আফগানিস্তানে সেনা পাঠাবে ভারত!


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৯ জুলাই ২০২১, ১৫:০২

আফগানিস্তানে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ভারত। এ পরিস্থিতিতে ভারত দেশটিতে সেনা মোতায়েন করতে পারে বলে জল্পনা তৈরি হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। সেখানে ভারত সেনা মোতায়েন করলে কী ফল হবে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আফগানিস্তানে বিদেশি মদতপুষ্ট সরকারের পতন এবং তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাবনা যত বাড়ছে, ততই বিচলিত হয়ে পড়ছে ভারত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করতে পারে ভারত। আফগান সরকার এখনও ভারতের সেনা সহায়তা চায়নি। তবে ভারতে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত ফরিদ মামুন্দজে বলেছেন, তালেবানের সঙ্গে অচলাবস্থার অবসান না হলে তারা ভারতের সামরিক সহায়তা চাইতে পারেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েনের আড়ালে ভারত সেনা মোতায়েন করতে পারে। বিশেষ করে অনেক আফগানদের মনে এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষী মোতায়েনের ধারণাটি প্রথম দিয়েছেন আফগান-আমেরিকান কূটনীতিক জালমে খালিলজাদ। তিনি তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তির মূল কারিগর।

জাতিসংঘে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আকবরউদ্দিন অবশ্য সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের নিজেদের সীমান্তেই তো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভারতের সেনা মোতায়েন জনগণ মানবে বলে মনে হয় না।

ভারতের সামরিক বিশ্লেষক রাহুল মনে করেন , ভারত আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করতে চাইবে না। কারণ সেখানে সবসময় বিদেশি সেনারা পরাজিত হয়েছে।

তালেবানের অন্যতম মুখপাত্র সুহেল শাহীন বলেছেন, ভারতকে আফগান সংকটে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। চীন, রাশিয়া,ইরানসহ বহু দেশের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক আছে। কারণ তারা নিরপেক্ষ। অন্যদিকে ভারত বিদেশের পুতুল সরকারকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকলে ভারতের দুশ্চিন্তা কমবে না।

ভারতে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জেরে ভারতীয় সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে তিনি জানান, সেনা পাঠানো নয় বরং ভারতের কাছে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চাওয়া হতে পারে। এমন সময় ভারতের সেনা মোতায়েন নিয়ে খবর রটেছে যখন তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাচ্ছে না নয়াদিল্লি।

ভারতের নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূতের ভারতের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা নেয়ার বক্তব্য দেয়ার পর পাকিস্তানের গনমাধ্যমে খবর আসে, আফগান সরকারের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদসহ বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র পাঠিয়েছে ভারত। পাকিস্তানের এক্্রপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকার খবরে বলা হয়, কাবুল ও কান্দাহার থেকে ভারতের দূতাবাস কর্মীদের সরিয়ে আনার জন্য দুটি কার্গো প্লেন পাঠায় ভারত। এই প্লেনে ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানো হয়েছে। পাকিস্তানের গনমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর ভারত ও আফগান সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।

এরপর আফগান সরকারের পক্ষ থেকে উল্টো অভিযোগ করা হয়, তালেবানদের সামরিক অভিযানে বিমান সহায়তা দিচ্ছে পাকিস্তান। আফগান সরকারের এমন অভিযোগে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। শুধু তাই নয় পাকিস্তান সরকারের উদ্যেগে আফগান সংকট নিয়ে একটি শান্তি আলোচনায় প্রতিনিধি পাঠাতে অস্বীকার করেছে আশরাফ ঘানি সরকার। স্বাভাবিক ভাবে আশরাফ ঘানি সরকারের এমন ভুমিকার পেছনে ভারতের হাত আছে বলে মনে করছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রক্্িরওয়ার শুরু হয়ে গেছে। যা আগামি দিনে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন কাবুল ভিত্তিক বর্তমান আফগান সরকারের সাথে ভারত যত সক্রিয় হবে ততবেশি তালেবানের সাথে ভারতের সর্ম্পক তৈরির সুযোগ বাধাগ্রস্থ হবে। ইতোমধ্যে চীন , রাশিয়া ও ইরান তালেবানের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়ায় এসেছে। ভারতে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তালেবানকে রাশিয়া আগের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করে না। তালেবান একটি বাস্তবতা। তিনি তালেবানকে লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে তুলনা করেন। আফগানিস্তানে ভারতের সাথে যৌথভাবে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন।

অবশ্য ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল এমএম নারাবনে চলতি বছরের শুরুতে এক অনুষ্ঠানে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত সেনা মোতায়েনের মত স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকরের আগে প্রকাশ্যে স্বীকার করবে না।

ভারত ১৯৮৭ সালে শ্রীলংকায় শান্তিরক্ষী মোতায়েন করেছিল তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য । এজন্য ভারতকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে হত্যা করে তামিল বিদ্রোহীরা। এরপর ভারত সেখান থেকে সেনা ফিরিয়ে নেয়। মালদ্বীপে ভারত সেনা পাঠিয়েছিলো। তার প্রভাবও ভালো হয়নি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরও ভারতীয় সেনা এদেশে অবস্থান করছিল। জনমতের চাপে ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছায় দ্রুত ভারতীয় সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রশ্ন উঠছে, ভারত কেন এরকম অনিবার্য পরাজয়ের আশঙ্কা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবান আবারও আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করবে এই সম্ভাবনায়, সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে ভারত। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বিবিসিকে বলেন, অনেক দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ এখন ভারতের। তালেবান আবার ক্ষমতা নিলে ভারতের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি।

তিনি মনে করেন , ভারতের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে ভারত এখন জটিল এক সংকটে পড়েছে। ২০ বছর আগে ২০০১ সালে আমেরিকার সামরিক অভিযানে ক্ষমতা থেকে তালেবান উৎখাত হওয়ার পর যে দেশটি আফগানিস্তানে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সবচেয়ে তৎপর হয়েছিল, সেটি ভারত।

আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে গত দুই দশকে চার শতাধিক সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিমি দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও তৈরি করেছে তারা।

কয়েকদিন আগে আফগানিস্তানে ভারতের সাহায্যে নতুন করে তৈরি একটি ড্যাম বা বাঁধে তালেবানের হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিরাপত্তা রক্ষী মারা যায়। হেরাত প্রদেশে ওই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আফগানিস্তানে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এটি তৈরিতে ভারত ৩০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে। আফগান-ভারত সম্পর্কের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত ওই বাঁধে হামলার ঘটনায় তালেবানের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের মধ্যে শঙ্কা-সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, ভারতের চলমান শত শত প্রকল্পের ভবিষ্যত কী হবে? এগুলো কি পানিতে যাবে? ভারতের নীতি-নির্ধারকরা সে চিন্তায় এখন অস্থির। তবে শুধু আর্থিক বিপর্যয়ই মুখ্য নয়। বিশ্লেষক ভরদোয়াজের মতে আরও অনেক কারণে ভারতের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বলেন, বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অভিলাষ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ভারতের জন্য আফগানিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।

মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য ভারতের জন্য আফগানিস্তান খুবই জরুরি। আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে দুটো পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এসবের চেয়েও বেশি। বিশ্লেষক ভরদোয়াজ মনে করেন , কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সাথে বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব রয়েছে ভারতের। এখন আফগানিস্তানও শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হলে ভারতের জন্য তা বড়রকম মাথাব্যথা তৈরি হবে।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন আফগানিস্তানের অস্থিরতার প্রভাব পড়তে পারে কাশ্মীরে। অতীতে আফগানিস্তান থেকে মুজাহিদীনরা এসে কাশ্মীরে তৎপর হয়েছে। তালেবান ক্ষমতায় এলে বা তাদের প্রভাব বাড়লে তার পুনরাবৃত্তি হয় কিনা, সে ভয়ও ভারতের মধ্যে প্রবল। তবে ভারতের সবচেয়ে বড় চিন্তা পাকিস্তান নিয়ে। পাকিস্তান আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নীতির নিয়ন্ত্রণ নিলে তা হবে ভারতের জন্য দুঃস্বপ্ন।

লন্ডনে সোয়াস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসির গবেষক এবং পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে তালেবানের সাথে কোন বোঝাপড়া করা ভারতের জন্য অত্যন্ত দুরূহ হবে। ভারত তলে তলে বছর দুয়েক ধরেই তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানও চেষ্টা করছে সেই সম্পর্ক যাতে না হয়।

আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, তালেবানের ওপর ভরসা করা ভারতের জন্য কঠিন। কারণ, তালেবানের মধ্যে পাকিস্তানের প্রভাব অনেক গভীর। পাকিস্তানের মূল কৌশলগত লক্ষ্যই হচ্ছে আফগানিস্তানে ভারতকে যতটা সম্ভব দুর্বল করে ফেলা, অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা। ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক নীতি নির্ধারণে ভারত যেন কোনো ভূমিকা না রাখতে পারে, সেটাই পাকিস্তানের মূল লক্ষ্য।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী বলেছেন, আফগানিস্তানে ভারতের অস্বাভাবিক উপস্থিতি সন্দেহজনক। তিনি বলেন, আফগানিস্তান ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রাখতেই পারে। ব্যবসা করতে পারে। ভারত সেখানে গিয়ে উন্নয়ন কাজ করতে পারে। তাতে পাকিস্তানের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যে দেশের সাথে ভারতের সীমান্ত নেই, সেখানে তাদের এত বড় উপস্থিতি স্বাভাবিক নয়।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিরাপত্তা বিশ্লেষক যাকারি কনস্টানটিনো বলেছেন, বহুদিন ধরেই ইসলামাবাদের ভয় আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে পাকিস্তানকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে ভারত। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর ভারতের ব্যাপারে পাকিস্তানের অবস্থান তাই এবার আরও শক্ত হতে পারে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত সরকার যা করেছে তাতে পাকিস্তান খুবই ক্ষুব্ধ। সেই ঝাল আফগানিস্তানে ঝাড়তে পারে ইসলামাবাদ। এর ফলে অফগানিস্তান ঘিরে এ অঞ্চলে অস্থিরতা নতুন মাত্রা পেতে পারে। শুথু আফগানিস্তান নয় পাকিস্তান ও ভারত সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে।