জীবাণু অস্ত্র : চীন-যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি

চীনের উহান গবেষণাগার - সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ জুন ২০২১, ১৫:২৫

চীনের উহান গবেষণাগার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। বাইডেন প্রশাসন এই তত্ত্ব সামনে রেখে তদন্তকাজ শুরু করেছে। উহানের ল্যাবরেটরি থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার নতুন দাবি ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আবার নতুন করে তিক্ত হচ্ছে। যদিও চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং অভিযোগ গত বছরই সমাধান হয়ে গেছে। বাইডেন প্রশাসন নতুন দাবির তদন্ত শুরু করায় অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই দাবিকে বৈধতা দিতে পারে। চীন করোনাভাইরাস সৃষ্টি করেছে এবং ছড়িয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠিত হলে চীনের জন্য অশুভ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আর এর ফলাফল বিশ্ববাসীর জন্যও শুভকর হবে না।

করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি অভিযোগ করেন, চীন ইচ্ছা করে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। চীনের উহান প্রদেশের সাথে মিলিয়ে তিনি করোনাভাইরাসকে নাম দেন উহান ভাইরাস। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ এন্থনি ফাইসিসহ বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা সংস্থা থেকে জানানো হয়, করোনাভাইরাস চীনের ল্যাবরেটরি থেকে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ গোয়েন্দা এজেন্সি অফিস অব দি ডাইরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ৩০ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানায়, করোনাভাইরাস মানুষের তৈরি নয়। এটি জেনেটিক্যালি মডিফায়েডও নয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সম্প্রদায় বৈজ্ঞানিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। এ খবর বার্তা সংস্থা রয়টার্সসহ সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

এর আগে ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়, সকল তথ্য-প্রমাণ অনুসারে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে প্রাণী থেকে। এটি ম্যানিপুলেট বা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়নি।

এখন নতুন করে আবার এ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে এসেছে। নতুন তত্ত্ব অনুসারে চীনের উহান প্রদেশের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির বিজ্ঞানীরা বায়োলজিক্যাল অস্ত্রের অংশ হিসেবে করোনাভাইরাসের জন্ম দিয়েছে। এরপর আশপাশের এলাকায় এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা অতিমারির রূপ নেয়।

ব্রিটেন ও নরওয়ের দুই বিজ্ঞানী সম্প্রতি তাদের এক গবেষণাপত্রে সরাসরি বলেছেন, ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস সৃষ্টি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। গুহায় পাওয়া বাদুরের মেরুদন্ড থেকে প্রাকৃতিক করোনাভাইরাসকে চীনা বিজ্ঞানীরা পরিবর্তন করেছেন। তাকে উচ্চ মাত্রায় সংক্রামকযুক্ত করা হয়েছে যা কোভিড-১৯ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। তাদের দাবি চীনা বিজ্ঞানীরা এটি করেছেন গেইন অব ফাংশন প্রকল্পের অংশ হিসেবে। গেইন অব ফাংশন প্রকল্পে প্রাকৃতিক উপায়ে পাওয়া ভাইরাসকে সংক্রামক করে দেখা হয় তা মানবদেহে কী প্রভাব বিস্তার করে। বাদুরের মেরুদন্ডে পাওয়া করোনাভাইরাসকে ভয়াবহ এবং অতি উচ্চ মাত্রায় সংক্রামকযুক্ত করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. এন্টনি ফাউসি সম্প্রতি বলেছেন, ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস লিক হওয়া বা ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্বটি প্রশংসনীয়। অথচ ২০২০ সালে তিনি উহান ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কয়েক সপ্তাহ আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে উহানের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির তিনজন সদস্য অসুস্থ হন। যার লক্ষণ ছিল করোনার উপসর্গের মতো।

এরপর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে করোনাভাইরাস থিওরির সত্যতা নিশ্চিত হতে আদেশ দিয়েছেন। ল্যাব-লিক থিওরি এবং জুনোটিক থিওরির মধ্যে কোনটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিশ্চিত হতে হবে। ল্যাব-লিক এবং জুনোটিক থিওরি অনুযায়ী করোনাভাইরাস হয় প্রকৃতিতে জন্ম নিয়েছে অথবা কোনো প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবশে করেছে।

এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘ চীনের আচরনে এটা পরিষ্কার বিশ্ব স্বাস্থ্যের চেয়ে চীনা সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থা এড়িয়ে চলাকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। করোনা নিয়ে স্বচ্ছ তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও বেইজিং করোনা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা গোপন করছে।

ল্যাব-লিক থিওরি বা চীনের উহান ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এ দাবি নিয়ে চীন অতিমাত্রায় স্পর্শকাতরতা দেখিয়ে আসছে। চীনা সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

২০২০ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দাবি করেন উহান ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়।

মাইক পম্পেওর দাবির কড়া জবাব দেয় চীন। চীন পাল্টা অভিযোগ করে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস রয়েছে জীবাণু অস্ত্রের যুদ্ধ চালানোর। করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ফোর্ট ডেট্রিক আর্মি ল্যাবরেটরি থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ করে চীন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান জানান, যুক্তরাষ্ট্রে প্রশক্ষনে থাকা চীনা আর্মির সদস্যরা ২০১৯ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথম করোনাভাইরাস উহানে বহন করে নিয়ে আসে।

ল্যাব-লিক থিওরির পক্ষে এখন পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ ও বৈজ্ঞনিক ভিত্তি নেই। নতুন করে এ থিওরি সামনে আসার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। ফলে এমন অভিযোগের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাৎপর্য আর পরিণতি রয়েছে।

যদি ল্যাব-লিক থিওরি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে চীন আরেকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবে। জাতিসংঘের জীবাণু অস্ত্র চুক্তি অনুযায়ী জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারই শুধু নিষিদ্ধ নয় বরং এর উদ্ভাবন এবং উৎপাদনও নিষিদ্ধ। চীন ১৯৮৪ সালে এ চুক্তি সাক্ষর করেছে।

নতুন করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আসায় মহামারি রোগ গবেষণায় চীনের সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত হবে। চীন সরকার সহযোগিতা না করলে ল্যাব-লিক থিওরি না প্রাকৃতিক উপায়ে সংক্রমন ঘটেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে জানা যাবে না। এর ফলাফল সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যাবে। বিশ্বের অগণিত মানুষকে এ রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে এর উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত করে জানা অত্যন্ত জরুরি।

বাইডেন প্রশাসন ল্যাব-লিক থিওরিকে বৈধতা দিতে চাচ্ছেন। এর মানে হলো চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নতির পরিবর্তে তিক্ততা আরো বাড়বে। বাইডেন বেইজিংকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইছেন। বাইডেনের এমন পদক্ষেপে অনেকে বিস্মিত। ল্যাব-লিক থিওরি নিয়ে তদন্ত শুরু হয় ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে। এটিকে অস্বচ্ছ এবং অদক্ষ আখ্যায়িত করে বাইডেন প্রশাসন মার্চে এটি বন্ধ করে দিয়েছিলো।

এখন বাইডেন আবার নতুন করে ল্যাব-লিক থিওরি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়ায় চীনের জন্য একটি খারাপ বার্তা দেখা হচ্ছে। বেইজিং কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন,যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন যেন চীনের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ এবং যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করে।

ল্যাব-লিক থিওরি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাকে বাইডেনের তদন্তের নির্দেশের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন রাজনীতির বিষয়ও জড়িত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম উহান ল্যাব থিওরি মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ তৈরি করছে। তাদের খুশী করতে বাইডেন এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে ট্রাম্পের তুলনায় বাইডেন চীনের প্রতি নতজানু, দুর্বল। তদন্তের আদেশের মাধ্যমে বাইডেন দেখিয়ে দিলেন তিনি চীন বিরোধীতায় ট্রাম্পের তুলনায় পিছিয়ে নেই।

বাইডেনের ঘোষণার জবাব দিতে দেরি করেনি চীন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে সরাসরি বলে দেয়া হয়েছে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়েছে মেরিল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র আর্মি ল্যাব ফোর্ট ডেট্রিক থেকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উদার গণাতিন্ত্রক বলে পরিচিত ডেমোক্রেট সরকারের সাথে চীনের সম্পর্ক আরো তিক্ত হতে যাচ্ছে। অনেকে আশাবাদী ছিলেন ট্রাম্পের পরিবর্তে ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় আসলে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নতি হবে। কমতে পারে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ।

করোনা, হংকং, তাইওয়ান এবং ইউঘুর ইস্যুতে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে চীনের ইমেজ খারাপ হয়েছে।

এখন নতুন করে ল্যাব-লিক থিওরি সামনে আসায় আরেক দফায় চীনের ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা চলবে। ট্রাম্প প্রশাসনের মত চীন-যুক্তরাষ্ট্র নতুন উত্তেজান সামনে আসতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় অনেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতের আশঙ্কাও করেছিলেন।

বর্তমানে ব্রিটেনও প্রকাশ্যে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করেছে এবং তাদের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ দক্ষিন চীন সাগরের পথে রয়েছে। বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরপরই ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল ঘিরে চীন বিরোধী তোড়জোড় শুরু করেন। সিরিয়ায় হামলার মাধ্যমে তিনি তার যুদ্ধ মিশন শুরু করেছেন। অতীতে যুদ্ধবাজ বুশের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার নজির রয়েছে বাইডেনের।