গত এক দশকের এই সম্পর্কের কারণে বর্তমানে আফগানিস্তানের ওপর কাতারের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। দোহায় তালেবানের অফিস খোলার অনুমতি দিয়ে কাতার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিল। একইভাবে কাতারের কারণেই অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক মিশন দেখা যেতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সানাম ভাকিল বলেন, কাতার সরকার নিজেদেরকে যোগ্য মধ্যস্থতকারী হিসেবে তুলে ধরতে চায়। ছোট দেশ হলেও কাতারের সম্পর্ক ও যোগাযোগের পরিধি অনেক বিস্তৃত। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশটি তার এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুই করতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাতারের সম্পর্ক অন্য মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে।
সানাম ভাকিল আরও বলেন, কাতার নিজেকে বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কাজটি কাতার খুব সহজেই করতে পারে। আগামী দিনে কাতার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে কাতারই হয়ে উঠতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের মধ্যস্থতাকারী।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাতারের খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আফগানিস্তানের শাসক হিসেবে তালেবানকে দ্রুত বা তাড়াহুড়ো করে স্বীকৃতি দেওয়া কাতারের উচিত হবে না। কারণ তালেবান যদি ১৯৯০ এর দশকের মতো আবারও কঠোর শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যায়, তাহলে সংগঠনটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কাতারের বড় ধরনের কূটনৈতিক ব্যর্থতা।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক নিলোফার শাখি বলেন, তালেবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কাতার সম্ভবত অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করবে। দেশটি চাইবে না তাদের সুনাম নষ্ট হোক। কারণ, ১৯৯৬ সালে থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান সরকারের সব কর্মকাণ্ডই কাতারের সামনে আছে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-থানি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। তবে সংগঠনটির সাথে সম্পর্ক বা যোগাযোগ রাখার জন্য তিনি সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তালেবানের সাথে যোগাযোগ রাখা ছাড়া আফগনিস্তানের নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রকৃত অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। যদি আমরা শর্ত আরোপ করতে থাকি এবং যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দেই, তাহলে আমরা একটি শূন্যতার সৃষ্টি করব। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, কারা এই শূন্যতা পূরণ করবে?
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার পর অন্যান্য দেশ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। চীন দেশটির পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ উদ্যোগে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কাবুলকে। অন্যদিকে রাশিয়া কাবুলে তার কূটনৈতিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদ (আইএসএসআই)-এর সেন্টার ফর আফগানিস্তান, মিডল ইস্ট অ্যান্ড আফ্রিকা-র পরিচালক আমিনা খান বলেন, বর্তমান আফগানিস্তান নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুটি গ্রুপ বা ব্লক সৃষ্টি হয়েছে। ইরান, রাশিয়া ও চীনের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগে একটি আঞ্চলিক ম্যাকানিজম হয়তো কাজ করবে। আরেকটি গ্রুপ বা ব্লকে আছে কাতার, তুরস্ক ও পাকিস্তান। তালেবানের সাথে এই তিন দেশেরই দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। তারা আফগানিস্তানেও একসাথে কাজ করবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমিনা খান বলেন, আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে একটি কৌশলগত ঐক্য দেখা যাচ্ছে। তারা আফগানিস্তানে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেমন, কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিচালনা করার জন্য তুরস্ক ও কাতারের সাথে তালেবানের একটি খসড়া চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দিকটি দেখবে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তুরস্ক এ কাজটি করছে।
তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর গত মাসে পাকিস্তানে এসে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের ভেঙে পড়া সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনে দেশটিতে গোয়েন্দা ও সেনা কর্মকর্তাদের পাঠাবে। সৌদি আরবের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কেও টানাপোড়েনের কারণে ইসলামাবাদ কাতার ও তুরস্ক-ঘেঁষা হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন আমিনা খান।
সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউিটের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফেয়ারস্টেইন বলেন, আফগানিস্তান যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝে তার অবস্থান সংহত করতে চায়, তাহলে দেশটিকে তুরস্ক, কাতার ও পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তালেবানের সরকার এসব দেশের সাথে তাদের সম্পর্ককে কীভাবে নির্ধারণ করবে, তার ওপর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আফগানিস্তানের অবস্থানও অনেকটাই নির্ভর করবে বলে ফেয়ারস্টেইন মনে করেন।