আর্মেনিয়ার পাশে বাইডেন, এরদোয়ান কী করবেন?


  • মোতালেব জামালী
  • ২৯ এপ্রিল ২০২১, ১০:১৩

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ২৩ এপ্রিল প্রথমবারের মতো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন। এ সময় এরদোয়ানকে তিনি জানান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উসমানিয়া সাম্রাজ্যে আর্মেনিয়ানদের হত্যার ঘটনাকে তিনি ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। এর পরদিন বাইডেন আর্মেনিয়ানদের হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি ওই ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে সর্ম্পকের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে।

বাইডেনের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আর্মেনিয়ায় কথিত গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল, তার অবসান ঘটল। তার এ ঘোষণায় আর্মেনিয়া ও সারা বিশে^ বসবাসরত আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠি খুশি হয়েছে। আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাইডেনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে, এ স্বীকৃতির ফলে নানা বিষয়ে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পকের্র যে টানাপড়েন চলছিল, তার আরও অবনতি ঘটল। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে বাইডেন সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিতর্ক থেকে কেউ লাভবান হবে না।

১৯১৫ সালে প্রথম বিশ^যুদ্ধ শুরুর পর ওসমানীয় বাহিনী ককেশাস অঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু করে। সেখানে ১৯১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ওসমানীয় বাহিনীর সাথে রুশ বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যা সারিকামিসের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ওসমানীয় বাহিনী পরাজিত হয়। ওসমানীয়রা জার্মানি ও নেপোলিয়নের যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেছিল। অর্থাৎ দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সেনা দলকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো। কিন্তু প্রচণ্ড শীতের কারণে ককেশাস অভিযানে সেই কৌশল ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ শুরুর আগেই আল্লাহ আকবার পর্বতের তুষারাচ্ছাদিত অঞ্চলে আটকা পড়ে অন্তত ২৫ হাজার ওসমানীয় সৈন্য মারা যায়। ওসমানীয়রা মনে করে আর্মেনিয়ানদের ষড়যন্ত্র ও বিশ^াসঘাতকতার জন্যই তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে।

আর্মেনিয়ানদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তৎকালীন আনাতোলিয়া থেকে আর্মেনিয়ানদের বিতাড়িত করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীতেও আর্মেনীয় সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হয়। অভিযোগ করা হয় এ সময় ১৫ লাখ আর্মেনীয় মারা যায়। তুরস্ক ওসমানিয়া সাম্রাজ্যে আর্মেনিয়ানদের মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করে। তবে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়নি বলে দাবি করে থাকে। সেখানে লোক সংখ্যা ৮ লাখের বেশি ছিলো না বলে তুরস্কের বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন।

তুরস্ক বাইডেনের ঘোষণার নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিবৃতিকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছি। রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা হচ্ছে শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতি সবচেয়ে বড় বিশ^াসঘাতকতা। পরে আঙ্কারায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড স্যাটারফিল্ডকে তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তুরস্কের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাদাত ওনাল বলেছেন, বাইডেনের এই পদক্ষেপে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাইডেনের বক্তব্যের কোনো পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও আইনগত ভিত্তি নেই। এটি কোনো তথ্য- প্রমাণ দ্বারাও সমর্থিত নয়। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টিও বাইডেনের বক্তব্যের কড়া সমলোচনা করে বলেছে, এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো।

তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে সিরিয়ায় তুরস্কের ভাষায় সন্ত্রাসী কুর্দি গ্রুপকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেয়া। রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্কের এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা। ইরানের তেল ও গ্যাস রপ্তানীর উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপকে তুরস্কের সমর্থন না করার মতো বিষয়। এর সাথে আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়ার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে বিরোধে নতুন মাত্রা যুক্ত করলো।

বলা হয়ে থাকে যে, ওসমানীয় খেলাফতের শাসকরা আর্মেনীয়দের মোটই বিশ^াস করতেন না। আর্মেনীয়রা গোপানে ওসমানীয় সাম্রাজ্যর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সম্প্রতি তুরস্ক স্বীকার করেছে যে, ওই সময় এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা কোনোভাবেই গণহত্যার পর্যায়ে পৌছেনি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান সম্প্রতি আঙ্কারায় আর্মেনীয় প্রধান ধর্মযাজকের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেছেন, ‘আমি ওসমানীয় খেলাফতের আর্মেনিয়ানদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি যারা প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময়ের কঠিন পরিস্থিতিতে মারা গেছেন। আমি তাদের নাতি-নাতনীদের কাছে আমার সমবেদনা জানাচ্ছি।’

তুরস্কের দৃষ্টিতে সেই ‘কঠিন পরিস্থিতি’ কোনো ভাবেই গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেনি। কিন্তু বর্তমান আর্মেনিয়া ও বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আর্মেনিয়ানরা তুরস্কের বক্তব্যকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে রাজি নয়। ফলে তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে না। বরং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গণহত্যার স্বীকৃতি তুরস্কের বিরুদ্ধে আর্মেনিয়ার দাবিকে জোরালো করেছে। বাইডেনের এই ঘোষণার পর আর্মেনীয়রা উল্লাস প্রকাশ করেছে। দল বেধে সে সময় নিহতদের স্মরনে সমাধিতে ফুল দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েই তুরস্ক বসে থাকবে নাকি পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেবে সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নানা কারনে তুরস্ককে এখন দরকার। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেখানের সব পক্ষকে নিয়ে আঙ্কারায় একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে তুরস্ককে অনুরোধ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক সে উদ্যোগও নিয়েছে। এরমধ্যে তালেবানরা এই সম্মেলনে যোগ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে এই সম্মেলন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এখন তুরস্কও এই সম্মেলন বাতিল করে দিতে পারে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিয়েছে তা কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৈন্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের একটি বৃহৎ সামরিক ঘাটি ব্যবহার করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্ক এই ঘাটি ব্যবহার করতে দেবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুন্থানের পর এই ঘাটি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছিলো।

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ইনসারলিকে অবস্থিত এই সামরিক ঘাটিকে ন্যাটো তার বিমান ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করছে। এখান থেকে মার্কিন যুদ্ধ বিমানগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তুরস্ক যদি এই ঘাটি ব্যবহর বন্ধ করে দেয় তাহলে সিরিয়া ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে তুরস্ক উত্তর সিরিয়ায় কোনো অভিযান চালায়নি। এখন তা আবার শুরু করতে পারে। এমনকি সিরিয়ার মতো উত্তর ইরাকেও অভিযান চালাতে পারে তুরস্ক।

দুই দেশ সংঘাতের পথে যাবে কিনা তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায়না। কারণ, বাইডেনের বিবৃতিতে কিছু ফাক-ফোকর রয়েছে। তিনি অটোমান বা উসমানীয় খেলাফতের শাসনামলের কিছু নিষ্টুরতার কথা বলেছেন। বর্তমান তুরস্ক নিয়ে কিছু বলেননি। এমনকি তিনি তার বিবৃতিতে ইস্তাম্বুলের পুরনো নাম কন্সটানটিনোপলের কথা বলেছেন। এভাবেই বাইডেন তুরস্ককে কিছুটা সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন। এমনকি তিনি বিবৃতি দেয়ার আগের দিন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে টেলিফোন করে জানিয়েছেন যে, তিনি আর্মেনীয়দের হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এরদোয়ানকে আগে ফোন করে বাইডেন এটা বুঝাতে চেয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। গত জানুয়ারিতে বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম তিনি এরদোয়নের সাথে কথা বলেন। এ ছাড়া গত সপ্তাহে এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তণ বিষয়ক আর্থ সামিটেও অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এরপরও তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পকের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

গত বছর আজারবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার যুদ্ধে তুরস্ক পুরোপুরিভাবে আজারবাইজানকে সমর্থন দিয়েছে। অপরদিকে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আর্মেনিয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই যুদ্ধে আজারবাইজান নাগারনো কারবাখের নিয়ন্ত্রন গ্রহ করে। এর মধ্য দিয়ে ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বেড়েছে। মধ্য এশিয়ার সাথে তুরস্কের যোগাযোগ করিডোর স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া অনেকটা নীরব ভুমিকা পালন করে।

যুক্তরাষ্ট্রে আর্মেনিয়ানদের শক্তিশালী লবিস্ট রয়েছে । যারা দীর্ঘদিন থেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে। এদেরকে জোরালো সমর্থন দিচ্ছে ফ্রান্স। যার মুল লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কের কাছ থেকে কথিত গণহত্যার ক্ষতিপুরন আদায় করা। কূটনৈতিকভাবে তুরস্ককে কোণঠাসা করা। নাগারনো কারাবাখের নিয়ন্ত্রন হারানোর পর আর্মেনিয়রা যে পরাজয়ের বেদনার মধ্যে আছে তাতে বাইডেনের ঘোষণা কিছুটা হলেও উপশম হবে।

অপরদিকে কৌশলগত কারনে তুরস্কের সাথে আরো সর্ম্পকের অবনতি হোক তা চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। আর্মেনিয়ার হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলার সময় যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ‘এটি আমাদের অবস্থান। তুরস্ক আমাদের সাথে একমত নাও হতে পারে।’

নির্বাচনী প্রচারণার সময় বাইডেন আর্মেনিয়ান মার্কিনী ভোটারদের কাছে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি নির্বাচিত হলে আর্মেনিয়ানদের হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। তার সেই কথ তিনি রাখলেন। অন্যদিকে তুর্কি বংশোদ্ভূত মাকিন ভোটারদের কে বাইডেন ক্ষুব্ধ করলেন। সেটিও তার জন্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে ডেমোক্রেটদে জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাড়াতে পারে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তুরস্ক এখন রাশিয়ার সাথে সর্ম্পক ও লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকের ব্যাপারে আগ্রাসী অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর্মেনিয়ার কথিত গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুরস্ক স্বাভাবিক ভাবে নেবে না। পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করবে।