মার্কিন সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে কী?


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০১ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩৮

হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে, এমনকি আফগানিস্তানের স্থানীয় সেনা কমান্ডারকেও আগাম কোনো তথ্য না দিয়ে মার্কিন সেনারা যখন প্রায় ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে চলে যায়, তখন এই রহস্যজনক সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা এবং অন্তর্নিহিত কারণ অনেকেই বুঝতে পারেননি। মার্কিন সেনা মোতায়েনের পেছনে কারণ হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে পুনর্নির্মাণের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানকে আগের চেয়েও বেশি অরক্ষিত রেখেই মার্কিন সেনারা সটকে পড়েছে। ঘোষণা এসেছে ইরাক থেকেও এ-বছরের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের।

বিগত প্রায় দুই দশক ধরে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে আছে। এই পুরোটা সময়েই তাদেরকে তালেবান ও আল কায়েদাকে মোকাবিলা করেই থাকতে হয়েছে। এই লম্বা সময়ে তালেবানদের মোটেও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। বরং প্রকারান্তরে তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তানকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র বিলম্ব করতে রাজি ছিলেন না। তার মতে, আফগানিস্তানের জন্য আর কোনো নাগরিককে হারাতে চায় না আমেরিকা। পাশাপাশি, আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করে রাখার ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াও আমেরিকার জন্য কার্যকর কিছু হচ্ছে না। বাইডেনের মতে, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানকে গড়ে তোলার জন্য কখনও সেখানে যাননি। তারা গিয়েছিলেন আল কায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেনের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে আর সে লক্ষ্য পূরণে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছেন।

কিন্তু বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ, যদি আল কায়েদা আর ওসামা বিন লাদেনকে নিশ্চিহ্ন করাই মার্কিন সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এ দুটো লক্ষ্য আরও ১০ বছর আগেই অর্জিত হয়েছে। তাহলে তারা কেন এতদিন পর এসে সেনা প্রত্যাহার করলেন? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তি ঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় একরকম হতাশা থেকেই মার্কিনিরা আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিচ্ছে।

ট্রাম্প যেমন আমেরিকাকে আবারও গ্রেইট নেশন বানানোর দাবি করেছিলেন, একইভাবে বাইডেনের শ্লোগান হলো, আমেরিকা ইজ ব্যাক। অর্থাৎ আমেরিকা আবার খেলায় ফিরেছে। তবে বাইডেন দাবি করছেন, পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকা এবার সামরিক শক্তি প্রয়োগের চেয়ে বরং কূটনৈতিক কৌশলের মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করতে চায়। বিশেষ করে মিত্র কোনো শক্তির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যাত্রায় যুদ্ধে জড়াতে চায় না।

বাইডেনের এ ঘোষণার প্রতিফলন ঘটাতেই এরইমধ্যে ওয়াশিংটন এর ইউরোপীয় এবং এশিয়ার মিত্রদের সাথে নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করেছে। রাশিয়ার সাথেও সম্পর্ক উন্নয়ন করার প্রয়াস নিয়েছে। চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দিতায় লিপ্ত হলেও সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে এবং ইরানের সাথে বহুল আলোচিত পারমাণবিক চুক্তি প্রক্রিয়াকে আবারও কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাইডেন তার প্রথম বিদেশ সফরের জন্য বেছে নিয়েছেন ইউরোপকে। পাশাপাশি কোয়াড জোটভুক্ত জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার নেতাদের সাথেও ভার্চুয়াল যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্যেও মার্কিন নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, খুব শীঘ্রই বাইডেন তার এশিয়ার মিত্র দেশগুলোতেও সফর শুরু করবেন। একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম এশিয়া থেকে সামরিক সম্পৃক্ততা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের এ প্রক্রিয়া শুরু হবে কিনা সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনো কথা বলে দেয়া সঠিক হবে না। হতে পারে এটি প্রকৃতই সেনা প্রত্যাহার। আবার এমনও হতে পারে হয়তো এক জায়গা থেকে সৈন্যদেরকে সরিয়ে অন্য কোথাও মোতায়েন করা হচ্ছে। তাছাড়া সেনা প্রত্যাহার হতে থাকলে এই অঞ্চলগুলোর ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে সুরক্ষিত হবে বিশেষ করে ওয়াশিংটনের সাথে ইসরাইল এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক কোন দিকে যাবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এখনো অবধি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান দুই ঘাঁটি, কাতারের আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি এবং বাহরাইনের মার্কিন নৌ ঘাঁটি থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো কথা শোনা যায়নি।

সিরিয়া সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনের চিন্তাধারা এখনো জানা যায়নি। তবে চলতি বছরের মধ্যেই ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা ইতোমধ্যেই জানা গেছে। আফগানিস্তানের মতো প্রতিকূল একটি ভূখণ্ড যেখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক মার্কিন সেনা দীর্ঘদিন ধরে মোতায়েন ছিল; সেখান থেকেই সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর অন্যান্য দেশে যেখানে মোতায়েনকৃত সেনা সংখ্যা খুবই নগণ্য, সেখানে সেনা মোতায়েন রাখার কার্যকারিতা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।

মার্কিন সেনা নীতিতে বিদেশের মাটিতে সেনা মোতায়েন রাখাকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই কৌশল থেকে মার্কিনিরা আমূল সরে এসেছে- এই মর্মেও কোনো বার্তা পাওয়া যায় না। অন্যান্য দেশে সেনা মোতায়েন থাকলে প্রকারান্তরে মার্কিন নিরাপত্তা এবং নজরদারির বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তাছাড়া, মার্কিন নীতি নির্ধারকেরা ঢালাওভাবে সেনা প্রত্যাহারেরও ঘোর বিরোধী। কেননা, এতে প্রতিপক্ষ মহলগুলো মার্কিনিদেরকে দুর্বল হিসেবে ভেবে বসতে পারে।

আবার ভিন্নমতও আছে। সংঘাতমুখর একটি এলাকা থেকে মার্কিনিরা সেনা প্রত্যাহার করে নিলে প্রতিপক্ষরা যতখানি সুবিধা পাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে তার বিপরীত কিছুও হতে পারে। হয়তো সেনা প্রত্যাহারের এই প্রক্রিয়া মার্কিন বিরোধী শিবিরগুলোতে নতুন করে ভাঙনের সৃষ্টি করবে। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিরোধী তালিবান গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে যেমন সেনা প্রত্যাহারের এই অবাধ সুযোগ নতুন করে সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি প্রতিপক্ষ দেশগুলোও নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। আফগান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর প্রাথমিকভাবে চীন ও রাশিয়া একটু নড়েচড়ে বসলেও কার্যত তারাও বিশেষ কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারেনি। সেনা প্রত্যাহার যখন চলমান ঠিক এমন সময়েই চীনের বেশ কয়েকজন শ্রমিক পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ায় আফগানিস্তান নিয়ে চীনের মাঝে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়ারা প্রথমদিকে আফগানিস্তানে তাদের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বললেও শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নতুন করে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় তার দুটো সামরিক ঘাঁটিকে যৌথভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে আফগান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার একটি প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে।

যেসব জায়গায় মার্কিন সেনারা মোতায়েন ছিল, এর কোনো স্থানেই খুব একটা সফলতা পাওয়া যায়নি। অনেকগুলো দেশেই বরং কবরের নিরবতা নেমে এসেছে। মার্কিন সেনাদের এ ব্যর্থতা ইরানকে বাড়তি কিছু সুবিধা দিয়েছে। আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতার একটি ইতিবাচক ফায়দা নিয়ে নিচ্ছে ইরান। ইরাকে মার্কিনিরা আগ্রাসন চালানোর কারণে ইরাক একটি অশান্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রেও ইরান সুবিধা পেয়েছে। আবার সিরিয়ায় মার্কিনিদের ভূমিকার কারণে গোটা দেশটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।

প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। উল্টো প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দেশের বড়ো একটি অংশে তার নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রেও ইরান বড়ো একটি তুরুপের তাসের ভূমিকায় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আর এই ব্লাংক চেইক দিতে চায় না। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় মোতায়েনকৃত মার্কিন সেনারা বছর কয়েক আগে যে পরিমান সুযোগ সুবিধা পেতো- এখন এর অনেকটাই পাওয়া যাচ্ছে না। জনগণের মাঝেও মার্কিন সেনা বিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠেছে।

ভিন্ন একটি বাস্তবতাও আছে। পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এবং এ দেশগুলোতে গণতন্ত্রকে সুসংহত রাখার ক্ষেত্রে বাহিরের হুমকি যতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, তার চেয়ে বেশি হুমকি বরং দেখা যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদেশগুলো এই চরম বাস্তবতার বিষয়ে উদাসীন থাকায় নানা ধরনের সংকটে পড়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে আত্মসমালোচনার শিকার হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটে শাসক গোষ্ঠীর পতন হওয়ায় বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতেও নানামুখী পরিবর্তন চলে এসেছে। মূলত কোল্ড ওয়ারের পর থেকেই বিশেষত সিনিয়র বুশের আমল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক নীতিতে কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত মার্কিন প্রতিরক্ষা নীতিমালার মূল লক্ষ্যই ছিল ইউরোপ, এশিয়া এবং সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়নের আওতাধীন ভূখণ্ডে এককভাবে মার্কিন সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন সামরিক কৌশলে আরেকদফা পরিবর্তন আসে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের মনোযোগ বেড়ে যায়। বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রমাগত সামরিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিরক্ষা নীতিতে আরেক দফা সংশোধন আনেন। চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে দুটো সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা দেখা দিলেও ট্রাম্প সেখান থেকে সরে আসেন। বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতার আলোকেই বিভিন্ন দেশে অপ্রয়োজনে মার্কিন সেনা মোতায়েন রাখার সিদ্ধান্ত রহিত করা হয়।

মার্কিন সেনা চলে যাওয়ায় প্রতিপক্ষরা তাৎক্ষণিকভাবে সুবিধা আদায় করে নিতে চাইলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় তারাও ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রাখার জন্যেই বরং মার্কিন সেনা প্রত্যাহারটি এখন কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।