তুরস্ক আবার ভূরাজনীতির কেন্দ্রে


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৪৯

তুরস্ক আবার ভূরাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছে। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আঙ্কারার কদর আরও বেড়েছে। তবে এর আগেই বৈরী কয়েকটি দেশ তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর সর্বশেষ উদাহরণ তুরস্কের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আর্মেনিয়া। এর আগে সৌদি আরব ও মিসরও আঙ্কারার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেওয়ার পর তুরস্কের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো এখন আফগানিস্তান ইস্যুতে তুরস্কের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুনরায় চালু করা পশ্চিমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, এখনো তাদের অনেক নাগরিক এবং আফগান সহযোগী আটকা পড়ে আছে। এ ঘটনা তুরস্ককে আন্তর্জাতিক কূটনীতির স্পটলাইটে নিয়ে এসেছে।

ন্যাটো বাহিনীর অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন এই বিমানবন্দরটি সুরক্ষিত রাখা ছিল তুর্কি সৈন্যদের দায়িত্বের মূল অংশ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যপ এরদোয়ান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে গত জুনের বৈঠকেও এই বিমানবন্দর নিয়ে আলোচনা হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয় আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর বিমানবন্দরটি সুরক্ষিত করার দায়িত্ব নেবে তুর্কি বাহিনী ।

তালেবান বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু করার জন্য তুরস্ক এবং তার ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারের শরণাপন্ন হয়েছে। মনে হচ্ছে, তুর্কি সরকার বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাইরেও আফগানিস্তানে তার সম্পৃক্ততা বিস্তৃত করতে চাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকার করছে, তুরস্ক ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ কারণেই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস সম্প্রতি তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর সঙ্গ দেখা করেন। ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গও সংঘাত মোকাবিলায় তুরস্ককে মূল নিয়ামক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক পশ্চিমা পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে তুরস্ক তালেবানদের সঙ্গে আলোচনায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিবিসি বলছে, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ইসলামী শাসকদের প্রত্যাবর্তনের পর বিশ্বের বড় শক্তিগুলো এখন ঠেলাঠেলি করছে কীভাবে দেশটির ওপর প্রভাব খাটানো যায়। এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম বিশ্বের দুটি দেশ গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী এবং সহায়তাকারী হিসেবে সামনে এসেছে। এগুলো হলো কাতার এবং তুরস্ক।

তালেবানের সঙ্গে তারা সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সেটাকে তারা এখন পুঁজি করে ফল তুলছে। দুটি দেশই আফগানিস্তানে তাদের জন্য নতুন সুযোগ দেখতে পাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী আন্দোলনগুলোর সঙ্গে কাতার এবং তুরস্কের ঘনিষ্ঠতা আছে। এ নিয়ে মিসর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তাদের প্রায়শই উত্তেজনা তৈরি হয়। এই তিনটি দেশের স্বৈরাচার সরকার ইসলামী আন্দোলনকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবান যেভাবে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, তা আসলে রাজনৈতিক ইসলামের পুনরুত্থান। সরকার ব্যবস্থা এবং সমাজকে তারা ইসলামী আইন অনুযায়ী পুনর্গঠন করতে চায়। এখন পর্যন্ত এটি কেবল আফগানিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকলেও ভবিষ্যতে এটা মধ্যপ্রাচ্যেও দেখা যাবে। আরব বসন্তের পর গত দশ বছর ধরে এই অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ ইসলামী দল এবং তাদের বিরোধীদের মধ্যে হাতবদল হচ্ছে।

তুরস্কের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক এবং জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে। তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কিছু মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে তুরস্ক ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা গোয়েন্দা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। তুরস্ক একই সঙ্গে তালেবানের সহযোগী পাকিস্তানেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র।

সম্প্রতি কাবুল বিমানবন্দরে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে তুরস্কের কর্মকর্তারা তালেবানের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন। আলোচনার একটি বিষয় ছিল ভবিষ্যতে কীভাবে কাবুল বিমানবন্দর পরিচালনা করা হবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গত সপ্তাহে তালেবানের সঙ্গে তুরস্কের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল অনেক ব্যাপক।

এক সংবাদ সম্মেলনে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, আফগানিস্তানে ঐক্যের জন্য তুরস্ক সব ধরণের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।

ইস্তাম্বুলের আলতিনবাস ইউনিভার্সিটির আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমেত কাসিম হান মনে করেন, তালেবানের সঙ্গে এভাবে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কিছু সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। আফগানিস্তাতাদের অনেক আন্তর্জাতিক ত্রাণ এবং বিনিয়োগ দরকার হবে। তুরস্ক হয়তো এক্ষেত্রে নিজেকে জামিনদার, মধ্যস্থতাকারী এবং সহায়তাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। তুরস্ক রাশিয়া বা চীনের চাইতেও বিশ্বস্ত এক মধ্যস্থতাকারী, যারা এখনো কাবুলে তাদের দূতাবাস খোলা রেখেছে।

তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর অনেক দেশই তাদের সঙ্গে কিছু একটা সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছে, বিশেষ করে দোহা চ্যানেলের মাধ্যমে। তবে যেসব দেশ আফগানিস্তানে তাদের সরাসরি উপস্থিতির মাধ্যমে এক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, তুরস্ক তার অন্যতম।

বিবিসি বলছে, আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার পররাষ্ট্রনীতির দাবার বোর্ডটি আরও বড় করতে পারবেন। তুরস্ক মনে করে মুসলিম বিশ্ব তার একটি ব্যতিক্রমী অবস্থান আছে। এর ভিত্তি হচ্ছে তুরস্কের অতীত ইতিহাস, খেলাফতের দেশ হিসেবে তার অটোমান ঐতিহ্য।

অধ্যাপক আহমেত কাসিম বলেন, এখন কাতার এবং তুরস্কই বাকি বিশ্বের অনেক দেশের হয়ে তালেবানের সঙ্গে কথা বলছে।

এদিকে আর্মেনিয়া বলেছে, প্রায় তিন যুগ পর দীর্ঘদিনের শত্রু তুরস্কের সঙ্গে সীমান্ত আবার চালু করতে আগ্রহী। তারা আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের দিকে এগিয়ে যেতে ইচ্ছুক। গত আগস্টে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পশিনিয়ান বলেছেন তিনি পূর্বশর্ত ছাড়াই তুরস্কের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য প্রস্তুত।

দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৯৩ সালে প্রথম নাগারনো-কারাবাখ যুদ্ধের পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গত বছর একই স্থান নিয়ে যুদ্ধে আজারবাইজানকে তুরস্ক সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা দেয়। এতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আর্মেনিয়া।

আর্মেনিয়া তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবেলা করতে আগ্রহী এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিঘর হিসাবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। আর্মেনিয়া সম্প্রতি তার্কিশ এয়ারলাইনসকে সরাসরি তাদের আকাশপথ ব্যবহার করে আজারবাইজানের বাকুতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে সম্প্রতি ফোনালাপ করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতা মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান। দুদেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের আভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে এই ফোনালাপকে।

এক বিবৃতিতে এরদোয়ানের অফিস জানিয়েছে, দুই নেতার মধ্যে আলোচনায় আঞ্চলিক ও দুদেশের মধ্যেকার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে। এর আগে আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাহউন বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানের সঙ্গেও এরদোয়ানের বৈঠক হয়েছিল। সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি তুরস্কে আমিরাতের বিপুল বিনিয়োগ প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে আমিরাতের দ্বন্দ্ব রয়েছে। যেমন আরব বসন্তের পক্ষে তুরস্কের অবস্থান, নতুন গণতন্ত্রে তুরস্কের সমর্থন এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃত্বাধীন সরকারকে আকাঙ্কার সমর্থনে ভীত হয়ে পড়ে আমিরাত।

এসব সত্ত্বেও গত আগস্টে তাহউনের সঙ্গে বৈঠককে দুদেশের মধ্যে নতুন যুগের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেছেন তুরস্কের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যকার মতভেদ ভুলে তাদের ভিন্ন এক পথচলা শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের অধীন আবুধাবি অনেকটা বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন তুরস্কের কর্মকর্তারা। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকেও আরেক হুমকি বলে মনে করে আমিরাত। তুরস্কের আরেক কর্মকর্তা বলেন, তেহরানের বিরুদ্ধে আমিরাত একা দাঁড়াতে পারবে না। এ অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে আমিরাত অনেকটা বিচলিত বোধ করছে।

এদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে আমিরাতের সম্পর্কেও কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারি বাড়তে থাকায় গত মাসে আামিরাতের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সৌদি। এতে কদর বেড়েছে তুরস্কের।

এর আগে গত মে মাসে তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে কয়েক বছর পর প্রথম আনুষ্ঠানিক কূটনীতিক বৈঠকে উভয়পক্ষের মাঝে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তুরস্কের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। সৌদি আরবও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আমিরাত, সৌদি আরব ও মিসর ও আর্মেনিয়ার সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কের উন্নতি হলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পাওয়ারহাউস হিসেবে তুরস্কের আগের অবস্থান দ্রুতই ফিরে আসবে।