পাকিস্তানকে কেন দরকার সৌদির?


  • ফারজানা তানিয়া
  • ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:২২

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মৈত্রিতে স্থবিরতার পর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সৌদি আরব এবং পাকিস্তান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।

মার্চের শেষের দিকে, দুই মাসের মধ্যে তাদের প্রথম টেলিফোন আলাপের সময়, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সৌদি সফরের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তানি নেতা সাদরে এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।

এদিকে, পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ শাহ কুরেশি বাণিজ্য সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা এবং বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে আলোচনা করতে এ বছরের গোড়ার দিকে মিসর সফর করেন। কায়রোকে যেহেতু সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখনই ধারণা করা হয়েছিল, রিয়াদ এবং ইসলামাবাদ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রিয়াদ পাকিস্তানকে দেওয়া ঋণের ৩ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় কিস্তি পরিশোধের চাপ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গত বছর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরপরই সৌদি আরব সংক্ষিপ্ত নোটিসে ইসলামাবাদকে ৬ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক বেইলআউট প্যাকেজের অংশ হিসেবে দেওয়া এ অর্থ দ্রুত পরিশোধ করতে বলেছিল।

দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয় ২০১৯ সালের আগস্টে, যখন ভারত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। এ নিয়ে রিয়াদ-নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হয় পাকিস্তান। এর প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান এবং কাতারকে নিয়ে একটি নতুন মুসলিম ব্লক গঠন করে দেশটি।

রিয়াদের চাপের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নতুন ফোরামের প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে পারেননি। ছয় মাস পর, পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, কাশ্মির নিয়ে আলোচনা করতে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠক ডাকা হোক; তা না হলে ইসলামাবাদকে সমর্থনের জন্য আরব দেশটির বাইরে নজর দিতে হবে। এর পরই রিয়াদ তার ঋণের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য বলে। এখন, সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে রিয়াদের পরিবর্তনশীল সম্পর্কও এর পেছনে কাজ করছে।

বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রিয়াদ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে চাপের মধ্যে ছিল। এরপর, সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স জড়িত ছিলেন।

এ সংবেদনশীল সময়ে, সৌদি নেতৃত্বের পক্ষে ইসলামাবাদের পূর্ণ সমর্থন দেখেছে রিয়াদ। এ নিয়ে সৌদি অবস্থানের প্রতি সংহতি জানিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রিয়াদকে সমর্থন যুগিয়েছে। পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘সৌদি সরকার দায়ী ব্যক্তিদের নিয়ে যথাযথ তদন্ত করা, দোষী সাব্যস্ত করা, দণ্ড দেওয়াসহ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করেছে।’

সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পেছনে আরেকট ফ্যাক্টর হলো ইরান। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় তেহরানের সঙ্গে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ২৫ বছরের কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি চূড়ান্ত করেছেন। তাছাড়া, ওয়াশিংটন তেহরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসা নিয়ে কাছাকাছি অবস্থানে উপনীত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি যদি হয়ে যায়, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র- দুই দেশ থেকেই সুবিধা পাবে ইরান। পাশাপাশি, ইরানের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জটিলতাও খুলে যাবে।

ওয়ারশ’-এর ওয়ার স্টাডিজ একাডেমির এশিয়া রিসার্চ সেন্টারের পশ্চিম এশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষক লুকাজ প্রজিবিজেস্কি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের শাসনামলে ইরান এবং চীনের মিত্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভুরাজনৈতিকভাবে সৌদি আরবের আরও ভালো অবস্থান প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা সৌদি আরবকে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এখন তারা ইরান-পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত করতে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

রিয়াদ এখন ইসলামাবাদের সঙ্গে নতুন উদ্যমে সম্পর্ক স্থাপনে উঠেপড়ে লেগেছে। বেলুচিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে গোয়াদারের ৮৮ হাজার একর জায়গাজুড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের আরামকো শোধনাগার এবং পেট্রোকেমিক্যাল স্থাপনা তৈরির আগ্রহ দেখিয়েছে রিয়াদ। এ স্থাপনাকে বলা হচ্ছে ‘অয়েল সিটি’। তেহরানের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক যেহেতু বৈরী, ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে শিয়া জনগোষ্ঠির কাছাকাছি যাওয়ার পথও রচিত হবে এর মাধ্যমে। পাকিস্তানে প্রায় ৭ কোটি শিয়ার বাস।

এদিকে, বেইজিংয়ের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে রিয়াদ। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্চে সৌদি সফর করেছেন। সেখানে চীন-সৌদি ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুই পক্ষ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বাড়তে সম্মত হয়েছে।

বেইজিংয়ের সঙ্গে ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ফ্ল্যাগশিপ করিডোরটি পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে গেছে। সৌদি আরব যেহেতু এ ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ দেশ, চীন সহজেই রিয়াদ এবং ইসলামাবাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে মধ্যস্থতা করতে পারে।

উল্লেখ করা দরকার, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক ঊর্ধ্বমুখী সূচক ধরে চলছিল, এর মধ্যে একটি সমস্যা রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জ্বালানির বাজার হয়ে থাকবে ভারত। তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থা এবং ওপেক-বহিভূত বড় তেল উৎপাদনকারীরা যখন উৎপাদন কমানো অব্যাহত রাখতে চাচ্ছে, তখন নিজস্ব বাজারকে কাজে লাগিয়ে নয়াদিল্লি মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই মে মাসে সৌদি আরব থেকে তেল রফতানি এক চতুর্থাংশ কমাচ্ছে ভারত। আগে যেখানে সৌদি থেকে মাসে গড়ে ১৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করত ভারত, সেখানে এখন আমদানি করবে ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল। সম্প্রতি সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান স্বীকার করেছেন, এ উৎপাদন হ্রাসের কারণে আরামকো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক অংশীদারদের নিয়ে কিছু অসুবিধার মধ্যে পড়েছে।

এ বিষয়গুলো সৌদি আরবের মতো বড় তেল উৎপাদনকারীর প্রভাব কমাতে পারে। এ কারণে হয়তো রিয়াদ ভারত এবং পাকিস্তান- দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়ার মতে, গ্রিন পলিসি বাস্তবায়নের কারণে উন্নত দেশগুলোতে তেলের চাহিদা এরইমধ্যে কমেছে। বৈশি^ক পরিবেশে মার্কেট শেয়ার হারাচ্ছে সৌদি আরব। এ অবস্থায় ভারতে যদি সৌদি আরবের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, চাপে পড়বে দেশটি। এ কারণে ইসলামাবাদকে কাছে টেনেছে রিয়াদ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিরক্ষা। মার্কিন-সৌদি সম্পর্কের পুনরুদ্ধারকাজ চললেও সম্প্রতি ওয়াশিংটন তিনটি প্যাট্রিয়ট মিসাইল ব্যাটারি সৌদি আরবের বাইরে নিয়ে গেছে। রিয়াদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ পদক্ষেপে উপকৃত হয়েছে ইরান।

দৃশ্যত, বাইডেন প্রশাসন এ অঞ্চলে বিমানবাহী ক্যারিয়ারের স্থায়ী স্থাপনার সমাপ্তি ঘটাতে পারে। রিয়াদ কীভাবে এই নিরাপত্তা ইস্যুটি সমাধানের পরিকল্পনা নিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে এ ক্ষেত্রে নৈতিক সমর্থনের জন্য ইসলামাবাদকে রিয়াদের বড় বেশি প্রয়োজন।

বিশ্লেষক লুকাজ প্রজিবিজেস্কি আরব নিউজকে বলেন, আপাতত এ ইস্যুগুলোই সৌদি এবং পাকিস্তানের সম্পর্কের ভিত রচনা করেছে। ভবিষ্যতের হিসাব-নিকাশে এটিই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে।

তিনি বলেন, ‘ ইসলামাবাদকে সমর্থন করার পেছনে ইরান, আফগানিস্তান এবং সৌদি আরবের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার বাইরে অন্য কোনো ইস্যু আছে বলে মনে হয় না।’

তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অন্য পর্যায় অবলম্বন করার মতো বড় কোনো ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা নেই সৌদি আরবের। পাকিস্তান থেকে তাদের সামরিক সহযোগিতারও প্রয়োজন নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিপরীতে তারা বেইজিংকে মূল কৌশলগত অংশীদার করতে যাচ্ছে।

সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সাল একবার পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে কোনো সরকারি চুক্তি ছাড়াই যে কোনো দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ-রকম দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন আর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখন সৌদি-পাকিস্তানের মধ্যে যে সম্পর্কটা হবে, তা বিকশিত হচ্ছে মূলত এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভিত্তিতে।

লুকাজ প্রজিবিজেস্কি বলেন, বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক গত বছর সংকটের মধ্যে ছিল না, নিবিড় পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে চলছিল। কৌশলগত দিক থেকে প্রায় এক দশক বিচ্ছিন্ন থাকার পর ২০২০ সাল হলো একটি মাইলফলক। এ বছর ইসলামাবাদ বিদেশিদের সঙ্গে নতুন করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পেরেছে অনেক দূর। নতুন সম্পর্ক হয়েছে সৌদি আরবেরও। এখন সৌদি ও পাকিস্তান মৌলিক সম্পর্কটা সুদৃঢ় রেখে নিজস্ব কক্ষপথ ধরে এগোতে থাকবে।