কারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তালেবানকে


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৪ আগস্ট ২০২১, ১৪:০৬

২০০১ সালে পশ্চিমা সামরিক অভিযানে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠি তালেবান। মাদরাসা ছাত্রদের নিয়ে ১৯৯০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে। কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় এসেছে তাদের। তালেবানের এই অদম্য লড়াই করার ক্ষমতার অন্যতম কারণ সংগঠনটির নেতৃত্ব।

৫০ জন ছাত্রকে নিয়ে মোল্লা ওমরের প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠিটি ধীরে ধীরে এত বিশাল হয়ে ওঠে যে, এক সময় দেশ শাসন শুরু করে। শুরুর দিকে মাদরাসার ছাত্ররাই ছিল এর প্রধান জনশক্তি। আশির দশকে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সোভিয়েত বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেয়া মুজাহিদীনদের একটি বড় অংশও পরবর্তীতে যোগ দিয়েছিল তালেবানে। ১৯৯৬ সালে তারা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং দেশজুড়ে শরীয়া আইন চালু করে। যদিও বিরোধী পক্ষ ও পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানের কট্টরপন্থাকে বাড়বাড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করত।

বিশাল এই গোষ্ঠিটির প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মাদ ওমর। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যিনি আত্মগোপনে চলে যান। মোল্লা ওমরকে খুঁজে পেতে যুক্তরাষ্ট্র কোন চেষ্টাই বাদ রাখেনি; কিন্তু তার অবস্থান এতটাই গোপনীয় ছিল যে, মৃত্যুর খবরটিও কেউ জানতে পারেনি। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই মোল্লা ওমরের মৃত্যু হয় ২০১৩ সালে। দুই বছর পর ২০১৫ তার ছেলে সেই তথ্য প্রকাশ করার আগে সারা দুনিয়া অন্ধকারেই ছিল এই তালেবান নেতা সম্পর্কে।

প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পরও তালেবানের তৎপরতা থামেনি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে গ্রুপটি তাদের সদস্যদের সংগঠিত রেখেছে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু করতেই তারা আবার বিভিন্ন এলাকা দখলে অভিযান শুরু করে এবং ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চল তাদের দখলে চলে গেছে। বর্তমানে তালেবানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা। ইসলামিক আইনবিষয়ক একজন স্কলার আখুনজাদা। তালেবানের সর্বোচ্চ ব্যক্তি তিনি। সংগঠনটির রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণী ক্ষমতা এই নেতার।

২০১৬ সালে তালেবানের তৎকালীন নেতা আখতার মনসুর যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পর আখুনজাদা তালেবানের দায়িত্ব নেন। ওই বছর মে মাসে তালেবান প্রধান হওয়ার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এর আগে দীর্ঘ ১৫ বছর পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুচলাক শহরের একটি মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় পড়াতেন তিনি। এর আড়ালে গোপনে তালেবানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। পরবর্তীতে সেখানে তার ছাত্র ও সহযোগীরা এ তথ্য জানিয়েছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে।

আখুনজাদা ১৯৬১ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। পশতুন জাতির নুরজাই গোত্রের একটি পরিবারে জন্ম তার। তার বাবা মোল্লা মোহাম্মাদ আকন্দ ছিলেন একজন আলেম। স্থানীয় মসজিদে ইমামতিও করতেন তিনি। পারিবারিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। আফগানিস্তানের সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময় আরো অনেক পরিবারের মতো আখুনজাদার পরিবারও পাকিস্তানের কোয়েটায় উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়।

১৯৯৬ সালে তালেবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর আখুনজাদা প্রথমে ফারাহ প্রদেশে একটি আধাসামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মোল্লা ওমর তাকে কান্দাহারে ১ লাখ শিক্ষার্থীর একটি মাদ্রাসার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। যোদ্ধা হিসেবে যতটা খ্যাতি তার চেয়ে আখুনজাদা একজন স্কলার হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন আফগানিস্তানে। যে কারণে কিছুদিন পর তাকে শরীয়া আদালতের প্রধান বিচারক নিযুক্ত করা হয়। মোল্লা ওমর ফতোয়া বিষয়ক যে কোন ইস্যুতে তার পরামর্শ নিতেন বলে জানা যায়।

আখুনজাদার অবস্থান নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলেন, মার্কিন সামরিক অভিযানের পরও তিনি আফগানিস্তানেই লুকিয়ে ছিলেন। আবার কেউ বলেন, তিনি পাকিস্তানের আফগান সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় ছিলেন। হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদার বর্তমান বয়স ৬০ বছরের আশপাশে বলে ধারণা করা হয়।

বর্তমানে তালেবানের আরেক উল্লেখযোগ্য নেতা মোল্লা মোহাম্মাদ ইয়াকুব। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মাদ ওমরের ছেলে এই ইয়াকুব। স্থানীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, মোল্লা ইয়াকুব বর্তমানে আফগানিস্তানেই আছেন এবং বর্তমানে গ্রুপটির সামরিক অভিযানের তদারকি করছেন তিনি।

