চীন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে বিভক্তি

জি-৭-ভুক্ত দেশগুলোর পতাকা - সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ১৮ জুন ২০২১, ১১:২৯

ব্রিটেনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো জি-৭ সম্মেলন। অনেকে শঙ্কিত ছিলেন, এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন-বিরোধিতা নতুন মাত্রা পাবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি। বরং জি-৭ সম্মেলনের ঘোষণায় চীন বিষয়ে নরম সুর ফুটে উঠেছে। আর বিভিন্ন ইস্যুতে চীন নিয়ে এসব দেশের মধ্যে অনৈক্যের প্রকাশ ঘটেছে। চীনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তাদের মধ্যে বিভক্তি প্রকাশ পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপানসহ জি-৭ বা সাত দেশের বেশিরভাগ দেশ চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্প্রতি প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে। জি-৭-এর অধিকাংশ দেশ দক্ষিণ চীন সাগর, মানবাধিকার ইস্যুসহ অনেক বিষয়ে চীনের বিরুদ্ধে একজোট। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপান। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের আশঙ্কা ছিল, যেহেতু জি-৭-এর প্রায় সবগুলো দেশই চীনবিরোধী, ফলে এ সম্মেলনের মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। উদীয়মান অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার গণতান্ত্রিক মিত্রদের সাথে নতুন করে এ সম্মেলন থেকে উত্তেজনার বীজ বপন করা হতে পারে। জি-৭ সম্মেলন বিশ্বব্যাপী উস্কে দিতে পারে নতুন উত্তেজনা আর সঙ্ঘাত।

কিন্তু তেমনটি না হওয়ার পেছনে কাজ করেছে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান এবং বিশ্বব্যাপী দেশটির প্রভাব বিস্তার। বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্ব মূলত মূল্যবোধ এবং আদর্শের। অপরদিকে চীনকেন্দ্রিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ এ দ্বন্দ্বকে ধীরে ধীরে কমিয়ে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে ডিঙিয়ে চীন এখন ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। এ বিষয়টি চীনবিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেককে দ্বিধায় ফেলেছে। চীনা সরকারি পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের পার্থক্য অনতিক্রম্য।

জি-৭ সম্মেলনের পরের দিন ব্রাসেলসে শুরু হয় ন্যাটোর সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোও বর্তমানে চীনবিরোধী নানা ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছে। চীনা হুমকি নিয়ে নানা ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে সামরিক জোটটি। কিন্তু বাস্তবে জি-৭ বা ন্যাটোর কোনো সম্মেলন থেকেই চীনবিরোধী কার্যকর কোনো অ্যাকশন প্লান গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। অনেকের মতে, তাদের ঘোষণাপত্রে কাজের চেয়ে কথা বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

ব্রিটেনের কর্নওয়াল কারবিস উপসাগর তীরে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-৭ সম্মেলন। এই সম্মেলনে চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং রুলস-বেজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার ইস্যুতে কড়া সুরের পরিবর্তে নরম সুর স্থান পেয়েছে। লন্ডনের চীনা দূতাবাস থেকে জি-৭-এর রুলস-বেজড ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেমকে তথাকথিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অল্প কয়েকটি দেশ বৈশ্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। এতে বলা হয়েছে, গুটি কয়েক দেশের জারি করা তথাকথিত সিস্টেম নয় বরং জাতিসংঘের ঘোষিত একটিই সিস্টেম এবং ওয়ার্ল্ড অডার আছে বিশ্বে।

জি-৭ আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় চীন বিষয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে তাকে লন্ডনের চীনা দূতাবাস থেকে অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অপ্রীতিকর হিসেবে হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এরপরও চীন বিষয়ে জি-৭ যে আনুষ্ঠানিক নরম বক্তব্য তুলে ধরেছে তাতে চীন ও অনেকটা নরম অবস্থান নিয়েছে। লন্ডন দূতাবাস ছাড়া আর কোনো তরফ থেকে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়নি।

