লাশের মিছিলে মোদির জনপ্রিয়তা কি বাড়বে?


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৩ মে ২০২১, ০৯:০৬

গত কয়েক বছরে ভারতের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যও হতে চেয়েছিল ভারত। সেই স্বপ্ন কার্যত ভেস্তে যেতে বসেছে করোনার থাবায়। এ মহামারিতে ভারত এখন লণ্ডভণ্ড। ভারতের হাসপাতালগুলোতে নজিরবিহীন অক্সিজেন সংকট আর শ্মশানে লাশের স্তূপ দেখে বিশ্ববাসী বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা সংকটে ভারত ২০ বছর পিছিয়ে যেতে পারে।

করোনা সংক্রমণে ভারতের হাসপাতালগুলোতে রোগী রাখার জায়গা নেই। এক বেডে দুই-তিনজন রোগীও আছেন। অক্সিজেন, ওষুধ ও করোনাভাইরাসের টিকার সংকটও তীব্র। বিশেষ করে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার চলছে। একে করোনা সুনামি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেখানে দৈনিক মৃত্যু প্রায় তিন হাজার। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যাও বিশ্বে সর্বোচ্চ। এখন প্রতিদিনই প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছে ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে দৈনিক মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সরকার ঘোষিত সংখ্যার কয়েকগুণ পর্যন্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতের দৈনিক মৃত্যু পাঁচ হাজারে পৌছতে পারে। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা পৌছতে পারে ৫ লাখে। ধর্মীয় সমাবেশের অনুমতি, জনসমাগমস্থল খুলে দেওয়া ও জনাকীর্ণ নির্বাচনী সমাবেশ আয়োজন ভারতের দ্বিতীয় দফায় এই উল্মম্ফনের জন্য অনেকটাই দায়ী বলে জানান দেশটির বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের বিভিন্ন শহরে হাসপাতালে শয্যার নিদারুন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর প্রমাণ মিলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাহায্যের জন্য মরিয়া আকুতির বার্তায়। যথাসময়ে চিকিৎসা না মেলায় অনেকেই মারা যাচ্ছেন, এ ধরনের মর্মান্তিক তথ্য উঠে আসছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। দিল্লি, মুম্বাই ও আহমেদাবাদের মতো শহরগুলোতে হাসপাতালে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই।

এ পরিস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্যগুলোতে লকডাউন জারি করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শেষ অবলম্বন হিসেবেই শুধু লকডাউনের আশ্রয় নিতে বলেছেন।

অনেকে বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারতে এই মুহূর্তে জরুরি ছিল একটা স্বলমেয়াদী কঠোর লকডাউনের। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত দেশটিতে আরেকটি লকডাউনে দিলে বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই মোদি সেদিকে যাননি। অথচ গত বছর মোদির কঠোর লকডাউন ছিল অবিমৃশ্যকারী। ভারতের মত বিশাল দরিদ্রের দেশটিতে এতো দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন বাস্তবসম্মত নয়।

পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে বিভিন্ন রাজ্যে ইতিমধ্যেই লকডাউন বা কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে।
হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট ও চিকিৎসার জন্য হাহাকারের চিত্র দিল্লি, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে একই রকম। দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে প্রতিদিন বহু রোগী মারা যাচ্ছে। করোনা মহামারিতে এমন মানবিক বিপর্যয় আর কোনো দেশে দেখা যায়নি।

অক্সিজেনের সংকটে এক নারীকে দেখা গেছে, নিজে মুখ দিয়ে শ্বাস দিয়ে করোনায় আক্রান্ত স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তার স্বামীর অক্সিজেন সাপোর্ট জরুরি ছিল। হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অনেকে বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাতে বাসায় বসেই অনেকের প্রাণ যাচ্ছে। সেই মৃত্যুগুলো সরকারি পরিসংখ্যানে আসছে না।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ভারতীয় গণমাধ্যমে এই সংকটকে খাটো করে দেখানো হচ্ছে। কারণ ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, ভারতের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারকের নীতি মেনে চলার চেষ্টা করছে। তবে বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরার মত আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমগুলো ভারতের এই ভয়াবহ সংকটের বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে দৈনিক করোনায় আক্রান্তের প্রায় অর্ধেকই এখন এককভাবে ভারতের মানুষ। নিউইয়র্ক টাইমস ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শ্মশানে কর্মরত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এসব শ্মশানে চিতার আগুন নিভছেই না। করোনায় মরদেহ দাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে শ্মশান কর্তৃপক্ষ। করোনায় মারা যাওয়া যত মরদেহ শ্মশানে দাহ করা হচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায়, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।

বিশ্নেষকরা বলছেন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজনীতিকরা ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মৃতের বিশাল সংখ্যা লুকিয়ে অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনও দেখা যাচ্ছে, শোকাহত অনেক পরিবার করোনা সংক্রমণের তথ্য লুকাচ্ছে করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতির কারণে।

ভারতের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখা ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের মহামারি বিশেষজ্ঞ ভ্রমর মুখার্জি বলেছেন, একে তথ্য-উপাত্তের ধ্বংসযজ্ঞই বলা যায়। আমরা যেসব মডেল নিয়ে কাজ করছি, তাতে এটি পরিস্কার- যে সংখ্যা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে তিন থেকে পাঁচ গুণ।

গুজরাটের আহমেদাবাদে একটি বিশাল শ্মশান প্রাঙ্গণের চিত্র তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস। বলা হচ্ছে, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেখানে সারি সারি চিতা জ্বলছে। উজ্জ্বল কমলা আগুনে আলোকিত হচ্ছে রাতের আকাশ। মনে হচ্ছে, শিল্প-কারখানার মতো বিরতিহীন জ্বলেই চলেছে।

সুরেশ ভাই নামে সেখানকার এক কর্মী জানান, মরদেহের নিরবচ্ছিন্ন এই দীর্ঘ লাইন তিনি আর কখনও দেখেননি। তবে তার হাতে থাকা পাতলা কাগজে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি করোনা সংক্রমণের কথা লিখছেন না। যদিও এই কাগজই তিনি শোকাহত পরিবারকে দিচ্ছেন। তাহলে কাগজে মৃত্যুর কী কারণ লিখছেন তিনি। সুরেশ ভাই বলেছেন, 'সিকনেস, সিকনেস, সিকনেস। এটিই লিখে দিচ্ছি আমরা। কেন এমনটি লিখছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এটি লিখতে বলেছেন।

নয়াদিল্লি ও আরেক বড় শহর ভোপালের চিত্র খুবই নাজুক। ভোপালের সব শ্মশান রাতদিন ব্যস্ত। ১৯৮০-এর দশকে সেখানে গ্যাস বিস্ফোরণে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান। বাসিন্দারা বলছেন, ওই বিপর্যয়ের পর এই প্রথম শ্মশানগুলো এত বেশি ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। মধ্য এপ্রিলের ১৩ দিন ভোপালের কর্মকর্তারা ৪১ জনকে করোনায় মৃত দেখিয়েছেন। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভোপালের প্রধান শ্মশানে দাহ করা মরদেহের সংখ্যা কমপক্ষে এক হাজার। ভোপালের কার্ডিওলজিস্ট জি.সি. গৌতম বলেছেন, অনেক মৃত্যুর রেকর্ড রাখা হচ্ছে না এবং দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে।

লাশের এ মিছিল সামলাতে পারছে না দিল্লির শ্মশানগুলো। স্বজনের মৃতদেহ সৎকারের জন্য আসা পরিবারগুলোকে তারা অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানাচ্ছেন।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কাতেই দেশের অর্থনীতি প্রবল সংকটের মুখে পড়তে চলেছে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব আশঙ্কার থেকেও খারাপ হতে চলেছে।

ভারতের সংবাদ প্রতিদিনের খবরে বলা হয়, করোনা মহামারির প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারতের দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর এক রিপোর্ট থেকে তেমনটাই জানা যায়। তার সঙ্গে মুখথুবড়ে পড়েছিল জিডিপি। লকডাউনের অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য মোকাবিলায় ভারত অনেকটাই সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় রাতারাতি সেই সাফল্য ম্লান হয়ে যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতে যেভাবে সংক্রমণের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তাতে ছোটখাটো ব্যবসা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশব্যাপী লকডাউন না হলেও, যেভাবে বহু রাজ্য লকডাউনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে, তার ফল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ভারত অর্থনৈতিকভাবে ২০ বছর পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।

এ অবস্থায় ভারতীয়দের একাংশ সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, জনস্বাস্থ্য খাতকে এভাবে নাজুক রেখে এই ভারতই কোন বিবেচনায় লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ করে রাফালের মত জঙ্গিবিমান কিনছে? তবে মোদি সরকার মূল ধারার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের পাশাপাশি টুইটারের মত জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াকে বাধ্য করছে সরকারবিরোধী টুইট মুছে দিতে।

করোনা সংকট ভয়াবহ হওয়ার আগেই ভারত সরকার টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। অথচ ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের কোভিড টিকার ওপর বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো নির্ভরশীল। টিকা রফতানি বন্ধ হওয়ায় তাদের জরুরি টিকাদান কর্মসূচি ভেস্তে যেতে চলেছে। কেনা টিকাও তারা যথাসময়ে পাচ্ছেন না। এতে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেকে দেশে ভারত বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, করোনা সংকটে ভারত লণ্ডভণ্ড হলেও মোদির গদিতে আঁচড় পড়বে না। প্রথম ঢেউ সামলাতে মোদি ব্যর্থ হলেও তার জনসমর্থন তখন প্রায় ৮০ ভাগে ঠেকেছিল। যেটা গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বিরল। ভারতের অনেকে বলছেন, করোনা সংকটের চেয়ে মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিই তাদের কাছে অনেক বড়। ফলে এবারের সংকটের পর মোদি জনসমর্থন আরও বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।