কেমন তিউনিসিয়া চায় আন-নাহদা

রশিদ ঘানুশি - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৮ আগস্ট ২০২১, ১৫:১৩

তিউনিসিয়ার গণতন্ত্র রক্ষার দাবি জানিয়ে বিশ^খ্যাত নিউইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখেছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আন-নাহদার নেতা রশিদ ঘানুশি। এতে তিনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে রাজনীতিকদের ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। স্পষ্ট করেছেন গণতন্ত্রের প্রতি তার দলের অবিচল অবস্থান। ঘানুশি বলেছেন, নির্বাচিত সরকার জনগণের সব প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও স্বৈরতন্ত্র তার বিকল্প হতে পারে না।

ঘানুশি লিখেছেন, আমার সহকর্মীরা এবং আমি- সবাই গণতান্ত্রিকভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত। গত ২৬ জুলাই সকালে আমরা দেখতে পাই সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক দ্বারা তিউনিসে সংসদ ভবন অবরুদ্ধ। প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদের নির্দেশে সেখানে আমাদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগের রাতে টেলিভিশন ভাষণে অনেক পদক্ষেপের ঘোষণা করেছিলেন সাইদ। এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল নির্বাচিত আইনসভার কাজ স্থগিত করা। তিনি সংসদ সদস্যদের সংসদে দায়মুক্তি সুবিধা ছিনিয়ে নিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন এবং তাঁর হাতে বিচারিক ও নির্বাহী ক্ষমতা সংহত করেছেন। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সাইদ গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য লড়াই করা তিউনিসিয়াবাসীর পুরো এক দশকের কঠোর পরিশ্রমের ফলাফলকে উল্টে দিতে চাইছেন।

তিনি লিখেছেন, আমি বিশ্বাস করি তার কাজ অসাংবিধানিক এবং তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। আমি সংসদ ভবনের সামনে একটি বিক্ষোভ করেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং অন্যদেরকেও একই কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ রক্তপাত হতে পারে এমন কোনো সম্ভাব্য সংঘর্ষের বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম।

ঘানুশির নিবন্ধে বলা হয়, এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। আমরা এখনও অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছি। পার্লামেন্টের সবচেয়ে বড় দলের নেতা হিসেবে আমি এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়ার আশা এখনো পোষণ করছি। তবে একথা ঠিক যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্মক্ষমতা নিয়ে তিউনিসিয়ানদের অসন্তোষ বৈধ।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে, দেশটি কোভিড নাইনটিন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিপজ্জনক বৃদ্ধি দেখেছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংকট মোকাবেলায় কার্যকরভাবে লড়াই করার জন্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আমরা একটি কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম।

ইসলামপন্থী দল আন-নাহদার প্রধান লিখেছেন, এক দশকেরও বেশি আগে তিউনিসিয়ার ফল ও সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আরব বসন্ত বিক্ষোভের অনুঘটক হয়েছিলেন। তিউনিসিয়ায় তার এই পদক্ষেপগুলি পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ওই সময়টাতে দুর্নীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন এবং অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা ছিল উল্লেখযোগ্য।

ঘানুশি লিখেছেন, আজকের অস্থিরতা কিন্তু নাগরিক স্বাধীনতার জন্য নয় বরং এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অসন্তোষ। আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে বুয়াজিজি এবং হাজার হাজার তিউনিসিয়ান যেসব রাজনৈতিক কারণে সংগ্রাম করেছেন তা কখনই ভুলে যাব না। আমরা আইনের শাসন এবং ক্ষমতা পৃথকীকরণকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরির চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগত ও যৌথ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং, সর্বোপরি, আমরা ব্যালট বাক্সকে সম্মান করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

২০১৪ সালে প্রণীত তিউনিসিয়ার সংবিধান আরব বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু আজ, প্রেসিডেন্ট সাইদ তা ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। সাইদ বলেছেন, দেশে সামাজিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে এসব ব্যবস্থা সাময়িক।

বিপরীতে তার এই সিদ্ধান্তগুলি স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠার প্লেবুক অনুসরণ করে। তিনি সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, যা জাতির জন্য "আসন্ন বিপদ" হলে তাকে অসাধারণ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেয়। কিন্তু ওই অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের স্পিকারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে এবং এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যকলাপ তদারক করার জন্য সংসদের একটানা অধিবেশনে থাকবে। পার্লামেন্ট স্থগিত করে তিনি সেই শর্তকে অসম্ভব করে তুলেছেন।

