তালেবানের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ইরানের?


  • মোতালেব জামালী
  • ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৪০

শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান ও আফগানিস্তানের সুন্নি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন তালেবানের মধ্যে একসময় চরম বৈরিতার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে গোষ্ঠিগত ধর্মীয় বিরোধকে একপাশে সরিয়ে রেখে তারা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদের এই পরিবর্তিত সম্পর্কের মূল কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। উভয়পক্ষেরই অভিন্ন শত্রু যুক্তরাষ্ট্র। উভয়েরই লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করা। সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জাজনক বিদায়ের পর আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ইরান ও তালেবানের এই সম্পর্ক কীভাবে কাজ করবে, সেদিকেই এখন বিশ্লেষকরা নজর দিচ্ছেন।

১৯৯০-এর দশকে ইরান ও তালেবানের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। ওই সময় তেহরান তালেবানের শত্রু উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিত। তালেবান প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮ সালে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার-ই শরিফে ইরানি কনস্যুলেটে ৯ জন ইরানি কূটনীতিককে হত্যা করা হয়। তালেবান নিয়ন্ত্রিত যোদ্ধারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটে যে, তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। পরে পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়।

২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনে তালেবান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে ইরানের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। ইরান তার ঘরের দরজায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।

পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ইরান তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসে। শিয়া-সুন্নি বিরোধকে দূরে সরিয়ে তালেবানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তেহরান। এর লক্ষ্য উভয়ের অভিন্ন শত্রু যুক্তরাষ্ট্রকে ঘায়েল করা। নতুনভাবে গড়ে ওঠা তালেবানও তাতে সাড়া দেয়। এরপর গত কয়েক বছরে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবানকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে শুরু করে ইরান। পাশাপাশি পাকিস্তানও তালেবানকে সহযোগিতা দিয়েছে।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি তালেবানের অনুকূলে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রও এটা অনুধাবন করতে পারে যে, আফগান সরকার নয়, সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে তালেবানের সাথেই তাদেরকে চুক্তিতে যেতে হবে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে স্বাক্ষরিত সেই চুক্তি তালেবানের অবস্থানকে আরও সংহত করে। তাদের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হয়। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার আগেই তালেবান কাবুল দখল করে নেয়। এটি ছিল তালেবানের এক বিস্ময়কর সামরিক বিজয়।

১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত তালেবানের অনেক রাজনৈতিক বিবর্তন হয়েছে। সংগঠনের নতুন নেতাদের চিন্তা-চেতনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন ও উন্নয়নের পথের সব বাধা বিপত্তি দূর করে তালেবান নেতৃত্বকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিবেশী দেশ ইরান ও পাকিস্তানের সহযোগিতা তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের আরও বেশি প্রয়োজন হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

এ সম্পর্কে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ফেলো আতহার জাভেদ বলেন, পরিবর্তিত তালেবানের নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। গত দুই দশকে তালেবানের মধ্যে আসলে কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। বিগত কয়েক বছরে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক যেমন গড়ে উঠেছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবিশ্বাসও আছে। তবে জাভেদ মনে করেন, দুটি প্রধান রাজনৈতিক লক্ষণ তালেবানের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের আভাস দেয়।

প্রথমত, তালেবান এটি দেখিয়েছে যে, আঞ্চলিক রাজনীতি সম্পর্কে তাদের একটি কৌশলগত ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন দেশ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কোন দেশকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তা তারা বুঝতে পেরেছে। এসব দেশের সাথে তাদের সম্পর্কের মাত্রাটা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কেও তাদের স্পষ্ট ধারণা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, তালেবান ও ইরান উভয়েই তাদের ইমেজ বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট। বিশ্ব তাদেরকে কীভাবে দেখছে, কোন দৃষ্টিতে পরিমাপ করছে, তা নিয়েও উদ্বেগ আছে তালেবান ও ইরানের। এ থেকে এটা বোঝা যায় যে, তারা নিজেদের ব্যাপারে বিশ্ব বা আন্তর্জাতিক মনোভাব নিয়েও অনেক সচেতন। এ দুটি বিষয়ের পাশাপাশি উভয় পক্ষই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এগুলোই অন্যদের চেয়ে ইরানের সাথে তালেবানের ভালো সম্পর্কের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে।

জাভেদ মনে করেন, ইরান নিজেদেরকে বিশ্বের শিয়া মুসলমানদের অভিভাবক হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু সেই সাথে তেহরান এটাও জানে যে, তালেবানের সাথে সুসম্পর্ক রাখা ছাড়া আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু শিয়া হাজারা জনগোষ্ঠির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

কাজেই নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে তালেবানের নেতৃত্বে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে হাজারাদেরকে। এর অর্থ হচ্ছে- তালেবান ও হাজারাদেরকে তাদের মতপার্থক্য দূর করে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে হবে।

তালেবানের প্রথম শাসনামলে তুর্কি বংশোদ্ভূত শিয়া জনগোষ্ঠি হাজারারা ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে যে, হাজারাদের ব্যাপারে তালেবান আগের চেয়ে অনেকটাই সহনশীল। এবার হাজারা জনগোষ্ঠি আশুরার কর্মসূচি পালন করাসহ নিজেদের ধর্মীয় রীতিনীতি অনেকটা স্বাধীনভাবেই পালন করতে পারছেন। এমনকি তালেবান যোদ্ধাদের একজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার হলেন হাজারাদের অন্যতম নেতা মৌলভী মাহদি। তিনি বলেছেন, তালেবানের এবারের শাসনকাল দেশটির জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নতুন বার্তা বয়ে আনবে। এর মাধ্যমে বহুধাবিভক্ত জনগোষ্ঠির দেশ আফগনিস্তানে তালেবানের শাসন অনেক বেশি সুসংহত হবে বলে তিনি মনে করেন।

আতহার জাভেদ মনে করেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আফগানিস্তানে গোষ্ঠিগত উত্তেজনা হ্রাস করতে পারলে তালেবান ইরানের দিক থেকে চাপ কমাতে সক্ষম হবে। এটা করতে না পারলে ইরান হাজারা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগাষ্ঠিকে তালেবানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। কিন্তু হাজারারা যদি আফগানিস্তানে নিরাপদ বোধ করে তাহলে ইরানও তালেবানের ওপর সন্তষ্ট থাকবে বলে জাভেদ মনে করেন।

তার মতে, এটা দুই পক্ষের জন্যই উইন উইন সিচুয়েশন। এ কারণেই গত প্রায় ১০ বছর ধরে তালেবান ও ইরানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্কের পথ ধরেই দুই পক্ষ বাণিজ্যসহ অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করছে। মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা তালেবান ও তেহরানের সেই অভিন্ন স্বার্থেরই প্রতিফলন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

কাতার ও রাশিয়ার পাশাপাশি ইরানও পশ্চিমাদের সাথে তালেবানের যোগাযোগ ও আলোচনা শুরু করার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে। এই আলোচনার পথ ধরেই শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেন্য প্রত্যাহারের পথ সুগম হয়।

তেহরানভিত্তিক সাংবাদিক ফাতিমা করিম খানও মনে করেন, তালেবানের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ইরানের সাথে সংগঠনটির সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পেরেছে। তার মতে, তালেবান আগের তুলনায় অনেকটাই পরিবতির্তত হয়েছে। বিশেষ করে সংগঠনটির নেতারা নিজেরাই বলছেন যে, তালেবান এখন আর আগের তালেবান নেই, তখন এটাই তো অনেক কিছু। আগামী দিনগুলোতে কী পরিস্থিতি হয়, সেটা দেখার জন্যই এখন ইরানকে অপেক্ষা করতে হবে বলে ফাতিমা মন্তব্য করেন।

সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। তেহরান সবসময় এই আশঙ্কার মধ্যে ছিল যে, আফগানিস্তানে অবস্থান করা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী যে কোনো সময় ইরানেও হামলা চালাতে পারে। কিন্তু তালেবান যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে দিয়েছে আফগানিস্তান থেকে। নিজের ঘরের দরজা থেকে আমেরিকা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্যরা এখন ইরানের সীমান্ত থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। এটা ইরানের জন্য একটি বিরাট স্বস্তির বিষয়। এজন্য ইরান তালেবানের প্রতি কৃতজ্ঞ।

ইরানের পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলেছে তালেবান। বিশ্বের ক্ষমতাধর এই দেশ দুটিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল শত্রু। এই রাজনৈতিক সমীকরণ ইরান ও তালেবানের সাথে দেশ দুটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলায় অবদান রেখেছে।

তবে ফাতিমা করিম খান মনে করেন, তালেবান-ইরান সুসম্পর্ক দৃশ্যমান হলেও তারা একটি ব্যাপকভিত্তিক সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে কিনা তা বলার সময় এখনও আসেনি। তেহরানের ব্যাপারে তালেবান সরকার কী নীতি গ্রহণ করে, সেটা দেখেই ইরান তার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে তার ধারণা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী সম্প্রতি বলেছেন, তালেবানের ব্যাপারে ইরান এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। যদি ইরানের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়, তাহলে তেহরান আফগানিস্তানের নতুন শাসকদেরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই সাদরে গ্রহণ করবে।

ফাতিমা বলেন, আফগানিস্তানের সাথে ইরানের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তের নিরাপত্তাকে ইরান অগ্রাধিকার দেবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ইরানও আফগানিস্তান পরিস্থিতির ওপর গভীর নজর রাখছে। ফলে তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে ইরানের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেন হবে, তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।