আলজাজিরার তথ্য মতে, ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল; কিন্তু যুদ্ধের মাঠে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ও বয়স কম হওয়ার কারণ দেখিয়ে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। এক তালেবান কমান্ডার জানিয়েছেন, আখতার মনসুর নিহত হওয়ার পর ২০১৬ সালে যে বৈঠকে তালেবানের পরবর্তী প্রধান নিযুক্ত করা হয় সেখানে, ইয়াকুব নিজেই তার বদলে আখুনজাদাকে তালেবানের প্রধান নিযুক্ত করার সুপারিশ করেন। ইয়াকুবের বর্তমান বয়স ৩০ এর কিছু বেশি।

২০১৫ সালে পিতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ইয়াকুব আলোচনায় আসেন। আফগানিস্তানে জন্ম হলেও পাকিস্তানের করাচি শহরের বিভিন্ন মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। ২০২০ সালের মে মাসে ইয়াকুবকে তালেবানের মিলিটারি অপারেশন চীফ বা সামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।

মোল্লা ইয়াকুব বরাবরই যুদ্ধ অবসান করে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানের শান্তি চূক্তিতে রাজি হওয়ার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। চুক্তি হওয়ার পর মার্কিন সেনা অবস্থানের ওপর হামলা না করার অঙ্গীকার তিনি পালন করেছেন। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই তাকে তুলনামূলক উদারপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

তবে সামরিক প্রধান হিসেবে তার দক্ষতা নিয়েও যে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই তা প্রমাণিত হয়েছে এবারর তালেবানের সামরিক অভিযানে। দুই মাসেরও কম সময়ে তারা দখল করে নিয়েছে দেশটির সিংহভাগ এলাকা।

তালেবানের আরেক শীর্ষ নেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানী। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী যুদ্ধের বিখ্যাত মুজাহিদীন কমান্ডার জালালউদ্দিন হাক্কানীর ছেলেন তিনি। বর্তমানে তালেবানের হাক্কানী নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজউদ্দিন। এই গ্রুপটি পাক-আফগান সীমান্ত এলাকায় তালেবানের আর্থিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা করে।

আত্মঘাতি বোমা হামলায় খ্যাতি আছে হাক্কানী নেটওয়ার্কে। এছাড় আফগানিস্তানে বড় গত এক দশকে বড় কিছু হামলার জন্য দায়ী করা হয় তালেবানের এই গ্রুপটিকে। এর মধ্যে রয়েছে, কাবুলের শীর্ষস্থানীয় একটি হোটেলে হামলা, সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে হত্যাচেষ্টা ও ভারতীয় দূতাবাসে আত্মঘাতি হামলা। সিরাজউদ্দিন হাক্কানীর বয়স ৫০ এর আশপাশে বলে মনে করা হয়। তবে তার অবস্থান সম্পর্কে কোন ধারণা নেই গোয়েন্দাদের কাছে।

মোল্লা আবদুল গনি বারাদার তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিনি। বর্তমানে তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান আবদুল গনি। দোহায় তালেবানের যে দলটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক বছরেও বেশি সময় ধরে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে তার উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বারাদার।

তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের সবচেয়ে বিশ^স্ত কমান্ডারদের একজন হিসেবে মনে করা হয় আবদুল গনি বারাদারকে। তালেবানের শাসনামলে তিনি প্রাদেশিক গভর্নর, সেনা কমান্ডার, ডেপুটি সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্টারপোলের নথি অনুযায়ী, তিনি তালেবান সরকারের প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন।

২০১০ সালে করাচি থেকে তাকে গ্রেফতার করেছিল পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। ৮ বছর জেল খাটার পর ২০১৮ সালে তিনি মুক্তি পান। শোনা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশেই তাকে মুক্তি দিয়েছিলে পাকিস্তান। মুক্তির পর থেকে দোহায় তালেবানের হয়ে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হন তিনি। তালেবানের আরেক শীর্ষ নেতা ও সাবেক তালেবান সরকারের ডেপুটি মিনিস্টার শের মোহাম্মাদ আব্বাস স্টানিকজাই।

প্রায় এক দশক ধরে কাতারের রাজধানী দোহায় বসবাস করছেন শের মোহাম্মাদ আব্বাস। ২০১৫ সাল থেকে দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আফগান সরকারের সাথে তালেবানের শান্তি আলোচনার অংশ ছিলেন তিনি এবং তালেবানের কূটনৈতিক প্রতিনিধি দলের হয়ে বিভিন্ন দেশে সফরও করেছেন স্টানিজকাই।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, স্টানিকজাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন পাকিস্তানে। এরপর সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের তালেবান প্রশাসনে তিনি উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালে তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে বিল ক্লিনটন প্রশাসনের সাথে আলোচনার জন্য যে প্রতিনিধি দলটি যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিল, স্টানিকজাই ছিলেন তার প্রধান। ২০১২ সালে দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক অফিস খোলার সময় তিনি সেখানে চলে যান। বর্তমানে সেখানেই আছেন তিনি।

তালেবানের শান্তি আলোচনা দলের প্রধান আবদুল হাকিম হাক্কানি। তালেবানের সাবেক ছায়া প্রধান বিচারপতি আবদুল হাকিম বর্তমানে সংগঠনটির প্রভাবশালী ধর্মীয় কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তালেবান প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজনদের একজন হিসেবে মনে করা হয় তাকে।

তালেবানের পক্ষে তিনি দোহায় শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধর্মীয় আইন বিষয়ে একজন পন্ডিত আবদুল হাকিম তালেবান সদস্যদের কাছে খুবই সম্মানিত একজন নেতা।