ইরানকে কেন্দ্র করে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি


  • মোতালেব জামালী
  • ১২ জুলাই ২০২১, ১৪:০০

আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের ওপর গভীর নজর রাখবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। কেননা, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ইরান হয়ে উঠতে যাচ্ছে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। এরইমধ্যে ইরানে বড় আকারের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে চীন। অপরদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গেও বাড়ছে দেশটির ঘনিষ্টতা। আবার ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট করার চেষ্টা করছে ভারত।

ইরানের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরও ভারতসহ কয়েকটি দেশকে ইরান থেকে জ¦ালানি তেল আমদানিতে কিছুটা ছাড় দিয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সেই সুবিধা বাতিল করার পর ভারত ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়।

ইরানের চবাহার বন্দর প্রকল্পে ভারত অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইরান সফরকালে ভারত এই বন্দরের উন্নয়নে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর ২০১৮ সালে ভারত এই বন্দরের প্রথম পর্যায়ের কাজের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।

ইরান থেকে ভারত তেল আমদানি বন্ধ করার পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। ভারতের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে ইরান। ফলে চবাহার বন্দর প্রকল্পের উন্নয়ন কাজও তেমনভাবে আর অগ্রসর হয়নি। এ সময় চাবাহার বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত একটি রেল প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয় চীনা কোম্পানিকে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এ-সময় জানিয়েছিল যে, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে চাবাহার বন্দর পড়বে না। কিন্তু ইরানের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ককে ততটা গুরুত্ব দেয়নি ভারত। ট্রাম্পের বন্ধু হিসেবে দাবি করা মোদি তখন যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য ভারত তখন ব্যস্ত ছিল।

২০১৯ সালের শেষের দিকে এসে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক আবার ঘনিষ্ট করার চেষ্টা শুরু করে ভারত। হোয়াইট হাউসে ক্ষমতার পালাবদলের আভাস পাওয়ার পর থেকেই ভারত অনুমান করতে থাকে যে, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প আমলের সেই উত্তেজনা হয়তো থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রও হয়তো ইরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনায় ফিরে আসতে পারে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ইবরাহিম রাইসিকে টুইট করে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই বার্তায় তিনি বলেছেন, ইরান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে তিনি রাইসির সঙ্গে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে আছেন। ভারত আবার চাবাহার বন্দর প্রকল্পের কাজে জোরেশোরেই ফিরে আসে। এই বন্দরকে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করে ভারত।

ধারণা করা হচ্ছে, গত কয়েক মাসে ইরান-ভারত সম্পর্ক খানিকটা সামনে এগিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর তেহরান ছুটে গেছেন। রাইসির সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু এরপরও তা তেহরান ফারজাদ বি গ্যাস ফিল্ডের উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে ভারতকে বাইরে রেখেছে। যদিও এই গ্যাস ক্ষেত্রটি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব তেল-গ্যাস কোম্পানি অয়েল এন্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন বা ওএনজিসি আবিস্কার করে।

ইরানের তেল মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পারস্য উপসাগরে ফারজাদ বি গ্যাস ফিল্ডের উন্নয়নে দ্য ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি এনআইওসি- পেট্রোপার্স গ্রুপের সঙ্গে ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারত আশা করে ফারজাদ বি গ্যাস ফিল্ডের উন্নয়নে ইরান পরবর্তীতে ভারতকে যুক্ত করবে।

ইরানের সঙ্গে ভারত যখন আগের সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে তখন ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে। গত কয়েক বছরে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আর আমিরাতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আগের মতো আর অতোটা মধুর নেই। কিছুটা হলেও অবনতি হয়েছে। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব ও আমিরাত পুরানো মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।

ইরান ও চীনের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি যে কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার ফলে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিইপিসি ইরান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ইরান ইতিমধ্যেই সিইপিসি প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই প্রকল্প এ অঞ্চলের ভুরাজনীতিকে পুরোপুরি বদলে দিতে যাচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

গত কয়েক মাসে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, চীন আফগানিস্তানকে সিইপিসি প্রকল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়াং গত মে মাসে এক বিবৃতিতে বলেছেন, চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান পাকিস্তান থেকে সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে আফগানিস্তানে সম্প্রসারণ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল সম্পর্কে সেন্টার ফর ষ্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর বার্ক চেয়ারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণ প্রকশ করা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে এমন কিছু জটিল ইস্যুর কথা বিবেচনা করতে হবে। যেগুলোর সমাধান কেবলমাত্র পরমাণু চুক্তি বা ইরানের সঙ্গে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়।

এই সমীক্ষার মাধ্যমে ইরানে আঘাত হানার সক্ষমতা, পুরনো অনিয়ন্ত্রিত ডেলিভারি সিস্টেম, দেশটির বিমান বাহিনী ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিশ^ ব্যাংকের সমীক্ষাকেও বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়েছে এই সমীক্ষায়।

এতে আরো বলা হয়েছে যে, ইরান তার সামরিক শক্তির অংশ হিসেবে ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি মিলিশিয়া বাহিনীকে ব্যবহার করার সক্ষমতা ক্রমেই বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও গাজা ভূখন্ডে ইরানের প্রভাব বেড়েছে।

এসব দেশ ও ভূখন্ডের বেশ কয়েকটি সমস্ত্র সংগঠন ইরানের পক্ষে কাজ করছে। এই কৌশলে ইরান যুক্তরাষ্ট্রকেও এই অঞ্চলের বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। সে কারণে বাইডেন প্রশাসন ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এসব বিষয়কে সামনে রেখে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাপক ভাবে ইরানকে সম্পৃক্ত করার কৌশল নিতে হবে।

বাইডেন প্রশাসন ইতোমধ্যে সে কাজ শুরু করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এজন্য প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তিতে ফিরে এই চুক্তিকে কার্যকর করতে চাইছে। এছাড়া এ অঞ্চলে সংঘাত এড়াতে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতিও কমাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশটির সামনে এসব যুদ্ধের সুস্পষ্ট কোনো লক্ষ্য ও কৌশল ছিল না। এই দুই অঞ্চলে যুদ্ধের বাইরেও আরো যে সব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেসবের মোকাবেলা করার কোনো কৌশলও যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অর্জনের কোনো সুস্পষ্ট মর্কিন কৌশলও চোখে পড়েনি। বরং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

আফগানিস্তানে সুস্পষ্ট কোনো লক্ষ্য অর্জনের কৌশল ছাড়াই দেশটিতে ইতিহাসের সরচেয়ে দীর্ঘতম যুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শেষ পর্যন্ত কোনো অর্জন ছাড়াই আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। অন্যদিকে আরব বিশে^ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলার করার কোনো কৌশলও নেই যুক্তরাষ্ট্রের।

এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে নানা ভাবে তটস্থ করে রেখেছে ইরান। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবার পর দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি কি দাড়াবে, কিভাবে দেশটি পরিচালিত হবে সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোনো সমাধান করে যেতে পারছে না ওয়াশিংটন।

ইরানের পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করতে সময় লাগবে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেবল দ্বিপক্ষীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও এই সম্পর্কের প্রভাব পড়বে। একইসঙ্গে ভারত ও চীনের কানেক্টিভিটি উদ্যোগের জন্যও এই সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।