এশিয়া-প্যাসিফিব অঞ্চলে ওয়াশিংটন এখন পর্যন্ত বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো কোয়ালিশন গঠন করতে পারেনি। এ নিয়ে হোয়াইট হাউজ হতাশ। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যে বিভক্তির কারনে চীন বিরোধী কোয়াদ শক্ত দাত দেখাতে পারছে না। জি-৭ বৈঠকের পর এটা আরো স্পষ্ট হয়েছে , শীর্ষ গণতান্ত্রিক সাতটি দেশ চীন বিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্ত।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাইডেনের চীন বিরোধী ইস্যুতে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং কানাডা সমর্থন দিয়েছে। জার্মানি এবং ইতালীর অবস্থান ছিল নীরব। জাপান রয়েছে উভয় সঙ্কটে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটির কারনে জাপান রয়েছে চীনের মিসাইল নিশানায়। জাপানের উদ্যোগে চীন বিরোধী কোয়াদ গঠিত হলেও বাস্তবে জাপান কতটা চীনের বিরুদ্ধে যেতে পারবে তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর হোয়াইট হাউজের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের অবণতি ঘটে। ইউরোপের অনেক নেতৃবৃন্দের আশা ছিল ট্রাম্প বিদায় হলে ওয়াশিংটনের সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নতি হবে। তবে সে আশা ক্ষীন হয়ে আসছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয় বিরোধের কারনে। চীন ইস্যুতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন চলতে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীনের সাথে বিরোধ এড়ানোর লক্ষ্যেই এবার জি-৭ সম্মেলন শেষে অফিশিয়াল ঘোষণাপত্রে নরম সুর ব্যবহার করা হয়েছে। জি-৭ এর ৭০ প্যারাগ্রাফের পূর্ণ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে। তাতে দেখা যায়, গতানুগতিক বক্তব্যই বেশি। কাজের চেয়ে বাগাড়ম্বর বেশি।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বহুত্ববাদ, মুক্ত, স্থিতিশীল, রুলস-বেজড বিশ্ব ব্যবস্থার উল্লেখ করার পর আনা হয়েছে কোভিড-১৯ প্রসঙ্গ। এতে একটি সময়োপযোগী, স্বচ্ছ, বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে, বিজ্ঞান-ভিত্তিক কোভিড-১৯ উৎস সন্ধানের আহবান জানানো হয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়ে ঘোষণায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সংস্থার আগ্রাসনে বাজার ব্যবস্থা ধ্বংস এবং শিল্পে ক্ষতিকর ভর্তুকি ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ এ নিয়ে চীনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কাজের তুলনায় কথা হয়েছে বেশি। গ্লোবাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশান অধ্যায়ে চীনের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে শুরুতে। তবে এতে পরিষ্কার করে কোনো কৌশলের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে জি-৭ সদস্যদের মধ্যে চীন বিষয়ে ভিন্নতা পরিষ্কার।

জি-৭ দেশগুলোর মূলবোধকে উৎসাহিত করার কথা উল্লেখ করে মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখাতে চীনের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে । মুক্ত স্বাধীন এশিয়া-প্যাসিফিক বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। পূর্ব এবং দক্ষিণ চীন সাগরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নস্যাতের ক্ষেত্রে যে কোনো এক তরফা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল বিষয়ে কোনো একশন প্ল্যান উল্লেখ করা হয়নি।

জি-৭ অঙ্গীকার করেছে করোনার পরে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ উদ্যোগ গ্রহণের। এটা তারা করবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীন দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়া এবং আফ্রিকাজুড়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মান করছে। জি-৭ আফ্রিকান প্রজেক্টের জন্য আইএমএফ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেবে।

লন্ডন থেকে চীনের সিনহুয়ার প্রতিবেদনে জি-৭ দেশেগুলোর মধ্যে বিভেদের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ওয়াশিংটনের অবস্থানে জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল উদ্বিগ্ন। চীনের সরকারি মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়েছে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যেসব ইস্যুতে চীনকে আক্রমন করেছে তার প্রতিটি বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে জি-৭ ঘোষণায়। তবে এর ভাষার সুর অনেক নরম। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে আধিপত্য বজায় রাখতে আর ইউরোপ চাচ্ছে চীনের সাথে সহযোগিতা করতে। জি-৭ বৈঠকের পরদিন ব্রাসেলসে শুরু হয় সামরিক সংস্থা ন্যাটোর সম্মেলন। প্রথমবারের মত ন্যাটোর ফাইনাল স্টেটমেন্টে চীনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে । ন্যাটোর বিবৃতিতে চীনকে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

তবে ন্যাটোর ৩০ টি রাষ্ট্র প্রধান চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আখ্যায়িত করা থেকে বিরত থেকেছেন। তারা চীনের বল প্রয়োগের রাজনীতি এবং চীনা আর্মির অস্বচ্ছ আধুনিকায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা চীনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সিস্টেমের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।

সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নির্দেশে চীন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আগ্রাসী কথা বলার পরিবর্তে নরম সুরে কথা বলার নীতি গ্রহণ করেছে। চীনের প্রতি ইতিবাচক এবং সম্মানজনক মনোভাব গড়ে তোলার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে।