আনোয়ার ইব্রাহিম : জননন্দিত এক হতভাগ্য নেতা


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩০ মে ২০২১, ১৫:২২

মালয়েশিয়ার জননন্দিত রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিম একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নেতা। বারবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার হাতছানি পেলেও শেষ পর্যন্ত তা অধরাই থেকে গেছে। উল্টো মিথ্যা মামলায় জেলে খাটাই যেন তার নিয়তি। ৭৩ বছর বয়সী উদার ইসলামপন্থী এই নেতা কি তাহলে কোনোদিনই শীর্ষপদে বসতে পারবেন না? ফরেন পলিসির এক নিবন্ধে বিশ্লেষকরা অবশ্য আনোয়ারকে আশার বাণী শুনিয়েছেন।

আনোয়ার ইব্রাহিম কবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন? প্রবীণ রাজনীতিক এবং তার সমর্থকরা এই প্রশ্ন তুলছেন গত তিন দশক ধরে। একজন তরুণ মুসলিম ছাত্র ছাত্রনেতা থেকে সংস্থারপন্থী অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী থেকে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়া, বারবার কারাবরণ এবং মালয়েশিয়ার কয়েক দশকের শাসনকারী দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের প্রতিটি পর্যায়ে আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তার স্বপ্ন পূরণে অলংঘনীয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আনোয়ার বলেছেন কেন তাকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হচ্ছে। তার ভাষায়, আপনি যদি অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোন হন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হন, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর হন, সম্পদের পাহাড় গড়া কিছু পরিবারের বিরুদ্ধে কঠোর হন তাহলে শাসকগোষ্ঠীর কাছে তো আপনি জনপ্রিয় হতে পারবেন না। এ সম্পর্কে আমি পূর্ণ ওয়াকিবাল।

আমি একথা জানি যে আজও ধনকুবের ও রাজনৈতিক এলিটরা চান আনোয়ান ইব্রাহিম ছাড়া যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হয় হোক। যে কোনো মূল্যে তারা আমাকে ঠেকাতে চায়। কিন্তু কেন ? আমি কি বর্ণবাদী, ধর্মান্ধ নাকি দুর্নীতিবাজ? না এসব কিছুই না। তারা জানে যে আমি তাদের বাড়াবাড়ির লাগাম টেনে ধরব।

গত বছর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মাহাথির মোহাম্মদের নাটকীয় পদত্যাগের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম হয়। তিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠার প্রমাণ দেন দেশটির রাজাকে। কিন্তু নানা নাটকীয়তার পর তার আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হয়নি।

আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মনে হচ্ছে আমি বাস্তববাদী রাজনীতিক নই। আমি অতি সরলসোজা। তবে আমি আনন্দিত যে ২০১৩ সাল থেকে সব বাহিনী, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, আমার বিরুদ্ধে কাজ করলেও আমি ৫২ শতাংশ পপুলার ভোট পেয়েছি। এটা আমার আস্থার বড় কারণ। আমি জনগণের ভালোবাসা ও আস্থার ওপর ভরসা করছি।

আনোয়ার ইব্রাহিম পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক রক্ত বহন করছেন। তারা বাবা ছিলেন একজন এমপি। মাও সক্রিয় রাজনীতি করতেন। আনোয়ারের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যয়নকালে। তখন তরুণ ছাত্র নেতা আনোয়ার ‘মুসলিম ইউথ মুভমেন্ট অফ মালয়েশিয়া' বা আবিম গঠন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় দুই বছর জেল খাটেন তিনি। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আনোয়ার। সেসময় তিনি সুদক্ষ বাগ্মিতায় গ্রামীণ জীবনের সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন।

এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের নজরে পড়েন তিনি। এরপরই তার উত্থান ঘটে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে সামলে ১৯৯৩ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী হন তিনি। দীর্ঘ এ যাত্রাপথে তিনি তার ইসলামকেন্দ্রিক রাজনীতিকে ত্যাগ করেননি। মনে করা হচ্ছিল মাহাথিরের উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন তিনি।

১৯৯৭ সাল এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলে মাহাথিরের সঙ্গে আনোয়ারের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তিনি সরকারের অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির সমালোচনা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তাকে সরিয়ে সমকামিতার মিথ্যা অভিযোগে জেলে দেন মাহাথির।

২০১৪ সালের ভোটে যখন আনোয়ারের জয়ের সম্ভবনা উজ্জ্বল, ঠিক তখনই আবারও সমকামিতার মিথ্যা মামলায জেলে পাঠানো হয় তাকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মাহাথির ও আনোয়ারের রাজনৈতিক জোট দেশটির সাত দশকের ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করে নাটকীয় জয় পায়।

জোট গঠনের আগে মাহাথিরের সাথে আনোয়ার ইব্রাহিমের লিখিত চুক্তি হয় যে তারা জয়ী হলে পরবর্তী সরকারের দুই বছরের জন্য নেতৃত্ব দেবেন মাহাথির। এরপর আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত হয়নি।

আনোয়ারের সাথে সমঝোতা অনুসারে মাহাথিরের নেতৃত্বে সরকার চলে আসছিল। গত বছরের মে মাসে এই সরকারের দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করার কথা ছিল। ঠিক এর আগে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে জটিল এক উত্তাল অবস্থা তৈরি হয়। মাহাথির পূর্ব সমঝোতা অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন। এ সময় মাহাথিরের দলের নেতারা দাবি করতে থাকেন যে, মাহাথিরকে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে।

এ নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাসীন জোটে ভাঙন দেখা যায়। এর জেরে মাহাথির পদত্যাগ করেন। এরপর রাজা মাহাথিরের আপত্তি উপেক্ষা করেই মুহিউদ্দীন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কিনা তা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে। এ কারণে সংসদে ভোটাভুটির আয়োজন করার সাহস দেখাতে পারেননি মুহিউদ্দীন। মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যে ধারার রাজনীতি চলে আসছে তাতে ধীরে ধীরে বহু এমপিকে কিনে তারপরই হয়তো আস্থা ভোটের ব্যবস্থা করবেন মুহিউদ্দীন।

সমকামিতার মিথ্যা অভিযোগে বারবার জেল খাটা, সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েও ক্ষমতায় যেতে না পারার পরও আনোয়ার কেন রাজনীতি ছাড়ছেন না? এর জবাব তিনি নিজেই দিয়েছেন। বলেছেন, আমি লেগে আছি কারণ মালয়েশিয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। অপশাসনের কারণে আমরা সেটা হারিয়ে ফেলেছি। এটা একটা অনন্য মুসলিম প্রধান বহুজাতির দেশ। এখানে গণতন্ত্র ভঙ্গুর। কিন্তু এদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

বামপন্থী নেতা এবং ইউনিভার্সিটি অফ মালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুসিন আলি রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন ধারার হলেও আনোয়ারের গুনমুগ্ধ। তিনি বলেন, আনোয়ার দেশটির বহু জাতির বৈচিত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। আনোয়ার মনে করেন সব জাতি বর্ণের সম্মিলন ছাড়া দেশ এগুতে পারবে না।

প্রশ্ন উঠতে আনোয়ার কী তাহলে ক্ষমতার বাইরেই থেকে যাবেন? তবে রাজনীতির হিসাব নিকাশ বড়ই জটিল। রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু মিত্র বলেই কিছু নেই। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক আনোয়ারকে জেলে পুড়েছিলেন। দুর্নীতির মামলায় এখন তিনি দণ্ডিত। তবে জামিনে আছেন। তিনি এখন আনোয়ারকে সরকার গঠনে সমর্থন দিতে চান। এটা সম্ভব হলে আনোয়ারের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সমৃণ হবে।

আনোয়ার বলেছেন, নাজিব রাজাকের সমর্থন নিলেও তার দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। আনোয়ার মনে করেন , নিজ দলে নাজিবের এখনও বিশাল প্রভাব রয়েছে। আমি তার সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম, সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি, দুর্নীতি বন্ধ ইত্যাদি ইস্যুতে আগের অবস্থান পরিবর্তন করার অঙ্গীকার করেছেন। কাজেই আগের অবস্থান বদলের কারণে আমি নাজিবের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।

আনোয়ারের শিক্ষক হুসিন আলী মনে করেন , আনোয়ার একজন সহজাত নেতা। তিনি কখনোই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা ছাড়েননি। আর সম্পদ বানানোর জন্য তিনি এ পদে বসতে চান না, যেটা অন্যরা করেছেন।

এর মধ্যে একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। গত ৪ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পেরাকের মুখ্যমন্ত্রী অনাস্থা প্রস্তাবে ৪৬-১০ ভোটে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। আহমদ ফয়সাল নামের নেই মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতাসীন জোটের একজন প্রভাবশালী নেতা। ক্ষমতাসীন জোটের অনেক সাংসদও তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। আনোয়ারের দলের সঙ্গে জোট বাধেন তারা। আনোয়ার চাচ্ছেন, একই মডেল অনুসরণ করে কেন্দ্রেও ক্ষমতার পরিবর্তন করা। এভাবে নানাা নাটকীয় ঘটনার পর আনোয়ার যে কোনো মুহূর্তেই ক্ষমতায় আসতে পারেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। মাহাথিরের পর আনোয়ারই এখন দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা।

আনোয়ারের শিক্ষক হুসিন আলী অবশ্য অন্য একটি সম্ভাবনার কথাও জানাতে ভুললেন না। তিনি বলেন, আনোয়ারের মা ও তার বোনেরা সবাই ১০০ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন। কাজেই তিনি ১০০ বছরের বেশি বাঁচবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে আনোয়ার আগে হোক আর পরে হোক প্রধানমন্ত্রী হবেনই। তার এই আশাবাদ কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে।