জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিল: শরণার্থীদের জন্য অনন্য উদ্যোগ

-

  • মোতালেব জামালী
  • ২৩ এপ্রিল ২০২১, ০৯:০৫

জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন বা ইউএনএইচসিআর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, সঙ্ঘাত ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শরণার্থী হওয়া এবং আশ্রয়হীন মানুষের সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠন করেছে। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিল’। এটি বিশ্বব্যাপী আশ্রয়হীন ও শরণার্থী লোকদের কল্যাণে ইসলামি অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের এ উদ্যোগ মুসলমানদের মানবিক ও দাতব্য কার্যক্রমকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ তহবিল সম্পূর্ণ ইসলামি শরিয়াহ ও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের ফতোয়া অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে।

ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে জাকাত। কোন মুসলমানের তার নিজ সম্পদ থেকে সারা বছরের প্রয়োজন মিটিয়ে যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে তার শতকরা ২দশমিক ৫ শতাংশ জাকাত প্রদান করতে হয়। স্বচ্ছল মুসলমানদেরকে তাদের নিজ উদ্যোগেই বা স্বেচ্ছায় ইসলামের এই বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়।

অনুমান করা হয় যে, সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রতি বছর জাকাত হিসেবে ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে থাকে। যদি প্রত্যেক স্বচ্ছল মুসলমান সঠিকভাবে তার জাকাত আদায় করেন তাহলে এই অর্থের পরিমান ৩৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌছতে পারে বলে ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ইউএনএইচসিআর বর্তমানে ১লাখ ৫৪ হাজার ৭৪০টি শরণার্থী পরিবারকে সহায়তা করার জন্য ২০৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছেন।

জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিলের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে জাকাত হিসেবে ৪ কোটি ৩১ লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার পেয়েছে। এই অর্থ দিয়ে ইয়েমেন, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, মালয়েশিয়া, মিসর, মৌরিতানিয়া ও বাংলাদেশে মোট ১ লাখ ৯১ হাজার ৪৯৭ টি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীন ভাবে বাস্তচ্যুত হওয়া পরিবারকে সহায়তা দিতে সক্ষম হয়েছে।

সংস্থাটি জানিয়েছে, সারা বিশ্বের উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ওআইসি ভূক্ত দেশগুলোতে। সব মিলে বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৮০ মিলিয়নেরও বেশি। করোনা মহামারীর সময়ে তাদেরকে আরো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যাকাত তহবিলে অনুদান বেড়ে যাওয়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, মহামারীর আর্থ-সামাজিক প্রভাবের কারণে মানুষের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। এই সময়ে আমাদের যাকাত তহবিলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদারতাও ছিল অবিশ্বাস্য।

জাতিসঙ্ঘের জাকাত তহবিল থেকে সাহায্য পেয়েছে এমন পরিবারের মোট লোকসংখ্যা ১০ লাখ ২৫ হাজার ১৪ জন। এতে আরো বলা হয়েছে, এ বছর সংগৃহীত জাকাতের বড় অংশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল থেকে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১৯ সালে জাকাতের মোট প্রাপ্ত অর্থের ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাটি কিভাবে এই অর্থ কাজে লাগাচ্ছে আসুন জেনে নেই এ সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২০ সালে তারা ২১ লাখ শরণার্থীকে জাকাত তহবিলের মাধ্যমে সহায়তা করেছে। ইউএনএইচসিআর এ কাজের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামি দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জাকাত ও সদকা হিসেবে ৬১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। এই অর্থ ২০১৯ সালের চেয়ে ১২দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। সংস্থার সর্বশেষ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জন্য তাদের বাজেট ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এর এক তৃতীয়াংশই ব্যয় করা হবে যেসব দেশে জাকাতের অর্থ বিতরণ করা হয় সেখানে।

জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাটির যাকাত তহবিলের অর্থ ব্যয় করা হয় প্রধানত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ও সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের মাঝে। এছাড়া ইয়েমেন ও ইরাক যুদ্ধের উদ্বাস্তুদেরও সহযোগিতা করা হয় এই অর্থ দিয়ে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বড় অংশই আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের কক্সবজারে।

এছাড়া ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশেও রয়েছে রোহিঙ্গারা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে উদ্বাস্ত হওয়া প্রায় ৪০ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে। ইয়েমেন আর ইরাকেও লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা প্রতিবছর জাকাতের যে অর্থ অনুদান হিসেবে পেয়ে থাকে তা থেকে শরণার্থী ও প্রাথমিকভাবে বাস্তুচ্যুত লোকজনকে নগদ অর্থ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক পন্য সামগ্রী দেয়ার ব্যবস্থা করে।

এছাড়াও গত এক বছর ধরে করোনা মহামারিতে কর্মহীন ও আর্থিক সংকটে পড়া ব্যক্তি ও পরিবারগুলোকেও এই তহবিল থেকে সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। জাকাত ফান্ডে প্রদত্ত অর্থের পরিমান দিন দিন বাড়লেও ইউএনএইচসিআর সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, চলমান করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপি শরণার্থীদের আর্থিক চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে অনেক সময়ই অর্থের টান পড়ে যাচ্ছে।

পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। এই মাসে মুসলিম শরণার্থীরা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রোজা রাখতে বাধ্য হবেন। জাতিসঙ্ঘের সংস্থাটি চলমান করোনা মহামারির কারণে সব দেশ ও দাতারা যেন নিজেদের অভ্যন্তরীন বিষয়ের দিকেই শুধু দৃষ্টি নিবদ্ধ না রাখেন সেই আহবানও জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার নির্বিশেষে সব দাতার প্রতিই আমরা আহবান জানাচ্ছি বর্তমান সংকটের সময়ে তারা যেন শরণার্থীদের দুরবস্থার প্রতি আরো বেশি সহানুভূতিশীল হন।

বিশ্বে ইসলামি অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন ও ইসলামি দাতব্য কার্যক্রমের প্রসার ঘটার ফলে জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিলে জাকাত প্রদানের হারও দিন দিন বাড়ছে। জাকাত দাতা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের জাকাতের একটি অংশ জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিলে প্রদানের মাধ্যমে শরণার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিলে প্রতি বছর জাকাতের যে অর্থ আসে তার ৬০ শতাংশই আসে অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক কোঅপারেশন বা ওআইসিভূক্ত দেশ গুলো থেকে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এসব দেশ থেকে ইউএনএইচসিআর পেয়েছে ১৪দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ জর্ডান ও লেবাননে আশ্রয় নেয়া ৬ হাজার ৮শ ৮৮ টি শরণার্থী পরিবারকে দেয়া হয়েছে।

এরপরই সংস্থাটি ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দুবাইতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিল’ গঠনের ঘোষণা প্রদান করে। জাকাতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শরণার্থী ও প্রাথমিক ভাবে আশ্রয়হীন হয়ে পড়া পরিবারগুলোকে ভালোভাবেই সহায়তা করে আসছে জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিল। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে এই তহবিল পরিচালনা করা হচ্ছে।

ইউএনএইচসিআর তাদের যাকাত তহবিলের জন্য বিশেষ সফটওয়ার ব্যবহার করেএবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইন্টানেটে এর প্রচারণা চালায়। ২০২০ সালের রমজানে তাদের ‘এভরি গিফট কাউন্টস’ নামের একটি উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলে। ৪১ হাজারের বেশি মানুষ উদ্যোগটিতে সাড়া দেয়।

‘গিভজাকাত’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপ রয়েছে তাদের। যার মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অল্প সময়ে নিজেরাই যাকাতের পরিমাণ হিসাব করতে পাবে। সংস্থাটির রিপোর্টে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, দাতারা এই অ্যাপের মাধ্যমে যাকাত প্রদান করে সেটি কোথায় কিভাবে ব্যয় হয় তাও জানতে পারবেন। এছাড়া এককালীন অনুদান ও মাসিক সদকাও প্রদান করা যায় এই অ্যাপের মাধ্যমে। পাশাপাশি সংস্থাটির যাকাত তহবিল সংক্রান্ত বিভিন্ন ফতোয়াও যাচাই করা যাবে।

জাকাতের অর্থ সংগ্রহ ও বিতরন করার ক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর বেশকিছু মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে আছে শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আর্থিক সহায়তা প্রদানের মতো বিষয়। এর প্রতিটি পদক্ষেপেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ও পাওয়ার যোগ্য পরিবার গুলোকেই বাছাই করা হয়। এদের মধ্যে আবার নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ইউএনএইচসিআর এর প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশীপ কর্মসূচির প্রধান হোসাম চাহিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই জাকাতের অর্থের সঠিক ও কার্যকর ব্যবহারের জন্য একটি বিশ্বস্ত ও দক্ষ পদ্ধতি চালুর দাবি উচ্চারিত হয়ে আসছে। এই অর্থ যাতে বিশ্বের সবচেয়ে সবচেয়ে দুস্থ শরণার্থী পরিবারগুলোর সাহায্যে ব্যয় হতে পারে সে কথাও বলে আসছিলেন অনেকে।

বর্তমানে ইসলামি অর্থনীতি যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। জাকাত ইসলামি অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে যাতে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।

সংস্তাটি বলছে সঠিকভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে জাকাত আদায় ও বিতরণ করার লক্ষ্যেই জাতিসঙ্ঘ জাকাত তহবিল গঠন করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তারা বলছেন, সারাবিশ্বে বলপূর্বক বাস্তচ্যুত মানুষদের বড় অংশই জাকাতের অর্থ পাওয়ার উপযুক্ত।

ইউএনএইচসিআর এর জাকাত কর্মসূচি সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড জাকাত ফোরামের নির্বাহী সেক্রেটারি ড. ইরফান সাইয়াউকি বেইক বলেন, শরণার্থীদের বিষয়ে নজর দেয়া বিশ্বের সব নেতার এবং জাকাত প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্ব। ইউএনএইচসিআর জাকাত কর্মসূচির ভূমিকা হবে শরণার্থীদের সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।

ইউএনএইচসিআর এং ওয়ার্ল্ড জাকাত ফোরাম তিনটি বড় ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অংশিদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে। এগুলো হচ্ছে- সক্ষমতা বৃদ্ধি, শরণার্থীদের মধ্যে জাকাত বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করা এবং জাকাত প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার কর্মসূচি পালন করা। এতে করে জাকাত আদায়ের কার্যক্রমে আরও গতি আসবে।