তালেবানের কূটনৈতিক খেলা


  • মোতালেব জামালী
  • ১৩ জুলাই ২০২১, ১৩:০৯

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশটিকে ঘিরে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা ধরনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান তৈরি ও স্বার্থ হাসিলের পথ খোঁজার চেষ্টা শুরু করেছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেন-দরবার শুরু করেছে। আবার তালেবানদের সঙ্গেও বিভিন্ন দেশ এরইমধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।

সম্প্রতি মস্কোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকটি ছিল খুবই গোপন। রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সেক্রেটারি নিকোলাই পেট্রোশেভ ও আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবের মধ্যে এই বৈঠকটি হয়। বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জানা যায়নি। গোপনই থেকে গেছে। এরপর তালেবানদের একটি প্রতিনিধিদল মস্কো সফর করেন। রুশ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তালেবান প্রতিনিধিদল সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, তারা দেশটির ৮৫ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আফগানিস্তানের মাটি অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না বলে রাশিয়াকে আশ্বস্ত করেছেন তারা।

অপরদিকে, আফগান সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পরে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, উভয়পক্ষ আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বাহিনী প্রত্যাহার চলাকালে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আলোচনায় গুরুত্ব পায়। এছাড়াও আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থা নিয়েও তারা কথা বলেছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি সুক্ষ্ম ও গভীর। তালেবানের ক্রমবর্ধমান সামরিক বিজয়ের মুখে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। তারই প্রতিনিধিত্ব করছেন হামদুল্লাহ মুহিব। তিনি নিকোলাই পেট্রোশেভকে এটা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন যে, ঘানির সরকার আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাশিয়া এটা ভালো করেই জানে যে, মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার পরবর্তী অন্তর্বর্তী আফগান সরকারে ঘানিকে কোনোভাবেই মেনে নেবে না তালেবান।

পেট্রোশেভ এটাও জানেন যে, আফগানিস্তানের বর্তমান প্রশাসনকে কোনো ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি মস্কোর পক্ষ থেকে দেওয়া হবে না। সেটা করতে গেলে তালেবানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরির যে চেষ্টা রাশিয়ার পক্ষ থেকে করা হচ্ছে, তা ফলপ্রসূ হবে না। এছাড়া নতুন সরকারে ক্ষমতার ভাগাভাগি যেভাবেই করা হোক না কেন, তাতে বর্তমান প্রশাসনের কাউকে স্থান দিতে রাজি হবে না তালেবান। এসব কারণে আফগান প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হামদুল্লাহ মুহিবের সঙ্গে বৈঠকের ফলাফলে খুব একটা সন্তুষ্ট হননি পেট্রোশেভ।

তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের একটি প্রতিনিধি দল এর আগে মস্কো সফর করেন। তারা রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে উত্তর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। চার মাস আগেও তালেবানের প্রতিনিধিরা মস্কোতে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আফগানিস্তানে ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে তারা এই নিশ্চয়তাও দেন যে, মধ্য এশিয়ায় আফগানিস্তানের প্রতিবেশি দেশগুলোর কোনো ভূখণ্ডে অভিযান বা হামলা চালানোর কোনো আগ্রহ তালেবানের নেই।

তালেবানের এই নিশ্চয়তা দেওয়ার কারণও আছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ একাধিকবার তালেবানের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের দিক থেকে কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হলে তা কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করা হবে।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত নতুন অবস্থান বলে অভিহিত করছে। কিন্তু সার্গেই ল্যাভরভ এটাকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন উত্তর আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় তালেবান তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করছে।

তিনি আরো বলেছেন, অন্তবর্তী সরকার গঠনে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির অস্বীকৃতির কারনে সংঘাতময় সমাধানের দিকে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানে তিনি ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ঘানির সরকার ও তালেবান উভয় পক্ষকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা তৈরির আহবান জানান। এসময় রাশিয়ার একজন সাংবাদিক জানতে চান যে, রাশিয়া আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠাবে কিনা। ল্যাভরভ এর সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, জবাব খুবই স্পষ্ট।

বর্তমানে তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের মুখপাত্র হচ্ছেন মোহাম্মদ সোহাইল শাহীন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, সামরিক শক্তির সাহায্যে আফগানিস্তান দখল করা তাদের নীতি নয়। তাদের নীতি হচ্ছে আফগান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা। এ প্রক্রিয়া কাতারের রাজধানী দোহায় চলমান রয়েছে। এ ছাড়া সংকটের সমাধানের চেষ্টায় মস্কোর সঙ্গেও তারা যোগাযোগ রাখছেন। সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের তালেবান অঙ্গীকরাবদ্ধ বলেও তিনি জানান।

সোহাইল শাহীনের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ সঠিক। তালেবান এখন আর রক্তপাত চায় না। মানুষ তাদেরকে উষ্ণভাবে আলিঙ্গণ করবে, সাদরে গ্রহন করবে সেটাই তারা প্রত্যাশা করে। শাহীন বলেন, আফগানিস্তানের বড় বড় নগরীগুলো দখল করা তালেবানের জন্য খুই সহজ কাজ। কিন্তু তাতে রক্তপাত হবে। তালেবান সেটা চায় না। বর্তমানে সংগঠনটি তাজিকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের পুরো সীমান্তই কার্যত তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। ২০০১ সালের যুদ্ধপূর্ব তালেবানের সঙ্গে ২০২১ সালের তালেবানের আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।

গিলজাই পশতুনদের গ্রামীন একটি গেরিলা গ্রুপে বিভিন্ন জাতিগোষ্টীর লোকদের অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে তালেবান সংগঠনটির জন্ম হয়। তাজিক, উজবেক এমনকি শিয়া হাজারা গোত্রের লোকজনকেও এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। যদিও ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময় শিয়া হাজারাদেও উপর অনেক নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়।

তালেবানের সঙ্গে বিশ্বস্ত বা বিশ্বাসযোগ্য লোকজনের সংশ্লিষ্টতা খুব একটা দেখা যায় না। বর্তমানে তালেবানের অন্তত ৩০ শতাংশ সদস্য পশতু ভাষী নয়। সংগঠনটির একজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার জাতিগত তাজিক। দেশের উত্তরাঞ্চলে তাজিকভাষী লোকজনের বসবাস। তারা দারি ভাষায় কথা বলে।

বর্তমানে এই অঞ্চলের গ্রামে বা শহরে তাজিক তালেবানের প্রতি সাধারণ মানুষের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। কান্দাহার বা জালালাবাদ এলাকার পশতু ভাষী তালেবানদের দেশের উত্তরাঞ্চলে কোনো কাজে সাধারণত জড়িত করা হয় না। এই অঞ্চলে কেন্দ্রিয় সরকারের কোনো ধরনের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে কোনো যুদ্ধ না করেই দেশের উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান।

রক্তপাত বা প্রানহানি এড়াতে তালেবান বর্তমানে বড় নগরগুলোতে কোনো হামলা করছে না। এ কারণে আফগান ন্যাশনাল আর্মির সদস্যরা এসব নগরীতে অবস্থান করতে পারছে। তালেবানদের মুখপাত্র সোহায়েল শাহীন দুঃখ করে বলেন, আমরা মিডিয়ার কাছে যেতে পারি না। সে কারণে পশ্চিমা মিডিয়া পরিবর্তিত তালেবান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। এসব কারণে আমাদের সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়ে থাকে। তালেবানের এই পরিবর্তণের বিষয়টি পশ্চিমা মিডিয়ার স্বীকার করে নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন শাহীন।

সোহায়েল শাহীন বলেছেন যুদ্ধ করে ৬ সপ্তাহের মধ্যে দেশের ১৫০ জেলা দখল করা সম্ভব নয়। কিন্তু তালেবান এই সময়ের মধ্যেই এসব জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারকে বিশ্বাস করে না। এ কারণে তারা স্বেচ্ছায় তালেবানের কাছে এসে জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেছে।

তালেবানের মুখপাত্র জানান, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে চুক্তি হয়েছে সেটার প্রতি তারা অবিচল থাকবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি চুক্তির প্রতি সম্মান না দেখাতে পারে তখন তালেবান পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করবে। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার পর সব দেশের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক তৈরি হবে। তখন আর কোনো দুতাবাস ও কন্স্যুলেটে হামলার ঘটনা ঘটবে না।

আফগানিস্তানে দখলদারিত্বেও অবসান ঘটানো তালেবানের সুস্পষ্ট লক্ষ্য জানিয়ে এই মুখপাত্র আরো বলেন, কাবুল বিমানবন্দর রক্ষায় নিয়োজিত তুর্কি বাহিনীও এই নীতির আওতায় পড়বে। কোনো ন্যাটো সৈন্য আফগানিস্তানে থাকবে না। ন্যাটো সৈন্য থাকা মানেই দখলদারিত্ব। সেটা আমরা মেনে নেব না। যখন আমরা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করবো তখন তুরস্কের সঙ্গে আমাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। সেই চুক্তি হবে দু’পক্ষের জন্যই উপকারি।

আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পর দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে সে ব্যাপারে ওয়াশিংটন এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। রাশিয়া ইতিমধ্যেই তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। হয়তো খুব দ্রুতই দেশটির সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে তালেবানের নাম বাদ দেয়া হতে পারে। চীনও চাচ্ছে তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের অংশ হিসেবে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে আফগানিস্তানে নিয়ে যেতে। ইতোমধ্যে তালেবানরা চীনকে তাদের বন্ধু দেশ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট হচ্ছে চীনের বিআরআইকে বাধাগ্রস্থ করা। সেই টার্গেট পূরণ করতে ওয়াশিংটনও হয়তো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার মতো হাইব্রিড যুদ্ধের ক্ষেত্র আফগানিস্তানেও প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীলনকশা বানচাল করে দিতে চেষ্টার কমতি রাখবে না। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও আফগানিস্তানে কোনো হাইব্রিড যুদ্ধ দেখতে চাইবে না।

আফগানিস্তান ও তালেবানকে ঘিরে নানামহল নানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।