স্পাইওয়্যার : ইসরায়েলের কূটনৈতিক হাতিয়ার


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৩ আগস্ট ২০২১, ১৪:৫৭

ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য ফাঁস হয়েছে। সারা বিশ্বে অন্তত ২০ হাজার মানুষের ওপর নজরদারি করা হয়েছে এই স্পাইওয়্যার দিয়ে, যার মধ্যে আছেন রাষ্ট্রপ্রধান, সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা। এ ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। অনেকদিন ধরেই ইসরায়েলের তৈরি মিলিটারি টেকনোলজিকে বিশিষ্টজনদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহারের অভিযোগ আছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের কাছে এসব বিক্রি করে কূটনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে ইসরায়েল।

ইসরায়েল দ্রুত পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারি খতিয়ে দেখতে একটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করেছে যার মধ্যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছাড়াও রয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এসপিওনাজ টিমের সদস্যরা। তবে বোঝা যাচ্ছে এ বিষয়ে অগ্রগতি সামান্যই। অগ্রগতি কিছু হলেও তা যথা সময়ে হচ্ছে না। পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে যে বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, তা ঠেকাতে আরো নাটকীয় কিছু সিদ্ধান্ত দরকার ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। সারা বিশ্বেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই স্পাইওয়্যার নিয়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারাও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন এ বিষয়ে।

ইসরায়েলি পুতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে এই স্পাইওয়্যার সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে, যা আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর মেসেজ, ছবি, ইমেইল পাচার করতে যেমন সক্ষম, তেমনি কল রেকর্ড এবং গোপনে মাইক্রোফোন চালুও রাখতে পারে।

২০১৬ সালে এনএসও গ্রুপ এই সফটওয়্যার প্রথম প্রস্তুত করে, তবে তখন তার নাম ছিল কিউ সুইট। পরে তা পরিবর্তন করে নাম দেওয়্যা হয় ট্রাইডেন্ট এবং তারও পরে নামকরণ হয় পেগাসাস। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘যদি কোনো স্মার্টফোনে পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে।”

২০১৯ সাল থেকে সীমিত পরিসরে এই সফটওয়্যার বিক্রি শুরু করে এনওএস গ্রুপ। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই ছিল এর প্রধান ক্রেতা। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, বর্তমান বিশ্বে অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে পেগাসাসকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হয়।

এই ঘটনা নিয়ে বিশ্বে কয়েকটি নামিদামি সংবাদমাধ্যমও অনুসন্ধান চালিয়েছে। এই তালিকায় ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের ওয়্যাশিংটন পোস্ট, ফ্রান্সের লা মন্ডে, ইসরায়েলের হারেৎজের মতো পত্রিকা। এসব পত্রিকার রিপোর্টে উঠে এসেছে কিভাবে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দেশের নিপীড়ক সরকারগুলোর কাছে এই সফটওয়্যার বিক্রি করা হয়েছে। তালিকায় আছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো, ভারত, রুয়ান্ডা, হাঙ্গেরির নাম।

কোন কোন দেশের সরকার পেগাসাস কিনেছে, গোপনীয়তার শর্তের অজুহাতে সে তথ্য এনএসও প্রকাশ করেনি। তবে সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় অন্তত ৪৫টি দেশে পেগাসাসাস ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ওয়্যাশিংটন পোস্ট। এই স্পাইওয়্যার দিয়ে কোনো কোনো দেশে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর ফোনেও আড়ি পাতা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো। যদিও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসও এই খবর অস্বীকার করেছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অ্যাডভান্সড টেননোলজি সেক্টরের উল্লেখযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান এনএসও। সাইবার টুলস এন্ড ওয়্যারফেয়ার সেক্টরের গবেষণা ও উন্নয়নে ইসরায়েল এখন বিশ্বসেরা। ইসরায়েলি মিলিটারি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শক্তি বৃদ্ধিতে অস্ত্রের পাশাপাশি দ্রুত এই সেক্টরের উন্নয়ন করে চলেছে দেশটি। পাশাপাশি তার কিছু কিছু ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

চারপাশে মুসলিম দেশ বেষ্টিত ইসরায়েল সব সময়ই একটি অবরুদ্ধ মানসিকতা পোষণ করে। যে কারণে বৈরী রাষ্ট্রগুলোর ওপর ছড়ি ঘোড়াতে তারা নিজেদের প্রয়োজনেই এসব প্রযুক্তি তৈরি করে। এ জন্য তারা গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেট ছাড়াও সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপ ইউনিটের জন্য তৈরি করেছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কিছু সফটওয়্যার।

এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ‘ইউনিট এইট টু জিরো জিরো’ নামের একটি বিভাগ। টার্গেটকৃত লোকদের ওপর নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ, সেই তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ ও গবেষণা এবং বিশেষ অপারেশনে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করা এই বিভাগের কাজ। মূলত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য এর কৌশলগুলোর নকশা করা হয়েছিল। কিন্তু গত দুই দশকে ‘এইট টু জিরো জিরো’ তৈরি করেছে অনেকগুলো সাইবার অফেন্সিভ টুলস। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের সাথে যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে প্রবেশ ও তথ্য চুরির কাছে ব্যবহৃতও হয়েছে এর কিছু সাইবার টুলস।

এছাড়া ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধেও এসব ব্যবহার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই সংস্থার বেশ কয়েকজন সাবেক সেনা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসব সফটওয়্যারকে রাজনৈতিক নিপীড়নের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। তবে ‘এইট টু জিরো জিরো’ একা নয়, ইসরায়েলের আরো কিছু দুর্ধর্ষ সাইবার ইউনিট রয়েছে। যাদের মধ্যে আছে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের টেকনোলজিক্যাল ব্রাঞ্চ, যা ইউনিট এইট ওয়্যান নামে পরিচিত। এছাড়া আছে কমিউনিকেশন কর্পস নামের একটি ইউনিট যারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অনলাইন কার্যক্রমকে সুরক্ষিত রাখতে কাজ করে।

এ-রকমই একটি সাইবার ইউনিটের সাবেক দুই কর্মকর্তা শালেভ হুলিও এবং ওমরি লাভি গড়ে তুলেছেন এনএসও নামের প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি দায়িত্বে থাকার সময় অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন তারা সিভিল মার্কেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে এসব প্রযুক্তি। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জমা রফতানিকে উৎসাহিত করার যে কর্মসূচি রয়েছে তার অধীনেই মিসাইল কিংবা ট্যাংকের মতো উৎসাহ পেয়েছে সাইবার প্রযুক্তি ও বিভিন্ন নজরদারি সফটওয়্যার রফতানি।

এসব প্রযুক্তি রফতানির পেছনে যে শুধুই ইসরায়েলি অর্থনীতিকে উন্নত করার চিন্তা রয়েছে তা নয়, এটিকে একটি কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। অস্ত্র ও এসব প্রযুক্তি বিক্রির মাধ্যমে ইসরায়েল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে। দেখা গেছে, যেসব দেশের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, তাদের কাছেও বিক্রি করা হয়েছে এসব নজরদারির সামগ্রী। ফলে তাদের সাথে একটি বোঝাপড়া গড়ে উঠছে ইসরায়েলের। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন পছন্দ করে না এমন দেশের কাছেও এটি বিক্রি করেছে তারা। যা শুধুই ইসরায়েলের সামরিক ও কূটনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এই প্রক্রিয়ায়ই ইসরায়েল তার গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মাধ্যমে আবর দেশগুলোর সাথে প্রথমে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করেছে, পরবর্তীতে যা প্রকাশ্য সম্পর্কে রূপ নিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরবের নাম রয়েছে এই তালিকায়।

ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এই বাণিজ্যের সমীকরণটি খুব সহজ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর অনুমতি দেয়, এমনকি উৎসাহিতও করে। এরপর এনএসও বা সেলেব্রেটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এসব সরঞ্জাম বিক্রি করে বিভিন্ন দেশের একনায়ক বা নিপীড়ক সরকার কিংবা তাদের বাহিনীর কাছে। এভাবে ধীরে ধীরে ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে দেশটির। এরপর তারা ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে বা গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে তেল আবিবকে সহায়তা করে। যেমন আজারবাইজানের সরকার ইসরায়েলের কাছ থেকে এই প্রযুক্তি কিনেছে, বিনিময়ে তাদের ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলকে ইরানের ওপর গোয়েন্দাগিরির সুযোগ দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

তবে এসব ক্ষেত্রে ইসরায়েল কখনোই তার এক্সক্লুসিভ কোনো প্রযুক্তি বিদেশে বিক্রি করে না। সেগুলো রাখে শুধুমাত্র নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যবহারের জন্য। যে কারণে ইন্টেলিজেন্স কিংবা সাইবার অপারেশন বিভাগে ইসরায়েল শত্রু কিংবা মিত্র সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে। যখনই কোনো নতুন ও উন্নত সাইবার টুল আবিষ্কার হয়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তখন পুরনো টুলগুলো বিদেশে রফতানির অনুমতি দেয়। যে কারণে বলা যায়, মোসাদ, শিন বেট কিংবা অন্যান্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পেগাসাসের চেয়েও অনেক আধুনিক স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে।

পেগাসাস কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়্যার পর ইসরায়েল বিভিন্ন দিক থেকে চাপের মুখে পড়েছে। এই চাপ হয়তো তাদের নীতি ও পদ্ধতি বদলাতে বাধ্য করবে। নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে ইসরায়েলকে। আর এর জন্য প্রথমে তাদের পেগাসাসের মতো মৌলিক অধিকার হরণকারী স্পাইওয়্যার রফতানি বন্ধ করতে হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল তা করবে কি না সেটি কেউই বলতে পারে না।