প্রেসিডেন্টের এসব পদক্ষেপ তিউনিসিয়ার জনগণ এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতার পৃথকীকরণের ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো কিছু রাজনৈতিক শক্তি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এবং ইসলামপন্থীদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্যকে পুনরুজ্জীবিত করে সংবিধানবিরোধী এসব পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আমাদের দল আন-নাহদা একটি মুসলিম গণতান্ত্রিক দল। কিন্তু এখানে শুধু নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলকে দমন করা হচ্ছে না। বরং সামগ্রিকভাবে তিউনিসিয়ার গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে।

ঘানুশি লিখেছেন, সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর আঘাত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্পষ্ট এবং তীব্র নিন্দা জানানো। আরব বসন্ত থেকে বেরিয়ে আসা তিউনিসিয়াই একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ। অনেক আরবদের কাছে তাদের গণতন্ত্রের সাধনায় আশার উৎস তিউনিসিয়া।

তিউনিসিয়ায় সমস্যা নতুন নয়। তবে গভীরভাবে আবদ্ধ কাঠামোগত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই আমরা সম্মিলিতভাবে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিশাল কাজের মুখোমুখি হয়েছি । আমরা নির্বাচনি আইনের কুফল ভোগ করছি যা একটি খণ্ডিত সংসদ তৈরি করে এবং এরফলে জোট সরকার গঠন ছাড়া দেশ পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এতে আন-নাহদার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের অনেক ভালো কাজে বাধা দিয়েছে শরীকরা।

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, তিউনিসিয়ার কিছু লোক প্রেসিডেন্ট সাইদের সর্বময় ক্ষমতা দখলকে সমর্থন দিয়েছেন। দেশটিতে আরেকজন স্বৈরশাসকের উত্থানের পরিণামের কথা না ভেবেই তারা প্রেসিডেন্ট সাইদের একনায়কসুলভ পদক্ষেপে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। এই সুযোগে সাইদ রাষ্ট্রের সব অঙ্গকে অচল করে দিয়ে ডিগ্রিবলে দেশ পরিচালনা করছেন।

সেদিকে ইঙ্গিত করে ঘানুশি লিখেছেন, একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে গণতন্ত্র নির্মাণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের অগ্রগতি আশানরূপ হয়নি। কিন্তু সংবিধানকে ছিঁড়ে ফেলার এবং সমগ্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করার পক্ষে এই সংকটগুলি কোনো বৈধ কারণ নয়। এক ব্যক্তির শাসন আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়। স্বৈরশাসন ক্রমাগত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন এবং অসমতার দিকে পরিচালিত করে।

মধ্যপন্থী ইসলামী দল আন-নাহদার কর্ণধার ঘানুশি লিখেছেন, আমি আন্তরিকভাবে আশা করি যে প্রেসিডেন্ট সাইদ তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবেন। এই মুহূর্তে তিনি বেশ কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন। তিউনিসিয়ার পশ্চিমা এবং আঞ্চলিক মিত্রদের উচিত এসব পদক্ষেপ গ্রহণে তাকে সমর্থন করা। যেমন নতুন সরকার গঠনে ভোট দিতে এবং মহামারী ও বেকারত্ব মোকাবেলায় সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সংসদকে কাজ করতে দিতে হবে। আমি আশা করি প্রেসিডেন্ট সাইদ এই অচলাবস্থা থেকে উত্তম উপায় বের করার জন্য একটি জাতীয় সংলাপ শুরু করবেন। গণতন্ত্রকে ছুড়ে না ফেলে আমরা যা অর্জন করেছি তার উপর দেশকে গড়ে তুলতে হবে। আমরা অতীতে দেখেছি কিভাবে একক ব্যক্তির হাতে সমস্ত ক্ষমতা আমাদের দেশকে একনায়কতন্ত্রের অন্ধকার এবং হতাশায় নিমজ্জিত করে।

তবে তিউনিসিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ঘানুশি নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করলেও দেশটিতে সংকট নিরসনের কোনো কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অভ্যুত্থানকারী প্রেসিডেনট কায়েস সাইদকে গণতান্ত্রিক পথে ফেরার আহ্বান জানালেও তিনি কোনো নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেননি। অভিযোগ উঠেছে, মধ্যপ্রাচ্যের তিন স্বৈরতান্ত্রিক দেশ সৌদি আরব, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রেসিডেন্ট সাইদকে সমর্থন দিচ্ছে। ওই তিনটি দেশের সরকারই রাজনৈতিক ইসলামকে তাদের রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখছে।

তা সত্ত্বেও নিউইয়র্ক টাইমসের ওই নিবন্ধে ঘানুশি তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন, তিউনিসিয়া অতীতে জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। তারা সেটি আবারও করতে সক্ষম।