আফগানিস্তানে বিপাকে দিল্লি, তালেবানদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ

-

  • আলফাজ আনাম
  • ১১ জুলাই ২০২১, ১৪:৪৮

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার পর দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের নানামুখী প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে দেশটির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে তালেবানদের হাতে। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে পাকিস্তান, ইরান ও ভারত। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের মতো দেশগুলো। এরইমধ্যে ভারতের আফগান-নীতি গভীর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। কারণ, তালেবানদের সঙ্গে ভারতের অতীতে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে নয়াদিল্লি উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কাবুল সরকারের প্রধান সহযোগী ছিল দিল্লি। এই সরকারের ওপর ভরসা করে আফগানিস্তানে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে দেশটি।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০২০ সালের নভেম্বরে জানিয়েছিলেন, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে ৪০০-এর বেশি প্রকল্পে ভারত বিনিয়োগ করেছে। এরমধ্যে সড়ক ও ড্যাম নির্মাণের মতো বড় প্রকল্প রয়েছে। এগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

কাবুল ছাড়াও আফগানিস্তানে ভারতের চারটি কনস্যুলেট রয়েছে। এসব কনস্যুলেট থেকে নানা ধরনের কার্যক্রম চালাত ভারত। হেরাত ও জালালাবাদের ভারতীয় কনস্যুলেট কয়েক মাস আগে থেকে বন্ধ । মাজার-ই শরিফ ও কান্দাহারের কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় নাগরিকদের কীভাবে সরিয়ে আনা হবে, তা নিয়েও দেশটি প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গণমাধ্যমের খবরে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সৈন্যদের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ভারতের জন্য দুঃসংবাদ। শেষ পর্যন্ত ভারত আশা করেছিল আফগান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র কিছু সময় নেবে। সংখ্যা কমিয়ে হলেও কিছু সৈন্য রাখবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন আবার ঘোষণা দিয়েছেন, আফগানিস্তানের ভাগ্য আফগানদের ঠিক করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কিছু করার নেই।

এখন তালেবানদের সঙ্গে ভারতের সম্পকী কীভাবে গড়ে উঠবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে নয়াদিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এরইমধ্যে ইরান ও রাশিয়া সফর করে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। যদিও আফগানিস্তান নিয়ে এসব দেশের রয়েছে নিজস্ব কর্মকৌশল।

অপরদিকে, তালেবানের ব্যাপারে ভারতের নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এতদিন ভারতের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ বা কথা বলা নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। এখন দেশটি স্বীকার করেছে, তারা তালেবানের সঙ্গে সামনাসামনি কথা না বলে ব্যাক চ্যানেলে বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।

জুনের প্রথম দিকে ভারতীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়, নয়াদিল্লি তালেবানের কয়েকটি গ্রুপ ও এর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের পর দিল্লি এ উদ্যোগ নিয়েছে। এর কয়েকদিন পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।

কিছুদিন আগেও ভারত তালেবানের সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগ করতে রাজি ছিল না। বরং তারা পশ্চিমা দেশগুলোকে এটা দেখাতে চেষ্টা করেছে, আফগান সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক দিল্লি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যখন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে, তখনও তালেবানদের সঙ্গে ভারত কোনোভাবেই বসতে আগ্রহী ছিল না। এখন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের শুধু একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, এটি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয় বলেও জানিয়ে দিয়েছে।

ভারত তালেবানদের পাকিস্তানের অনুগত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করেছে। একইসঙ্গে তাজিক ও উজবেকদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে দিল্লি। অতীতে পাকিস্তান বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছে, আফগান নাগরিকদের ব্যবহার করে ভারত দেশটির ভেতরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। তালেবানের উত্থানে আফগানিস্তানে তাজিক ও উজবেক জাতিগোষ্ঠীগুলো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে ভারতের জন্য আফগানিস্তানে প্রভাব গড়ে তোলা অনেক কঠিন হবে।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে চলে গেলে তারা কাশ্মীরের দিকে নজর দিতে পারে। তাতে পাকিস্তানের নীরব সায় থাকবে। এতে কাশ্মীর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়তে পারে। সম্ভবত এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে মোদি সরকার কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। কাশ্মীরিদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

এখন ভারতের প্রধান কৌশল হচ্ছে, যে কোনোভাবেই হোক তালেবানদের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলা। ভারতের স্বার্থে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বিগত বছরগুলোতে কখনও কখনও তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

ভারত তালেবানকে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে । ভারত মনে করত, তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ করে তারা কোনোভাবেই লাভবান হবে না। এছাড়া সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে  আলোচনায় বসতে সবসময় ভারত অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে। দিল্লি মনে করে, তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসলে অধিকৃত কাশ্মীরের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য দিল্লির ওপর চাপ বাড়তে থাকবে। ভারত সরকার সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় না। কিন্তু এখন পুরো পরিস্থিতি বদলে গেছে।

তালেবানরা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার অনেক বেশি কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের পাশাপাশি ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে তালেবানরা সম্পর্ক বাড়িয়েছে। আইএসকে মোকাবিলায় তারা মস্কো ও তেহরানের সমর্থন পেয়েছে। একই সঙ্গে শিয়া হাজারা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তালেবানরা বেশ পরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে তারা পাকিস্তান ও চীনের পুরোপুরি সমর্থন পেয়েছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আফগান বাহিনীর কাছ থেকে অনেক ভূখণ্ড দখল করে ক্ষমতার দাবিদার হিসাবে নিজেদের বৈধতা জোরালো করেছে।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তালেবান প্রমাণ করে যে, মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে যাচ্ছে। এসব ঘটনা ভারতকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তালেবানের ব্যাপারে তাদের অবস্থান বদলানো শুরু করে। তালেবানের মধ্যে যারা ভারতের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় মনোভাব পোষণ করে, তাদের সঙ্গে ব্যাক চ্যানেলে যোগাযোগ শুরু করে।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রথমবারের মতো আভাস দেন যে, তার দেশ তালেবানের সঙ্গে সংলাপে বসতে আগ্রহী। এরপরই দিল্লি কাতারের রাজধানী দোহায় শুরু হওয়া আন্তঃআফগান শান্তি আলোচনায় ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে অংশ নেয়। প্রথমবারের মতো ভারতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল এই শান্তি আলোচনায় যোগ দেয়।

ব্যাক চ্যানেলে যোগাযোগের মাধ্যমে ভারত কতটা লাভবান হবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। ভারত চাইছে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে তাদের নিরাপত্তা স্বার্থ ও বিনিয়োগ যেন সুরক্ষিত থাকে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশটিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ নতুন রূপ নিতে পারে। কিন্তু তালেবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তার সম্ভাবনা অনেকটা কমে আসবে। কারণ, তালেবানদের ওপর একক দেশ হিসেবে পাকিস্তানের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে- পাকিস্তান, চীন ও ইরানের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা। এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা আগের মতো থাকবে না। এরইমধ্যে ভারত খেলোয়াড় থেকে দর্শকের ভূমিকায় চলে এসেছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য চীন ও পাকিস্তান চাইছে ভারতের সঙ্গে তালেবানদের এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠুক। যাতে বিচ্ছিন্ন তাজিক ও উজবেক গোষ্ঠীগুলোকে ভারত ব্যবহার করতে না পারে।

অপরদিকে, তালেবানের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করছে পাকিস্তানের ওপর। পাকিস্তান যদি বিরোধিতা করে, তাহলে ভারত-তালেবান সম্পর্ক স্থাপনের যে কোনো উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হবে। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান সে ধরনের ভূমিকা নিচ্ছে না বলে মনে করা হচ্ছে। বরং তালেবানদের সঙ্গে সব দেশের সম্পর্ক গড়ে উঠুক, তেমনটা চাইছে।

আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান-চীন ইকোনমিক করিডোর ইরান পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে চায় বেইজিং। এরইমধ্যে ইরানে বড় আকারের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে চীন। ফলে পাকিস্তান-চীন প্রভাব বলয়ে থেকেই তালেবানরা যাতে স্থিতিশীল সরকার গড়তে পারে সেদিকে ইসলামাবাদ-বেইজিংয়ের নজর থাকবে।

তালেবানরা ক্ষমতায় এলে ভারতের আফগাননীতি পুরোপুরিভাবে বদলে ফেলতে হবে। যার প্রভাব পড়তে পারে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। আহমদ শাহ আবদালি ও আলাউদ্দিন খিলজির সময় থেকে আফগানরা ভারতের দিকে দৃষ্টি রাখছে। ফলে কাশ্মীর কিংবা ভারতীয় মুসলমানদের ওপর ভারতের শাসকদের ভূমিকা অবশ্যই আফগানদের প্রভাবিত করবে। এখন ভারত কতটা এ ব্যাপারে সর্তক থাকবে, তা দেখার বিষয়।