হিমালয়ে বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠিয়েছে চীন


  • মেহেদী হাসান
  • ০৯ জুন ২০২১, ১৫:০৩

ভারতসংলগ্ন পশ্চিম হিমালয় অঞ্চলে চীন তাদের সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেমসহ বিপুল ভারি আর বিধ্বংসী সমরাস্ত্র জমায়েত করেছে। চীনা আর্মির জিনজিয়াং মিলিটারি কমান্ডের হিমালয় ইউনিটে পাঠানো হয়েছে শক্তিশালী এসব আধুনিক সমরাস্ত্র। বিশ্লেষকদের মতে, হিমালয় সীমান্তে নতুন করে চীন-ভারত সঙ্ঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চীনা সমরাস্ত্র মোতায়েন ঘটনা এর প্রমাণ। দুই দেশের মধ্যে যদি নতুন করে সীমান্ত সঙ্ঘাত ঘটে, তবে তা ২০২০ সালে লাদাখে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

বরফ আচ্ছাদিত হিমালয় অঞ্চলে আধুনিক ভারি অস্ত্র মোতায়েন রাখা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। চীন নতুন করে যেসব অস্ত্র সেখানে পাঠিয়েছে তা উঁচু পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা হয়। ২০২০ সালের জুনে লাদাখ সঙ্ঘাতের পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন ও ভারত গালওয়ান ভ্যালি থেকে সৈন্য ও অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছে।

কিন্তু বিতর্কিত অন্যান্য এলাকায় উভয় দেশের সৈন্য এবং সমরাস্ত্র মোতায়েন অব্যাহত রয়েছে। ফলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দুই দেশের সীমান্ত সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা সবসময়ই রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা অফিস অব দি ডিরেক্টর অব ইন্টেলিজেন্স-এর বার্ষিক প্রতিবেদনেও চীন-ভারতের সঙ্ঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন হিমালয় সীমান্তে চীনা ভারি অস্ত্র মোতায়েন এ আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

মে মাসে চীন পশ্চিমের বরফঢাকা সীমান্তে পাঠিয়েছে সেলফ প্রপেল্ড মর্টার যা ফোর্থ নিউ টাইপ অব উইপনস সিস্টেম। এর সাথে তারা এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছে নতুন ১২২-মিলিমিটার ক্যালিবার সেলফ প্রপেল্ড হাউইজার, আরমারড অ্যাসল্ট ভিহিক্যাল এবং দীর্ঘপাল্লার মাল্টিপল রকেট লঞ্চার সিস্টেম।

হিমালয় ইউনিটে এসব অস্ত্র কমিশনিং সিরিমনি উপলক্ষে অনেক সৈন্য পরেছে নাইট ভিশন গগলস। যা তাদের রাতে যুদ্ধে সক্ষমতার প্রমাণ। চীনা সরকারি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনা লিবারেশন আর্মি পিএলএ নতুন সেলফ প্রপেল্ড র‌্যাপিড-ফায়ার মর্টার মোতায়েন করেছে মোবাইল হিট-এন্ড রান ফায়ারিং পজিশনে।

সমর বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ধরনের মর্টার মোতায়েন করা হয়েছে যেগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণে কার্যকর। কারণ পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক উঁচু বা অনেক নিচুতে সবসময় শত্রুর অবস্থানের কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আসুন জেনে নেই চীন কী ধরনের সমরাস্ত্র মোতায়েন করেছে।

এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সীমান্তে যেসব মিসাইল সিস্টেম এবং রকেট আর্টিলারি চিহ্নিত করা হয়েছে, তা এইচকিউ-সেভেনটিন এ-ফিল্ড এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম এবং পিএইএল-ইলেভেন, ওয়ান টু টু এমএম ক্যালিবার সেলফ প্রপেল্ড মাল্টিপল রকেট লঞ্চার সিস্টেম। এইচ কিউ-সেভেনটিন-এ মিসাইল চীনের সবচেয়ে আধুনিক ফিল্ড এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম। ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ডে মিলিটারি প্যারেডের সময় এটি তারা প্রকাশ্যে আনে। আর একটি পিএইচএল-ইলেভেন ৪০টি রকেট বহন করতে পারে। এর রয়েছে শক্তিশালী ফায়ার পাওয়ার।’

প্রিসিশন মিসাইল এসব অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুর্গম উঁচু পাহাড়ে অনেক বেশি মর্টার নিয়ে যাওয়া কঠিন কাজ। এ এক্ষেত্রে পরিবহন হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও খুব বেশি লাভ হয় না।

গ্লোবাল টাইমসের খবরে বলা হয়েছে হিমালয় অঞ্চলে জড়ো করা সেলফ প্রপেল্ড মর্টার সিস্টেম চার চাকার অফ রোড এসল্ট ভেহিক্যাল। চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে হিমালয় অঞ্চলে পাঠানো সেলফ প্রপেল্ড হেভি রকেট লঞ্চার হাইলি মোবাইল, ফাস্ট রিএকটিং, হাইলি একুরেট, ভেরি ডেডলি এবং জেমিং রেসিসট্যান্ট ক্ষমতাস্পন্ন।

গ্লোবাল টাইমসের খবরে বলা হয়েছে দুর্গম মূল অঞ্চল দখল, নিয়ন্ত্রন, উঁচু পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় সম্মিলিত হামলার মিশনের জন্য এসব অস্ত্র দ্রুত মোতায়েন করা হবে। দীর্ঘ পাল্লার মাল্টিপল রকেট লঞ্চার উঁচু পাহাড়ি এলাকার বড় অঞ্চল কাভার করে এবং এর রয়েছে শক্তিশালী ফায়ার পাওয়ার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চীনা রকেট যে শুধু দীর্ঘ পাল্লার তাই নয়। বরং গাইডেন্স সিস্টেমসহ এর রয়েছে লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করার নিখুত ক্ষমতা। অনেক মিসাইল স্যাটেলাইট পজিশনিং সিস্টেমের সাথে যুক্ত এবং এর কয়েকটি আঘাতে চোখের পলকে শত্রুর ঘাটি মাটিতে মিশিয়ে দিতে সক্ষম।

চীন-ভারত হিমালয় অঞ্চলের সীমান্তে ঠান্ডা আর দুর্যোগপূর্ন আবহাওয়া এখন কম। এ সময়ে বেইজিং সেখানে নতুন অস্ত্র সরবরাহ করল। গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুই দেশের সীমান্ত সংঘাত বছরের এ সময়টাতে সাধারণত শুরু হয়। নতুন অস্ত্র কমিশনের সাথে সাথে চীনা আর্মি সেখানে রকেট লঞ্চার সিস্টেম এডাপশন টেনিং এবং টেকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু করেছে।

চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে নতুন, আধুনিক আর শক্তিশালী সমরাস্ত্র পেয়ে খুশী হিমালয় অঞ্চলে চীনা সৈন্যরা। তারা জানিয়েছে এসব অস্ত্র খুব ফাস্ট এবং তাদের কঠোর পরিশ্রমের হাত থেকে রক্ষা করবে। এসব অস্ত্র তাদের জন্য বিগ চেঞ্জ।

অনেক বিশ্লেষকের মতে উঁচু পাহাড়ি এলাকায় এসব অস্ত্র মোতায়েন করা মানে যুদ্ধের ইঙ্গিত। আর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এসব অস্ত্র মোতায়েনের খবর প্রকাশও ইঙ্গিতপূর্ণ।

হিমালয়ের মত উঁচু এলাকায় যেখানে অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে সেখানে চীনের এ ধরনের সমরাস্ত্র মোতায়েন করা ট্যাকটিক্যাল সক্ষমতা এবং সুবিধার প্রকাশ।

গ্লোবাল টাইমসের খবরে বলা হয়েছে চীনা লিবারেশন আর্মির জিনজিয়াং মিলিটারি কমান্ড একটি পরিপূর্ণ, আধুনিক গ্রাউন্ড কমব্যাট সিস্টেম গড়ে তুলছে। যা হিমালয় অঞ্চলে যুদ্ধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মে মাসের শেষের দিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জয়শঙ্কর ২০২০ সালের ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাতের জন্য চীনকে দায়ী করেছেন। দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বন্ধ না হলে তিনি মারাত্মক অর্থনৈতিক পরিণতির হুশিয়ারি উচ্চরণ করেন।

প্রায় এক বছর আগে লাদাখে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পরও এখনো বিতর্কিত এলাকায় উত্তেজনা রয়ে গেছে। উভয় দেশের এখনো হাজার হাজার সৈন্য সেখানে মোতায়েন আছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র মোতায়েন আছে। সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত ১১ দফা বৈঠক করেছেন। উন্নতি হয়েছে সামান্য। এ অবস্থায় ভারত সীমান্তে বড় আকারে উচ্চ প্রযুক্তির চীনা সমরাস্ত্র শঙ্কা ও কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।

এক বছর আগে গালওয়ান রিভার ভ্যালিতে মধ্যযুগীয় কায়দায় চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাতে ২১ জন ভারতীয় এবং কমপক্ষে চার জন চীনা সৈন্য নিহত হয়। এরপর উভয় দেশ সেখানে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করে। পরবর্তীতে দুই দেশের মুমোখুখি অবস্থানের অবসানে ভারত প্রথম উদ্যোগ নেয়।

ভারতীয় আর্মির প্রকাশিত ফটো এবং ভিডিওতে দেখানো হয় চীনা আর্মি তাদের সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি ছিল চীনা ট্যাঙ্ক এবং আরমারড ভেহিক্যাল সরিয়ে নেওয়া।

ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবী চীন সেখান থেকে একাই ২০০ ট্যাঙ্ক সরিয়ে নিয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার হয় গত বছর , উভয় দেশ গালওয়ান ভ্যালিতে কী পরিমাণ সমরাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। আর সীমান্তে উভয় দেশের পরবর্তী সংঘাত হতে পারে গত বছরের তুলনায় আরো মরণঘাতী।

সাধারণত হিমালয়ের উঁচু এ অঞ্চলে বড় আকারে সমরাস্ত্র মোতায়েন বিরল ঘটনা। কারণ বাতাসের কম চাপ, বরফ পরিস্থিতি, এবং দুর্গম এলাকার কারণে সেখানে সমরাস্ত্র রক্ষাণাবেক্ষণ কঠিন।

প্রায়ই ইঞ্জিন বিকল হয়ে অনেক সমরাস্ত্র ও সমরযান অকেজো এবং নষ্ট হয়ে যায়। প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে আধঘন্টা করে ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু রাখতে হয়। যাতে ফ্রিজিং থেকে রক্ষা পায়। ফলে এ অঞ্চলে যুদ্ধ জয় সব পক্ষের জন্য দুরূহ।

গালওয়ান ভ্যালি থেকে সৈন্য ও অস্ত্র প্রত্যাহার উদ্যোগের ফলে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে শান্তির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আবার অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীন-ভারত ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার বিতর্কিত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল রয়েছে। বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এ যুদ্ধে শোচনীয় অবস্থার শিকার হয় ভারত এবং আকসাই চীন দখল করে চীন।