মধ্য-এশিয়ার গ্রেটগেমে হেরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র


  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:২৩

আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের গতিবিধি সম্পর্কে যেসব বিশ্লেষকের সম্যক ধারণা ছিল, তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের করুণ পরিণতি কোনো বিস্ময়ের সৃষ্টি করেনি। তবে, মার্কিন প্রশাসন সবসময় এসব বিশ্লেষককে এড়িয়ে গেছে এবং নানা ধরনের উপহাস করা হয়েছে তাদেরকে নিয়ে।

তালেবানের কাছে কাবুলের পতনের পর এ ঘটনািিট নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। বিস্ময় সৃষ্টিকারী এই ঘটনার পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে অনেকভাবেই। বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে ভুলটা ঠিক কোথায় হয়েছে, কী ধরনের ভুল হয়েছে।

আফগানিস্তানের পুনর্গঠন বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ইন্সপেক্টর জেনারেলের একটি প্রতিবেদন মাত্রই প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে তার সুস্পষ্ট একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশাসন আফগানিস্তানে এই বিপর্যয় থেকে কোনো মৌলিক শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। সেই ইচ্ছাও তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।

মার্কিন প্রশাসন তাদের নিজের ও সমগ্র বিশ্বের মঙ্গলের জন্য যে উত্তম কাজটি করতে পারে তা হচ্ছে- অন্তত এক দশকের জন্য বিশ্বে পুলিশের ভূমিকা পালন করা থেকে বিশ্রাম নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।

কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ আসলে তাদের সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা অবসানেরই একটি পদক্ষেপ। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক অধ্যাপক ফাওয়াদ জর্জেস সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বড় কৌশলগত বিপর্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, তালেবানের বিজয়ের মাধ্যমে পশ্চিমা সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়েছে।

তাদের মতে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যত সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, এই যুদ্ধ জন্ম দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি সন্ত্রাসীকে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ওসামা বিন লাদেনের তৈরি করা একটি ফাঁদ। যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে এই ফাঁদে পা দিয়েছে। এই যুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছতে ২০টি বছর লেগেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের দ্বিগুণ সময় লেগেছে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী এই যুদ্ধে।

কথিত এই যুদ্ধের মাধ্যমে আরেকটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে- মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্রেট গেম’-এর অবসান। যুক্তরাষ্ট্রের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, আল কায়েদার উপস্থিতি নির্মূল বা ধ্বংস করা আফগানিস্তানে ওয়াশিংটনের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। অথবা আফগানদের জন্য একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যায়নি।

তার মতে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া ও চীনের সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান বা উপস্থিতি নিশ্চিত করা। আফগানিস্তানে জাতি গঠন বা মানবিক কারণ দেখিয়ে আগ্রাসন চালানোটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি উপলক্ষ মাত্র। তাদের গোপন ও আসল উদ্দেশ্য ছিল ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট গেম ইউরেশিয়া পাওয়ার ব্লক অর্থাৎ রাশিয়া, চীন ও ইরানের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করছিল। জিওপলিটিক্স বা ভূরাজনীতির থিওরির উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার শত বছর আগে তার এই থিওরি বা তত্ত্ব দিয়ে গেছেন। তার এই তত্ত্বের সার কথা হচ্ছে- সব সময় বা অব্যাহতভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডারের সেই থিওরি যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবায়ন করার অর্থই হচ্ছে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-কে থামিয়ে দিতে হবে। কারণ, বিআরআই-এর মাধ্যমে বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রের পরিবর্তন হবে। কাজেই এটাকে রুখতে হবে। চীন, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে হবে।

সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) ইরানের আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। এসসিও একটি রাজনৈতিক কাঠামো, যার মাধ্যমে ইউরেশিয়ান এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হবে। এই রাজনেতিক কাঠামোতে ইরানের অন্তর্ভুক্তির খবরটি পশ্চিমা মিডিয়ায় কোনো গুরুত্বই পায়নি। অন্যদিকে জি-৭ নেতাদের বৈঠকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা পুনর্নির্ধারণে জো বাইডেনের ওপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চাপ সৃষ্টির খবরটি পশ্চিমা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরেকটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারির অবসান হতে যাচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘৪০ বছরের যুদ্ধ’। এর মাধ্যমে আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ও তাদের ‘প্রতিরোধ মঞ্চের’ মধ্যে খেলা শেষ হতে যাচ্ছে।

আফগানিস্তানে পরাজয়ের পর বাইডেন প্রশাসন ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধানে কী করবে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ব্যাপারে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ইরানের পারমাণবিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসা-বা না আসার ওপর। ইরানের পারমাণু কর্মসূচি নিয়ে ২০১৫ সালে দেশটির সাথে বিশ্বের ৬টি প্রভাবশালী দেশের স্বাক্ষরিত ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ) চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ফিরবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। এই চুক্তির মাধ্যমে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি মৌলিক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

ইরান চুক্তি অনেকাংশে মেনে চললেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে জেসিপিওএ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনেন। ইসরাইল ও তার সমর্থকরা চাইছে যুক্তরাষ্ট্র যেন এই চুক্তিতে আর ফিরে না আসে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। ইরান চাইছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন্টকে চুক্তির বাস্তবায়ন বা কার্যকরের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ইরানের ওপর থেক সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে রাজি নয়। ফলে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা খুবই কম।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো নিরাপত্তা কাঠামোতে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বাতিলের কথা থাকতে হবে। এছাড়া ইরান এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মতো যে সব তৎপরতা চালায়, সেগুলোও বন্ধ করতে হবে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইরানের কোনো নেতাই স্বেচ্ছায় তার দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতিগুলো পরিত্যাগ করবেন না। ইরানের এই অস্বীকৃতির কারণেই ইসরায়েল শিয়া মুসলিম প্রধান দেশটির মিত্রদের অবস্থানে বারবার বোমা হামলা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে গাজা ভূখণ্ড, লেবানন ও সিরিয়ায় বিভিন্ন সময়ে হামলা করে আসছে ইসরায়েল। ইরানের পরমাণু স্থাপনাতে হামলা চালানো হচ্ছে। একইসঙ্গে ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রি জোরদার করেছে।

বিরাজমান সার্বিক এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে অল্প কয়েকটি পথ খোলা আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

এক্ষেত্রে প্রথম পথটি হতে পারে- বাইডেন চীন ও তার বিআরআই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ইউরোপকে সংগঠিত করতে পারেন। কিন্তু এর ফলে আন্তঃমহাদেশীয় উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে ইউরোপ বাইডেন প্রশাসনের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত ও হতাশ হয়ে আছে। অন্যদিকে করোনা মহামারির কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চীনের সাথে বাণিজ্য অব্যাহত রাখা ইউরোপের জন্য খুবই জরুরি। চীনা পণ্যের চালান বাধাগ্রস্ত হোক, তা চাইবে না ইউরোপ। এ-কারণে চীনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মেলাতে রাজি হবে না ইউরোপ।

দ্বিতীয় পথ হতে পারে- বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যকে আবার অগ্নিগর্ভ করে তুলতে পারেন। শুরু করতে পারেন নতুন যুদ্ধ। এর মাধ্যমে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সম্প্রসারণ পরোক্ষভাবে বাধগ্রস্ত করা যাবে। কিন্তু এটি বাইডেনের জন্য উত্তম কোনো পথ হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন না। কেননা, দুই দশকের নিস্ফল আফগান যুদ্ধ নিয়ে ক্ষুব্ধ মার্কিন জনগণ। নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোকে তারা মেনে নিতে চাইবেন না।

বাইডেনের জন্য তৃতীয় পথটি হতে পারে- চীন ও রাশিয়াকে তাদের নিজ নিজ সমস্যা নিয়ে বেশি ব্যস্ত রাখা। এক্ষেত্রে ইউক্রেন, সাইবার যুদ্ধ, জিনজিয়াং, তাইওয়ান ইত্যাদি ইস্যুকে কাজে লাগাতে পারেন তিনি। এ পথটিই তার জন্য উত্তম পথ হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কেননা, এর মাধ্যমে স্থানীয় সংঘাত জোরালো হয়ে উঠবে। চীন ও রাশিয়া তাদের নিজস্ব সমস্যা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাবে।

চতুর্থ ও শেষ পথটি হতে পারে- বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও উদারনৈতিকতাবাদ সম্প্রসারণে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি ভূমিকা গুটিয়ে ফেলা। তার পরিবর্তে নিজ দেশের উন্নয়ন ও জাতি গঠনে সব সম্পদ বিনিয়োগ করা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এটি করতে পারলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে ফিরে আসবে। আবার হয়তো দেশটি বিশ্ব নেতৃত্বের আসন ফিরে পাবে।