যুক্তরাষ্ট্রের নজর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়


  • মোতালেব জামালী
  • ৩১ আগস্ট ২০২১, ১৪:৪০

যুক্তরাষ্ট্র কেন এভাবে আফগানিস্তান ছাড়ল, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কোনো কোনো সমালোচক যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারকে ‘পরাজয়’, আবার কেউ কেউ ‘লজ্জাজনক পশ্চাদপসরণ’ হিসেবে অভিহিত করছেন। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, তালেবানকে নির্মূল করা এবং স্থিতিশীলতা ও উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেই দেশটিতে আগ্রাসন চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু গত ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করেও তলেবানের কিছুই করতে পারেনি মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। বরং সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে তালেবানের সাথেই যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তি করতে হয়েছে। এটি গত কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও সামরিকনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় ব্যর্থতা।

এই ব্যর্থতা একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোতেও এটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এসব দেশের মধ্যে এই আশঙ্কা তৈরি হতে পারে যে, চীনের হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো সময় তাদেরকেও ত্যাগ করতে পারে। বিশেষ করে তাইওয়ান ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর মধ্যে এই আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠতে পারে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিশ্বের কোনো অংশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের অর্থ হচ্ছে তারা পৃথিবীর অন্য কোনো অংশে নিজেদেরকে জড়িত করবে। নতুন কোনো পরিকল্পনা নিয়ে তারা অগ্রসর হবে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পরিকল্পনারই অংশ। চীনকে মোকাবিলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সামরিক অবস্থান সংহত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

মার্কিন কর্মকর্তারাও বলছেন যে, এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ করা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে একসময় আফগানিস্তান ছাড়তেই হতো। সেই কাজটি তারা আগেই করে ফেলছেন।

ইউসুফ ইসহাক ইন্সটিটিউ রিসার্চ সেন্টার ইন সিঙ্গাপুর আইএসইএএসের এর গবেষক লী হং হিয়েপ মনে করেন, আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি সেনা প্রত্যাহার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজের তেমন একটা ক্ষতি করবে না। বরং আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ফলে এই অঞ্চলের দেশগুলো আরও উপকৃত হবে। তখন এই অঞ্চলের দিকে যুক্তরাষ্ট্র আরও ভালোভাবে নজর দিতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম সফর করেছেন। তার এই সফর এসব দেশকে এই বার্তাই দেবে যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে আছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দেওয়ার নীতি ২০১০ সালেই গ্রহণ করেছিলেন। এতদিন তা কার্যকর করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত ফেব্রুয়ারি মাসে সারা বিশ্বে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাড়ানোর জন্য পেন্টাগনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এ মাসের শেষের দিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ঘোষণা দেন, চীনই হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর অর্থ হচ্ছে- আগামীতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা চরম আকার ধারণ করবে। চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যই প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করেছেন।

বর্তমানে সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এসব ঘাঁটিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম। পাশাপাশি ১৫০টি দেশে এক লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছেন। নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বাইডেন বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি সেনা প্রত্যাহার সেই পরিল্পনারই অংশ। একইসঙ্গে তারা যুদ্ধপ্রস্ততির যাবতীয় সরঞ্জাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কেন্দ্রিভূত করছে। জো বাইডেনের প্রশাসন চীনকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করার জন্য ওবামার সময় নেওয়া নীতিকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।

গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্ব বেশি ছিল। কিন্তু এখন আর তা থাকছে না। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছেন। চীনের মোকাবিলায় যে সামরিক প্রস্ততি নেওয়া দরকার, তা তিনি নিচ্ছেন। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমাচ্ছেন। এ কাজটি শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নজর চীন কেন্দ্রিক অঞ্চলের দিকে নিবদ্ধ হবে। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি কমানো ও সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহার শুরু করা হয়েছে। কাজটি শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্যকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। অনেক সেনা মোতায়েন ও বোমাবর্ষণের কাজটিও করতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে আসেনি। এই অঞ্চল থেকে সামরিক উপস্থিতি কমানোর এটি একটি কারণ।

এরইমধ্যে জর্ডান, কুয়েত, ইরাক ও সৌদি আরব থেকে ৮টি প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম সরিয়ে আনা হয়েছে। সৌদি আরব থেকে টার্মিনাল হাই আলটিচিড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) সিস্টেম নামের অ্যান্টি রকেট সিস্টেম ও কয়েক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান সরানো হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে সৌদি আরবে অবস্থান করা হাজারখানেক মার্কিন সেনাও।

তবে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহারে বেশ কিছু জটিলতাও আছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের মিত্র দেশ বিশেষ করে তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ উপকূলীয় ছোট দেশগুলো তাদের নিরাপত্তার জন্য অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে শঙ্কিত ছিল। এরপর ইরাক ও বর্তমানে ইরান নিয়ে নিরাপত্তা শঙ্কার মধ্যে আছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরবের আশঙ্কা, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইরান আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠবে। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার কূটনৈতিক টীম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে যে, তাদের দেশ থেকে সামরিক উপস্থিতি কমানো হলেও যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশকে একেবারে পরিত্যাগ করবে না। তাদের নিরাপত্তার দিকে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই নজর রাখবে।

বাইডেন এসব দেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে তাদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত এপ্রিলে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে স্টেলথ জঙ্গি বিমানসহ ২৩ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেন। এর ফলে একদিকে সেনা প্রত্যাহার ও সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রিও বাড়ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ ও অবস্থান করা নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেইতে নানা বিতর্ক রয়েছে। এসব দেশ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের অবস্থানকে ভালো চোখে দেখে না। এমনকি ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর এসব দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো কিংবা কাউকে ক্ষমতায় বসানোর চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসেছে। মিয়ানমারে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির ব্যাপারে ওয়াশিংটন খুব একটা মাথা ঘামায়নি। এমনকি ভিয়েতনাম ও লাওসে কমিউনিস্ট সরকার পরিবর্তনের কথাও কখনও ভাবেনি ওয়াশিংটন। বরং ভিয়েতনাম এখন এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ।

ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও কিছুটা টানাপড়েন সৃষ্টি হলেও এখন তা আবার আগের পর্যায়ে চলে গেছে। ফিলিপাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিওদোরো লকসিন জুনিয়র টুইটারে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের প্রশংসা করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপাইন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ওয়াশিংটনের সাথে ভিজিটিং ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট আমরা পুনর্বহাল করেছি। এর ফলে ফিলিপাইনের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের আসা-যাওয়া অব্যাহতভাবে চলবে।

অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় স্বৈরশাসন চললেও এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না যুক্তরাষ্ট্র। বরং এসব দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব কীভাবে টিকে থাকবে, সেদিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই অঞ্চলে চীনের সম্প্রসারণবাদ কীভাবে ঠেকানো যায়, সেই কৌশল নিয়ে কাজ করছে ওয়াশিংটন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রকে তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা দিতে হবে না। এই অঞ্চলের নিরাপত্তার দিকটি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে- চীন যাতে এসব দেশের বাজার দখল করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।

দক্ষিণ চীন সাগরে নৌসীমা নিয়ে এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে চীনের বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। বেইজিং তাইওয়ান দখল করে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছে। এ-কারণেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে তার সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। তারা জার্মানি, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোর সাথে জোট গড়ে সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরে ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ নামে নৌমহড়া দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনকে মোকাবেলার টার্গেট নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র যেমন তড়িঘড়ি আফগানিস্তান ছাড়ল, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যও ছাড়ছে। চীনের আচরণকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেদিকেই এখন সবার নজর থাকবে।