মাফিয়া ডন নিয়ে বেকায়দায় এরদোয়ান সরকার

মাফিয়া বস সেদাত পেকার - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ০৯ জুন ২০২১, ১৪:৪৫

সেদাত পেকার তুরস্কের এক মাফিয়া বস। যিনি অপরাধ জগতের ডন হিসেবে পরিচিত। চাঁদাবাজি, খুন, সহিংসতাসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণে ৯০-এর দশক থেকেই কুখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। বিভিন্ন সময়ে জেলও খেটেছেন তিনি। দেশটির অন্যান্য মাফিয়া নেতাদের মতো তিনিও চরম ডানপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলে ইউটিউব চ্যানেলে সেদাত পেকারের কিছু ভিডিও প্রচারিত হয়েছে। পুরো মে মাস জুড়ে প্রচারিত এসব ভিডিও দেশটির কোটি কোটি মানুষ দেখেছে, যা এরদোয়ান সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।

সেদাত পেকারের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তিনি দেশটির সাকারিয়া প্রদেশের আজাপাদারি এলাকায় ১৯৭১ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষেরা ককেশাস অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। বর্তমানে তুর্কি নাগরিক হলেও তিনি দীর্ঘদিন জার্মানিতে ছিলেন। তুরস্কে এক মাদক পাচারকারীকে হত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। অবশ্য এই অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পান। তবে বিচারে তার দুই সহযোগীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

হত্যামামলা থেকে খালাস পাওয়ার পর সেদাত পেকার রোমানিয়ায় পালিয়ে যান। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১৭ আগস্ট তার ইচ্ছাতেই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর অন্য একটি মামলায় ১৯৯৯ সালে তার ৯ মাস কারাদণ্ড হয়। ২০০৫ সালে ‘অপারেশন বাটারফ্লাই’ নামে পরিচালিত এক অভিযানে সেদাত পেকারকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর কয়েক বছর তিনি কারাগারে ছিলেন।

২০০৭ সালে একটি অপরাধমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, ডাকাতি, জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাকে ১৪ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ‘এরজেনেকন’ নামে একটি গোপন সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৩ সালে তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া দেয়া হয়। কয়েকমাস পরই তিনি মুক্তি পান।

এরপর থেকে সেদাত পেকার প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তার সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থকে পরিণত হন। তিনি সরকারের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালাতে থাকেন ও সভা সমাবেশের আয়োজন করেন। পেকার সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধেও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

পেকার তার বিরুদ্ধে থাকা বিভিন্ন মামলার বিচার এড়াতে ২০২০ সালের শুরুর দিকে তুরস্ক ছেড়ে বলকান অঞ্চলের দেশ মন্টেনেগ্রো চলে যান। পরে সেখান থেকে মরক্কো যান। এরপর যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। আঙ্কারার প্রধান সরকারি কৌসুলির অফিস থেকে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এরপর তুর্কি পুলিশ এপ্রিল মাসে তার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেদাত পেকার অভিযোগ করেছেন, তল্লাশিকালে পুলিশ তার স্ত্রী ও মেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।

পুলিশের এই তল্লাশির পর থেকে তিনি তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, মাদক পাচার, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সংগঠিত অপরাধ ও সহিংসতাসহ নানা অভিযোগ তুলে ইউটিউবে ভিডিও প্রচার করা শুরু করেন। দুবাইয়ের একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে তিনি এসব ভিডিও তৈরি ও প্রচার করেছেন বলে জনিয়েছেন। একটি ভিডিওতে তিনি বলেছেন, তার শত্রুরা অবশ্যই পরাজিত হবে। ট্রাইপড ও একটি ফোন ক্যামেরার সাহায্যেই তিনি তাদেরকে পরাজিত করবেন। ভিডিওতে কথা বলার সময় তাকে মাঝেমধ্যে কাগজে নোট করা তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিতেও দেখা যায়।

পুরো মাসে ইউটিউবে অন্তত ৮টি ভিডিও ছাড়েন সেদাত পেকার। এসব ভিডিও তুরস্কে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারা মাসে প্রায় ৬ কোটি মানুষ এই ভিডিওগুলো দেখেছে। এসব ভিডিওর কারণে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। তবে ভিডিওতে আনা অভিযোগ গুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অস্বীকার করেছেন।

তার উত্থাপিত সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ গুলোর মধ্যে রয়েছে ৯০ এর দশকে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ আগারের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে দুজন সাংবাদিককে হত্যাসহ বেশ কিছু রাজনেতিক হত্যাকান্ডের অভিযোগ করা হয়েছে ভিডিওতে। এছাড়া সাম্প্রতিককালে তার বিরুদ্ধে মাদক কারবারে জড়িত থাকর অভিযোগও করেছেন পেকার।

ভিডিওগুলোর একটিতে তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আগারের ছেলে ও বর্তমানে একে পার্টির এমপি তোলগা আগার এর বিরুদ্ধে কাজাখস্তানের নারী সাংবাদিক ইয়েলদানা কাহারমানকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ করেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে কুতলু আদালি নামে এক জনকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগও করেন পেকার।

সদাত পেকার আরেকটি ভিডিওতে তোলগা আগার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিমের ছেলে ইরকানের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলারও অভিযোগ করেন। তারা মাদক পাচারের একটি রুট তৈরির জন্য তারা দু’জন ভেনেজুয়েলা সফর করেছেন বলে অভিযোগ করেন। কোন ভিডিওতেই তিনি তার অভিযোগের সপক্ষে কোনো দালিলিক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। মোহাম্মদ আগার সেদাত পেকারের সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এগুলো চরম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই না। তিনি এ বিষয়ে যে কোন ধরণের তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্যদিকে তার ছেলে তোলগা তার বিরুদ্ধে বিদেশি নারী সাংবাদিককে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব আভিযোগ তার সম্মানহানি করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। ওই নারী সাংবাদিককে তিনি চিনতেনই না। এছাড়া ঐ হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্ত করা হয়েছে এবং বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিম বলেছেন, তারা সেদাত পেকারের ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করছেন। তার ছেলের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের সাথে জড়িত থাকার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। তার ছেলে ভেনেজুয়েলা গিয়েছিল দেশটিকে কোভিড-১৯ এর টেস্ট কিট ও মাস্ক সরবরাহ করতে।

সেদাত পেকার তার ভিডিওগুলোতে প্রধান টার্গেট করেছেন তুরস্কের বর্তমান প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সয়লুকে। তাকে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উত্তরসুরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পেকার ভিডিওতে দাবি করেন, সুলেমান সয়লুর সাথে অতীতে তার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি তাকে পুলিশি নিরাপত্তা দিতেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে থাকা বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগের তদন্ত থেকেও তাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন সুলেমান। পেকার দাবি করেন, সুলেমান রাজনীতিতে দ্রুত উত্থানের জন্য একে পার্টিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বি এরদোয়ানের জামাতা সাবেক অর্থমন্ত্রী বেরাত আলবায়রাকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান সংহত করার জন্য তার সহায়তা চেয়েছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সয়লু তার সম্পর্কে সেদাত পেকারের এসব বক্তব্যকে নির্জলা মিথ্যাচার হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি যেহেতু সংগঠিত অপরাধ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন সেজন্যই তাকে টার্গেট করা হচ্ছে।

পেকার প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সম্পর্কে ভিডিওগুলোতে কোন অভিযোগ উত্থাপন করেননি। বলেছেন, এরদেয়ানকে তিনি খুবই শ্রদ্ধা করেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পেকারের ভিডিও নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, পেকারের এসব ভিডিও তুরস্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। সেদিন একে পার্টির এক সমাবেশে এরদোয়ান বলেন, ‘আমরা এই দুষ্টচক্রের অপতৎপরতা অবশ্যই দমন করব। তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই পালিয়ে থাক না কেন, তাদেরকে ধরা হবে। এ বিষয়ে কারোরই কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুরস্ক সরকার হয়তো আশা করছে, সেদাত পেকারের ভিডিওকে কেন্দ্র করে তুরস্কের জনগণের মধ্যে যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুতই দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এসব ভিডিও দেশে ও দেশের বাইরে থাকা তুর্কি জনগণের বিরাট অংশের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ এবং ব্রুকিংস দোহা সেন্টারের ফেলো গালিপ দালায় এর মতে, এ কে পার্টির নেতাদের নানা কেলেঙ্কারি সম্পর্কে সেদাত পেকার তার ভিডিও গুলোতে যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন তার একটি বিরাট প্রভাব পড়েছে তুর্কি জনগণের মধ্যে।

পেকার অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভিডিওতে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে কিছু কিছু অভিযোগের সঙ্গে তার নিজের সম্পৃক্ততার কথাও বলেছেন যা মানুষের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে । ২০১৫ সালে এ কে পার্টির এক নেতার হয়ে তিনি হুরিয়াত পত্রিকা অফিসে বোমা হামলা করেছিলেন বলে ভিডিওতে উল্লেখ করেছেন। তার এই কথা তুরস্কের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছে। ভিডিও গুলোর কোথাও পেকার নিজেকে নির্দোষ বা ধোয়া তুলসি পাতা দাবি করেননি। এটাও তার ভিডিওগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার একটি বড় কারণ যা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারে।