লাশে লাশে ফুলে উঠেছে গঙ্গা


  • মেহেদী হাসান
  • ৩১ মে ২০২১, ১৭:০৬

করোনায় মৃতদের সৎকার নিয়ে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। হিন্দি দৈনিক ভাস্কর গঙ্গার তীরে সাংবাদিক টিম পাঠিয়ে নদীর তীরে দুই হাজারের বেশি ভাসমান লাশ দেখতে পেয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পবিত্র গঙ্গা ফুলে উঠছে করোনায় মারা যাওয়া মৃতদেহে। শ্মশানে জায়গা না হওয়ায় এবং সৎকারের সামর্থ্য না থাকায় এখন করোনায় মৃতদের অনেকের জায়গা হচ্ছে নদী। শত শত মাইলজুড়ে নদীর তীরে সৃষ্টি হয়েছে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে করোনোর দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে আগে থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরন্দ্রে মোদির সমালোচনা শুরু হয়। এই সমালোচনা এখন তীব্র রূপ নিয়েছে করোনায় মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা প্রকাশ না করায়। ভারতের বেশির ভাগ মূলধারার গণমাধ্যম এখনও মোদি সরকারের চাটুকারের ভূমিকায় রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক গণমাধ্যম, সাংবাদিক লড়াইয়ে নেমেছে করোনার সঠিক তথ্য প্রকাশে। তারা মোদি সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। সরকারের তথ্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেরা হাসপাতাল, মরচুয়ারি, মিউনিসিপাল অফিস এবং শ্মশানে গিয়ে মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করছেন। কোনো কোনো গণমাধ্যম নদীতে ভাসমান লাশ গণনা শুরু করেছে। তাদের ওপর চলছে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের হুমকি আর ভয়ভীতি।

কোভিড পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলায় মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদি সরকার মনোযোগ দিয়েছে ইমেজ রক্ষায়। সরকার বলেছে, তারা চেষ্টা করছে মানুষ যাতে ভুল আর মিথ্যা তথ্য ছড়াতে না পারে। ভারতের দৈনিক ভাস্কর বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রি হওয়া সংবাদপত্রগুলোর একটি। এ পত্রিকার ন্যাশনাল এডিটর ওম গৌড় তার সাংবাদিকতার জীবনে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। এপ্রিলের শুরুতে গৌড় জানতে পারেন যে, বিহারের গঙ্গা নদীতে কিছু লাশ ভাসতে দেখা গেছে।

বিহার সরকারি কর্মকর্তাদের মতে এগুলো উজানের উত্তর প্রদেশ থেকে ভেসে আসতে পারে।

ঘটনা অনুসন্ধানে গৌড় ২৭টি জেলায় ৩০ জন সাংবাদিক পাঠান। তারা গঙ্গা নদীর ৬৮৪ মাইল জুড়ে অনুসন্ধান করে ২ হাজারের বেশি মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসতে অথবা সমাহিত অবস্থায় দেখতে পান।

দৈনিক ভাস্কর ভারতে হিন্দি ভাষার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা। গঙ্গায় ভাসমান মৃতদেহ অনুসন্ধানের পর তারা এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে মধ্য এপ্রিলে । তারা এর শিরোনাম দেয় ‘গঙ্গা লজ্জা পেয়েছে’। সিএনএনকে গৌড় বলেন, আমি আমার ৩৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন ঘটনার কখরো মুখোমুখি হয়নি।

মে মাসের শুরু থেকে ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সরকারি হিসেবে প্রতি দিন ৪ হাজারের মত মানুষ মারা যাচ্ছে। তবে সরকারি এ সংখ্যার তুলনায় বাস্তবে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক গুন বেশি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শহরের শ্মশানে সরেজমিন প্রতিবেদনে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে প্রকৃত মুত্যুর সংখ্যা আতকে ওঠার মত। অরুন্ধতী রায় লিখেছেন প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কোভিড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যারা সমালোচক তাদের বিরুদ্ধে দমন নীতি চলছে। এ অবস্থার মধ্যে ভারতের কিছু গণমাধ্যম ও সাংবাদিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে সরকার করোনা বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ করে।

নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া ঠেকাতে উত্তর প্রদেশ সরকার এখন টহল শুরু করেছে। দৈনিক ভাস্কর গঙ্গা নদীতে ভাসমান লাশ গণনা করে আসছে। আর এ দুর্যোগের জন্য তারা রাজনীতিবিদদের দায়ী করছে।
সিএনএন এর কাছে পত্রিকাটির সম্পাদক অভিযোগ করে বলেন, রাজ্য সরকারের কর্মকর্তারা খবর প্রকাশ না করার জন্য আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। এমনকি আদালতের হুমকিও দেয়া হয়েছে।

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাতের পর বিভিন্ন রাজ্যেস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে । শ্মশানে লাশ দাহ করে কুলাতে পারছেনা শ্মশানকর্মীরা। করোনার সঠিক তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক সংবাদ মাধ্যম বেছে নিয়েছে ‘সু-লেদার জার্নালিজম’ । অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ থেকে যখন প্রকৃত তথ্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই তখন নিজেরা উদ্যোগী হয়ে স্পটে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করা।

সাত বছর আগে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বিশাল গণমাধ্যম সরকারের অধীন হয়ে পড়ে। গণমাধ্যমকে চিয়ার লিডারে পরিনত করার জন্য নানা ধরনের দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে মোদি সরকার। বিরোধীদের চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া, বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণসহ নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। মোদি সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ভারতের অনেক গণমাধ্যম নীরব। কিন্তু দৈনিক ভাস্কর সরকারের বিরুদ্ধে লেগে আছে। যখন অনেক নামকরা টেলিভিশন সরকারের চাটুকারিতা করে যাচ্ছে তখন সংবাদপত্রটি কোভিড নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে ।

মোদীর নিজ রাজ্য গুজরাটের প্রথম সারির তিনটি স্থানীয় ভাষার পত্রিকা হলো সন্দেশ, দিব্য ভাস্কর এবং গুজরাট সমাচার। এ তিনটি পত্রিকা নিয়মিত প্রশ্ন উত্থাপন করে চলছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে। মধ্য মে তে দিব্য ভাস্কর তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে গুজরাটে আগের ৭১ দিনে ১ লাখ ২৪ হাজার ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করেছে । গত বছর একই সময়ের চেয়ে এ সংখ্যা ৬৬ হাজার বেশি। কিন্তু রাজ্য সরকার বলছে এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২১৮ জন মারা গেছে কোভিডে। দিব্য ভাস্করের সাংবাদিকরা জেলা এবং মিউনিসিপাল করপোরেশনে গিয়ে এবং ডাক্তার ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা জানার চেষ্টা করছে।

প্রায় শতাব্দী প্রাচনী সন্দেশ পত্রিকার সাংবাদিকরাও হাসপাতাল, মরচুয়ারি, শ্মশানে গিয়ে করোনায় দৈনি মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করছে। ৯ মে গুজরাট সমাচারের প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়েছে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের মোদির ভিস্তা প্রকল্প বা নতৃন সংসদ ভবন নির্মান নিয়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মনুষ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে তখন শাসকরা স্বৈরাচারে পরিণত হচ্ছে।

কিন্তু ভারতের মূল ধারার গণমাধ্যম গত কয়েক বছরে এ ভাবে দায়িত্ব নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেনি। বরং তারা সরকারের দেয়া তথ্য প্রচার করেছে। দি হিন্দু পত্রিকার সাংবাদিক মাহেশ লাঙ্গার সিএনএনকে জানান, ভারতের অনেক গণমাধ্যম মালিকরা ধুর্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

করোনোর কারনে ভারতের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। সরকারের বিজ্ঞাপনই ভরসা অনেক সংবাদ মাধ্যমের। এ অবস্থায় অনেক গণমাধ্যই সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চাইছে না। অনেকে ঝুকি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অনেকের ভবিষ্যত অন্ধকার।

যেসব গণমাধ্যম মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অনবরত সমালোচনা করে যাচ্ছে তারা যেমন বিপদে তেমনি বিপদে মোদির চাটুকার গণমাধ্যমগুলোও। কারণ মোদির জনপ্রিয়তা কমছে এবং পাঠক দর্শক মোদি সরকারের তোষামোদ আর পছন্দ করছে না। পাঠক দর্শক জানে তারা মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এসব অনেক গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ জানে তাদের সাংবাদিকরা রাস্তায় বের হলে মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে পারে।

সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবাদিকতার জন্য বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক ভারত তার মধ্যে অন্যতম একটি। রিপোর্টার্স উইদাইট বর্ডার এর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স তালিকায় ১৮০ টি দেশের তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৪২তম। সত্য প্রকাশ করলে এখানে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে । তবে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারতের অনেক সাংবাদিক সত্য প্রকাশের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

করোনায় নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়ার বিষয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো ভারতের পবিত্র নদী গঙ্গা ফুলে উঠছে কোভিডে মারা যাওয়াদের লাশে। শত শত মৃতদেহ ভাসছে নদীতে অথবা সমাহিত করা হয়েছে নদীর তীরের বালুতে। নদীর তীরে দিন রাত ২৪ ঘন্টা চলছে লাশ দাফনের কাজ। এসব দৃশ্য বলে দিচ্ছে করোনায় মৃত্যু নিয়ে সরকারের দেয়া তথ্য সঠিক নয়।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১০ মে বিহারে গঙ্গা নদীর তীরে ৭১টি মৃতদেহ ভেসে আসার পর উত্তর প্রদেশে করোনার ভয়বহতা বিশ্ববাসীর সামনে আসে। পরের দিন উত্তর প্রদেশের গাজীপুর জেলার নদীতে আরো কয়েক ডজন মৃতদেহ পাওয়া যায়। কান্নুজ, কানপুর, উন্নাও এবং প্রয়াগরাজের নদীর তীর ঘেষে দেখা গেছে অনেক অগভীর কবর। কান্নুজের মহাদেভ ঘাটে ৫০টি লাশ পাওয়া গেছে। বিবিসির কাছে পাঠানো ভিডিওতে দেখা গেছে নদীর তীরে শোকার্তো মানুষের ভিড়। প্রত্যেকেই ব্যস্ত মৃতদেহ লুকানোর কাজে।

কানপুরের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে জানান, এসব লাশ বলে দিচ্ছে মুত্যৃর প্রকৃত সংখ্যার সাথে সরকারি তথ্যের কত অমিল। সরকারি হিসেবে কানপুরে ১৬ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল করোনায় মারা গেছে ১৯৬ জন। কিন্তু সাতটি শ্মশান থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে এ সময়ে কানপুরে করোনায় মারা গেছে প্রায় ৮ হাজার।

বিবিসি সিএনএনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বহু করোনা রোগী বাড়িতে মারা গেছে। তাদের কোনো করোনো টেস্ট হয়নি। যাদের শ্মশানে নিয়ে লাশ পোড়ানোর সমার্থ্য নেই তারা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে অথবা নদীর তীরে কবর দিচ্ছে। নদীর তীরে কবর দেওয়া অনেক লাশ জোয়ারের সময় পানিতে ভেসে যাচ্ছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন দৃশ্য হৃদয়বিদারক। এরা কারও মা, কারও বাবা, কারও ছেলে বা মেয়ে। কারও ভাই বা বোন। মৃত্যুতে তারা কোনো সম্মান তো দূরের কথা তাদেরকে গণনায় পর্যন্ত ধরা হচ্ছে না। তাদের মৃত্যু এবং সৎকার দুটিই থেকে যাচ্ছে রেকর্ডবিহীন।