ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর পর কি মোদি?


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৩ জুন ২০২১, ১৪:৫২

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সখ্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ওয়াশিংটনে মোদি সফরের সময় থেকেই বিষয়টা দৃশ্যমান হয়। আবার ভারতে ফিরতি সফরে ট্রাম্পকে নজিরবিহীন উষ্ণ আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ট্রাম্পের ভূমিকার পর ভারত তার পাশে থাকতে পারেনি। ট্রাম্পের পরাজয়ে মোদি তার ঘনিষ্ঠ মিত্রকেই হারিয়েছেন। এখন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আপনজনকেও হারাতে যাচ্ছেন মোদি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিদায় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কাকতালীয় হলেও সত্য, নেতানিয়াহু এবং মোদি উভয়ই নিজ নিজ দেশে বিরোধী দল ও সমর্থকদের চাপে অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। রাজনৈতিক টানাপড়েনে তাদের দুজনের রাজনৈতিক গন্তব্য এখন অনিশ্চয়তার পথে। নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। এবার তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী জোট গঠন করে বিরোধী ৮টি দল।

অন্যদিকে, করোনা মহামারির উর্ধ্বগতি ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মোদি শুধু বিরোধী দল নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে গোটা বিজেপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। এ পরাজয় মোদিকে নিজ দলের কাছেও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মতো মিত্রের বিদায়ের পর মোদির ভবিষ্যতও কি একইপথে যাবে কিনা, তা জানা যাবে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর।

২০১৯ সালেই নেতানিয়াহু ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রীর তকমা পেয়েছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। সে সময় থেকেই বিরোধী দলগুলো তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী জোট গঠনের দিকে অগ্রসর হয়।

নেতানিয়াহু বলয়ের দুই প্রভাবশালী নেতা ইয়ার লাপিড এবং নেফতালি বেনেট নতুন একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের বিষয়ে চুড়ান্ত চুক্তিতে উপনীত হন। বেনেটের সাথে চুক্তি করার আগে ইয়ার লাপিড ইসরায়েলের ইসলামিক দল ইউনাইটেড আরব লিস্টের সাথেও একটি সমঝোতায় চলে আসে। এ কোয়ালিশন সরকারটি গঠন হলে ইসরায়েলের ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনো সরকার হতে যাচ্ছে, যার শরিক দল হিসেবে একটি আরবপন্থী ইসলামিক দল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি গত মার্চের নির্বাচনে একক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও জাতীয়তাবাদী মিত্র দলগুলো মিলে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। লিকুদের অতি ডানপন্থী মিত্ররা আরব দল ইউনাইটেড আরব লিস্টের সাথে কোয়ালিশন গড়তে রাজি হয়নি। সর্বশেষ নির্বাচনে এই আলোচিত আরব দলটি বেশ কিছু আসন জিতে নিয়ে ইসরায়েলি রাজনীতির নতুন কিং-মেকার হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। এবার চোখ ফেরানো যাক ভারতের দিকে।

নেতানিয়াহু ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার দিক থেকে ভারতেও বেশ এগিয়ে। তার ঘনিষ্ঠ মিত্র নরেন্দ্র মোদি নিজ দেশে বন্ধু নেতানিয়াহুর ইতিবাচক ইমেজ তৈরিতে অনেকটা ভূমিকা রেখেছেন। এই দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দুই নেতার বন্ধুতের অসংখ্য ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ভাইরাল হয়েছে।

২০১৯ সালে মোদি দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর নেতানিয়াহু প্রথম বিদেশী নেতা হিসেবে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। একই বছর ভারতে কর্মরত ইসরায়েলি দূতাবাস ভারতের সাথে মিত্রতাকে সম্মাননা জানাতে গিয়ে অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে একটি ভিডিও আপলোড করে। যাতে দেখা যায়। নেতানিয়াহু এবং মোদি একসাথে বলিউডের একটি সিনেমার গানের সাথে পারফর্ম করছেন। এই টুইট প্রকাশিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মোদিও দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে হিব্রু ভাষায় টুইট করে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও উগ্রবাদী এবং চরমপন্থী হিসেবে নেতানিয়াহু ও মোদির ইমেজ তৈরি হয়েছে। বিশ্ব নেতারা এই দুজন মানুষকে অনেকটা একই মানসিকতার হিসেবেই বিবেচনা করেন।

ইসরায়েলি রাজনীতিতে নেতানিয়াহু কোনঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন যখন তার বিরুদ্ধে একের পর এক ঘুষ এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আসতে থাকে। যদিও নেতানিয়াহু বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। কিন্তু রাজনীতিতে কট্রর অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

নেতানিয়াহু তার দীর্ঘ ক্ষমতার মেয়াদের প্রায় পুরে সময় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে অবৈধ ইহুদি বসতি গড়ার কাজ করে গেছেন। তার এ কৌশল ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল। কিন্তু নেতানিয়াহুকে থামানো যায়নি। নেতানিয়াহুর এ মানসিকতা দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই নষ্ট করেছে। অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রও নেতানিয়াহুর এসব নীতির সাথে একমত হতে পারেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই মনোভাবকে পুঁজি করে নেতানিয়াহুর বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। বিরোধী নেতা জিপি লিভনি অভিযোগ করেন, নেতানিয়াহুর উগ্রপন্থী এবং একপেশে নীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থেকে ইসরায়েল বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। বিরোধী নেতারা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি বড়ো আকারের দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। এরমধ্যে ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ আছে। আবার আসা যাক নেতানিয়াহুর বন্ধু মোদির প্রসঙ্গে

২০১৪ সালে মোদি যখন প্রথমবারের মতো বিজয়ী হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন বলা হয়েছিল, মোদিঝড়ে বিজেপি ক্ষমতার এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, দীর্ঘ কয়েক যুগ পরে ভারতে একজন বলিষ্ঠ মানসিকতার প্রধানমন্ত্রী এসেছে। যিনি আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সাহসী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এর আগে ভারত শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে।

মোদির নেতৃত্বে ভারত ক্রমাগতভাবে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। পাশাপাশি, সীমান্তবর্তী দেশগুলোকেও বার্তা পাঠায় ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করার কোনো রকমের দুঃসাহস দেখালে তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে।

২০১৯ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং জানান, ভারত তিনটি সার্জিকাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসীদের কয়েকটি ঘাটি ধ্বংস করে দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে উরি সন্ত্রাসী হামলা এবং পুলওয়ামায় ৪০ জন ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ২০১৬ সালে একটি কোভার্ট অপারেশন চালানো হয়। ২০১৯ সালেও আরেক দফা বিমান হামলা চালানো হয়। তবে, তৃতীয় সার্জিকাল অপারেশনটির বিষয়ে রাজনাথ সিং খোলাসা করে কিছু বলেননি।

ধরে নেয়া হয়, ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের জুনে মিয়ানমারে এই বিতর্কিত সার্জিকাল স্ট্রাইকটি পরিচালনা করা হয়। মনিপুরের চান্দেল জেলায় ১৮ জন ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মী হত্যার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের সীমানার ভেতরে ঢুকে ভারত এ অপারেশনটি পরিচালনা করে। ভারত মিয়ানমারের সে অপারেশনে যথেষ্ট সফলতার দাবি করলেও প্রকৃত সফলতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

ভারত এসব সার্জিকাল অপারেশনে সফলতা দাবি করলেও তা নিয়ে বির্তক সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালাতে গিয়ে একটি মিগ- টুয়েন্টি নাইন ধ্বংস হয় এবং পাকিস্তানিদের হাতে একজন পাইলট আটক হন। এরপর ২০২০ সালে চীনের সাথে সীমান্তে বড়ো আকারের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ভারত। চীন এ সংঘাতে ২০ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যার দাবি করে। তবে, চীনের কোনো সেনার হতাহতের বিষয়ে ভারতীয় প্রশাসন কোনো তথ্য দিতে পারেনি। পরে চীন জানায় তাদের ৪ জন সৈন্য মারা যায়।

লাদাখ সীমান্তে চীনের কাছে ধরাশায়ী হওয়ায় কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলো মোদির সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। এরমধ্যে নরেন্দ্র মোদির জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে করোনা। মহামারী মোকাবেলায় ব্যর্থতা এবং পশ্চিমবঙ্গসহ প্রাদেশিক নির্বাচন গুলোতে বিজেপির বড়ো আকারের পরাজয় মোদির জন্য এখন বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

বিশ্ব মিডিয়াতেও ভারতের দুর্বল স্বাস্থ্যখাত এবং মোদি প্রশাসনের অদূরদর্শী নেতৃত্ব ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু, লাশ সৎকার না করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া বা পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশে দেখা যায়নি।

এমন পরিস্থিতিতেও মোদি সরকার উন্নয়নের নামে বড়ো বাজেটের পরিকল্পনা ছাড় দিয়েছে। নাগরিকদের জীবন নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে অন্যান্য ঐচ্ছিক খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মোদি সরকার করোনা থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাইছেন বলেও সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক সময় মোদির জয়জয়কার ছিলো। কিন্তু গত এপ্রিলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেন্ড হয়ে যায় রিজাইন মোদি এবং সুপারস্প্রেডার মোদি। মমতা বন্দোপাধ্যয়ের তৃণমূলের জয়ের পর টুইটারে ‘বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রী চাই’ ট্রেন্ডেরও ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়।

ভারতের সিভিল সোসাইটি এবং লেখক, সাংবাদিক ও বিনোদন জগতের বাসিন্দারাও মোদির সমালোচনায় আস্তে আস্তে মুখ খুলছেন। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে মোদিকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, ২০২৪ সালের বৈতরণী পার হওয়া নরেন্দ্র মোদির জন্য মোটেও সহজ হবে না। বরং তার পথও ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র নেতানিয়াহু বা ট্রাম্পের মতো হয়ে যেতে পারে।