ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ছায়াযুদ্ধ


  • মোতালেব জামালী
  • ১০ মে ২০২১, ১৭:১০

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সাথে বিশ্বশক্তির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেন। অন্যদিকে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি পুনর্বহালের চেষ্টা করছেন। বিষয়টি নিয়ে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যে আলোচনা চলছে, তা ফলপ্রসূ হতে চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু, ইসরায়েল ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। এ নিয়ে ইসরায়েল নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চলমান আলোচনা যে কোনো উপায়ে বানচালের চেষ্টা করছে ইসরায়েল। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োসি কোহেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতায়িাহুর খুবই কাছের এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত মানুষ। কোহেন সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।

এক্সোইস নামের একটি একটি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের ‘অগ্রগতি’ অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইরানের সাথে নতুন করে পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চাপ দিয়েছেন। ইসরায়েলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, বাইডেন কোহেনকে জানিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষরের ‘খুব কাছাকাছি’ এখনও পৌঁছেনি।

ইসরায়েলের ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরোধিতা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ইরান অভিযোগ করেছে যে, ইসরায়েল তাদের একজন শীর্ষস্থনীয় পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। পাশাপাশি তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা নাতাঞ্জে একাধিকবার অন্তর্ঘাতমূলক হামলা করেছে। ইসরায়েল ইরানের অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গান্টজ এর আগে বলেছেন, ইরান যদি তাদের পরমাণু কর্মসূচি জোরদার করা অব্যাহত রাখে তাহলে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালাতে দ্বিধা করবে না।

ল্যাঙ্কেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক সাইমন মাবোন মনে করেন, ইসরায়েলে সরকারে থাকা উগ্রপন্থিরা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করতে তাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখবে। তারা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন। নেতানিয়াহু মনে করেন প্রচলিত কোনো উপায়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থামানো যাবেনা। সামরিক হামলাই এটা বন্ধ করার একমাত্র পথ।

কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ইয়ানিভ ভোলার মনে করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের তৎপরতা বা ‘ছায়াযুদ্ধ’ অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে পরমাণু চুক্তি নিয়ে ভিয়েনায় বিশ্বশক্তির সাথে ইরানের আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ার পর ইসরায়েল আরও বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিশ্বশক্তির মতের বাইরে গিয়ে ইসরায়েল একতরফভাবে কিছু করার সাহস পাবেনা বলে ভোলার মনে করেন। তার মতে, পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে বৈরিতা চলছে তা বড় ধরনের কোনো সঙ্ঘাতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নেই।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, স্থানীয়ভাবে সঙ্ঘাত হতে পারে ইসরায়েল এবং এই অঞ্চলে ইরানের সমর্থক হিসেবে পরিচিত লেবাননের হিযবুল্লাহ গোষ্ঠির মধ্যে। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে ইসরায়েল ও হিযবুল্লাহর মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল সে ধরণের কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ যুদ্ধ হতে পারে। তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর ইচ্ছা সম্ভবত কোনো পক্ষেরই নেই। অনেক সময় সঙ্ঘাত নিজে নিজেই ছড়িয়ে পড়ে।

ইসরায়েলের ইতিহাস রয়েছে, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কোনো দেশের কোনো কর্মসূচিকে হুমকি মনে করলে আগাম বিমান হামলার মাধ্যমে গুড়িয়ে দেয়া। পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সাথে বিশ্বশক্তির নতুন করে কোনো চুক্তি হলে হয়তো ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনাতেও বিমান হামলা চালাতে পারে। ইসরায়েলে এ ধরনের লোকজন আছে যারা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় প্রতিরোধমূলক বিমান হামলা চালানোর পক্ষে সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের হামলার ঝুকি এবং চ্যালেঞ্জও যে আছে ত বোঝার মতো লোকজনও ইসরায়েলে আছে।

এছাড়া ইরান বিভিন্ন স্থানে পারমাণবিক স্থাপনা গড়ে তুলেছে। কোন কোনোটি পাহাড়-পর্বতের অনেক গভীরে নির্মান করা হয়েছে। ইসরায়েল কয়টি স্থানে প্রতিরোধমূলক হামলা চালাতে পারবে সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। অন্যদিকে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। কাজেই ইসরায়েলের জন্য প্রতিরোধমূলক আগাম বিমান হামলা চালানোই একমাত্র উপায় বা পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজন নাও হতে পারে।

দীর্ঘ ১২ বছর আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানী পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা জেসিপিওএ নামে এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি মনিটর ও তা সীমিত করার পদক্ষেপ গ্রহন করে। এই চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ইরানের উপর আরোপিত অবরোধ পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরমাণু অস্ত্র পরিদর্শকরা ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করবেন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন। প্রথম আলোচনার সময় তিনি মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেয়া ভাষণে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কঠোর সমালোচনাও করেন। কিন্তু কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ সমর্থন আদায় করে বারাক ওবামার করা চুক্তি বাতিল কিংবা স্থগিত করানোর লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন নেতানিয়াহু। অনেক ডেমোক্রেট নেতা ও কংগ্রেস সদস্য নেতানিয়াহুর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। ওবামার সাথেও তার সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়। ওবামা এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অবিহিত করেন। অন্যদিকে নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, এই চুক্তিতে ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

চুক্তিতে ইরানকে যে লম্বা সময় দেয়া হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির কাঠামোকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করিয়ে ফেলবে বলেও মনে করে ইসরায়েল। এমনকি ইরান পারমাণবিক অস্ত্রও তৈরি করে ফেলতে পারে বলে সন্দেহ করছে ইসরায়েল। কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ইয়ানিভ ভোলার মনে করেন, ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতাকে অনেকটাই অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মাধ্যমে ইরানের দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। ইরান পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বাড়তি কিছু করতে গেলে আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হবে। এতে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি আরো ভেঙ্গে পড়বে যা ইরান কখনোই চায় না।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর নেতানিয়াহু তার প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ইরানের জন্য লাভজনকই হয়েছিল। কেননা যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর ইরান তার পরমাণু কর্র্মসুচি আরো জোরদার করে । ইরানের পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ার জন্য যে সময় দরকার ছিল ইরানের তা আরো কমিয়ে আনে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেন বিজয়ী হওয়ার পর ইরানের পরমাণু চুক্তি আবারো আলোচনার টেবিলে এসেছে।

বিশ্লেষক ইয়ানিভ ভোলার মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রও সময় নিতে চাইছে। বাইডেন প্রশাসন আশা করছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের আগেই দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে। ওয়াশিংটনের বেশির ভাগ লোকই চায়না ইরান পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হোক। কেননা এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চাইছে নতুন চুক্তিতে যাতে ইসরায়েলকে সন্তুষ্ট করা যায়। ইসরায়েল এবং কিছু উপসাগরীয় দেশও মনে করে যে, ২০১৫ সালে করা চুক্তিতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। এই চুক্তি ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা আটকাতে পারবে না।

তবে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ইরানের পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের অব্যাহত বিরোধিতা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহর একটি রাজনৈতিক ষ্ট্যান্টবাজিও হতে পারে। এই চুক্তি আসলেই ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিনা তা একটি প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। কেননা ইসরায়েলের বেশ কিছু উচ্চ পদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলছেন যে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির হুমকি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যে সব কথাবার্তা বলছেন তা অনকটাই বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। ইরানের হুমকিকে বাস্তবতার চেয়ে অনেক বড় করে দেখানো হচ্ছে। ইরান ইস্যু নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের একটি হাতিয়ার।