সৌদি-তুরস্ক সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রিয়াদের গুরুত্ব কমে গেলে তুরস্কসহ অন্য দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক স্বাভাবিক করার দিকে মনেযোগী হতে পারে - ইন্টারনেট

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৯ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৫৯

সৌদি আরব ও তুরস্কের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কে কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নভেম্বরের শুরুতে তুরস্কে ভূমিকম্পের পর ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিলো সৌদি আরব। মাসের শেষ দিকে এসে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনার দাবি করে দুই পক্ষ। এক দিকে দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম অন্য দিকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় নেতার টেলিফোন আলাপ কূটনৈতিক অঙ্গনে চমক সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন দুই দেশের জন্য দুই রকম বাস্তবতা নিয়ে এসেছে। তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক কি নতুন মোড় নিচ্ছে? কতটা সম্ভাবনা আছে তার? আজ আলোচনা করবো সৌদি আরব ও তুরস্কের সম্পর্কের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে।

আরব বসন্তের পর থেকে সৌদি আরব ও তুরস্কের মধ্যে সর্ম্পকে টানাপোড়েন চলছে। কিন্তু এর মাঝেও দুদেশের মধ্যে দূরত্ব কমানোর নানা উদ্যেগ ছিলো। ২০১৮ সালের আগস্ট মাস। সে সময় সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তুরস্ক। এক সৌদি নারী মানবাধিকার কর্মীর গ্রেফতার নিয়ে কথা বলে কানাডা। সৌদি আরব এটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো হিসেবে আখ্যায়িত করে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়। কানাডার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার ও দেশটির সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক স্থগিত করে রিয়াদ।

ওই সময় আরো অনেক মুসলিম দেশের মতো সৌদি আরবের পক্ষে অবস্থান নেয় তুরস্ক। আঙ্কারাও কানাডার অযাচিত আচরণের প্রতিবাদ জানায়। সেসময় অনেকেই মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার একটি সম্ভাবনা দেখেছিলেন, যদিও দুই মাস পরের একটি হত্যাকাÐ আবার দুই মেরুতে নিয়ে যায় রিয়াদ ও আঙ্কারাকে।

সেটি ছিলো সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকান্ড। যে ঘটনায় সৌদি আরবের শাসকরা বিশেষ করে প্রতাপশালী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান রীতিমতো ভিলেন হিসেবে পরিচিতি পান বিশ্বে। ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রায় নিখুঁত পরিকল্পনায় হত্যাকান্ড এবং কনস্যুলেট থেকে খাশোগির পোষাক পরে এক আততায়ীর খাশোগি সেজে বেড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক ছিলো; কিন্তু তুর্কি গোয়েন্দারা দৃশ্যপটে এসে পাল্টে দেন হিসাব। তারা একে একে খুঁজে বের করেন হত্যাকÐের অনেকগুলো প্রমাণ। এমনকি খাশোগির লাশ টুকরো করার সময় খুনিদের কথোপকথোনের রেকর্ডও তাদের হাতে আসে।

স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই হত্যকান্ড সংঘটিত হয়েছে সৌদি সরকারের শীর্ষ কোনো কর্মকর্তার নির্দেশে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের নাম মুখে না নিলেও তুর্কি প্রেসিডেন্ট পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই হত্যাকাÐের নির্দেশদাতা সে-ই। এরপর পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। সম্ভাবনার যে আলোক রেখা দেখা গিয়েছিল তা দ্রুতই মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।

ঐতিহাসিকভাবেই অবশ্য সৌদি আরব ও তুরস্কের সম্পর্ক খুব একটি প্রীতিকর নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় খিলাফার পরাজয়ের পরই সৌদি আরব রাষ্ট্র গঠনের পথ তৈরি হয়। তার আগে অবশ্য একশো বছর মক্কা ও মদীনার খাদেম ছিলেন ওসমানীয় শাসকরা। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের সময় থেকেও দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিলো। বাগদাদ চুক্তি, স্নায়ুযুদ্ধ, ইরান-ইরাক যুদ্ধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে উভয় দেশ একই ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। এসময় বিভিন্ন ইস্যুতে মত-দ্বিমত থাকলেও সেটি কখনো বৈরীতায় রূপ নেয়নি। বরং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমশ বেড়েছে; কিন্তু সব কিছু পাল্টে দেয় আরব বসন্ত।

গণবিক্ষোভের মুখে আরব বিশ্বে যখন ক্ষমতা আকড়ে থাকা একের পর এক শাসকের পতন হচ্ছে, সৌদি আরব সেই ধাক্কা সামলাতে অবস্থান নেয় এই গণআন্দোলনের বিপক্ষে। অন্য দিকে তুরস্ক পক্ষ নেয় গণতন্ত্রকামী জনতার। শুরু হয় দুই রাষ্ট্রের দূরত্ব বৃদ্ধি।

মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয় আতঙ্কিত করে তোলে সৌদি শাসকদের। এরপর দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে সৌদি পৃষ্ঠপোষকতার কথাও গোপন থাকেনি। অন্যান্য দেশগুলোতেও ব্রাদারহুড কিংবা অন্য ইসলামপন্থী রাজনীতি ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সৌদি আরব। অন্যদিকে তুরস্ক বরাবরই মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছিল।

যে কারণে ২০১৪ সালে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে তুরস্কের মনোনয়নের প্রকাশ্য বিরোধীতা করে সৌদি আরব। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে শুরুতে দুই দেশ একই লক্ষ্যে মাঠে নামলেও কিছুদিন পর তৈরি হয় বিভক্তি। বাশার আল আসাদকে হঠানোর মিশনে তুরস্ক ও সৌদি আরব এই লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে, উভয় দেশই সমর্থন নেয় বিরোধীদের। এরপর বিরোধীদের মধ্যে তুরস্ক উদারপন্থীদের ও সৌদি আরব রক্ষণশীলদের সমর্থন দেয়। এ নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয় আঙ্কারা ও রিয়াদের।

আর ২০১৭ সালের কাতার ইস্যুতো দুই রাষ্ট্রকে সরাসরি একে অন্যের বিরুদ্ধেই দাড় করিয়ে দেয়। ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও আলজাজিরা চ্যানেল বন্ধ করাসহ বেশ কিছু দাবি নিয়ে কাতারের সাথে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরবসহ কয়েকটি মিত্র দেশ। কিন্তু ছোট্ট দেশটির পাশে দাড়ায় তুরস্ক। তুরস্কের সহযোগিতায় আবরদের অবরোধ সত্তে¡ও টিকে যায় কাতার।

এরপর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধেও পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় দেশ দুটি। আর সর্বশেষ উপলক্ষ হিসেবে আসে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যকান্ড। কিন্তু এতকিছুর পরেও সুরঙ্গের শেষ মাথায় দেখা গেছে আলোর রেখা। এ মাসেই তুরস্কের ইজমিরসহ কয়েকটি এলাকায় মারাত্মক ভ‚মিকম্পের পর ত্রাণ সহযেগিতা নিয়ে দেশটির প্রতি সহমর্মিতা দেখায় রিয়াদ। এই ঘটনাটি মুসলিম বিশে^র দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মাঝে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের আভাস দেয়।

এরপরই আসে জি-টুয়েন্টি সম্মেলন। বিশ্বের বড় অর্থনীতির ২০টি দেশের জোটের এবারের সম্মেলনের আয়োজক ছিলো সৌদি আরব। করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে এবারের সম্মেলন ভার্চুয়ালি আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনের প্রাক্কালে বাদশাহ সালমান ফোন করেন রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ানকে। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দফতর জানিয়েছে, সম্মেলনের বিষয় ছাড়াও পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে আন্তরিক আলোচনা হয়েছে দুই নেতার। আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার মতবিরোধ নিরসনের ব্যাপারেও আগ্রহী হয়েছেন তারা।

এই ঘটনার একদিন পর সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ বলেছেন, আঙ্কারা ও রিয়াদের সম্পর্ক খুবই ভালো ও আন্তরিক। আর এই ঘটনাগুলোকেই দুই দেশের সম্পর্কের নতুন মোড় নেয়ার আভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরেই পরস্পর বিরোধী অবস্থান নেয়ার পরও কেন হঠাৎ দেশ দুটি সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আগ্রহী হচ্ছে সেটি চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে।

এর একটি কারণ হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ককেশাসসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তুরস্কের দাপট বৃদ্ধি। সৌদি আরব যেসব জায়গায় তুরস্কের সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে তার কোনটিতেই সফল হতে পারেনি। রিয়াদের চোখের সামনেই কাতারকে কিভাবে টিকে থাকতে সহযোগিতা করেছে তুরস্ক সেটি কারো অজানা নয়। লিবিয়াতেও খলিফা হাফতারকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে তুরস্ক। সর্বশেষ আজারবাইজানকে জিতিয়েছে আর্মেনীয়ার বিরুদ্ধে নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধে। এসব দেখে হয়তো সৌদি আরব বুঝে নিতে পারে যে, তুরস্কের সাথে বৈরীতা নয় বরং সুসম্পর্ক রক্ষাই তার জন্য লাভজনক হতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তুরস্ক এখন বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। তুরস্ককে কোনঠাসা করার সৌদি- আমিরাতি প্রচেষ্টা খুব একটা কার্যকর হবে না তা ইতোমধ্যে প্রমান হয়েছে। বরং কাতারসহ আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোতে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি দেশটির কৌশলগত অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে। ফ্রান্সের তৎপরতা সত্তে¡ও ইউরোপীয় দেশগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি নেয়া থেকে বিরত থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের বিজয় এ অঞ্চলের পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় ও জো বাইডেনের জয় সৌদি আরবকে আরো বেশি চিন্তায় ফেলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুগে সৌদি আরব ছিলো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। ট্রাম্প ইরানের ওপর ছিলেন কঠোর, যেটি রিয়াদও মনে প্রাণে চায়। কিন্তু জো বাইডেন আভাস দিয়েছেন ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি পুণরায় বাস্তবায়ন করার। তেমনটি হলে ইরানের দাপট আরো বেড়ে যাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আধিপত্য হুমকির মুখে পড়বে।

অন্যদিকে বাইডেন তুরস্ককে কাছে টানবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ রাশিয়াকে মোকাবেলা করতে হলে আঙ্কারাকে কাছে টানা ছাড়া ওয়াশিংটনের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। ন্যাটো সদস্য দেশ হয়েও তুরস্ক এখন রাশিয়ার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। যেটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প এসবকে গুরুত্ব না দিলেও ঝানু রাজনীতিক বাইডেন বিষয়টিকে হালকা ভাবে দেখবেন না বলেই মনে হচ্ছে। ট্রাম্পের যুগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিশ্বে যতটা কমেছে বাইডেনের প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো সেটি ফিরিয়ে আনা। আর বাইডেন সেটি করতে গিয়ে তুরস্ককে দূরে সরিয়ে রাখবেন না তা নিশ্চিত। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবও এর একটি কারণ হতে পারে।

এই হিসাবগুলো মাথায় রাখলেই তুরস্কের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করতে সৌদি আরবের আগ্রহের একটি কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রিয়াদের গুরুত্ব কমে গেলে তুরস্কসহ অন্য দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক স্বাভাবিক করার দিকে মনেযোগী হতে পারে। সৌদি- তুর্কি বানিজ্যিক সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো। এবার রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হলে লাভ হবে উভয়েরই। আর মুসলিম বিশে^র এই দুটি দেশের সম্পর্ক আবারো উষ্ণ হলে সেটি নিঃসন্দেহে বিশ^ রাজনীতিতেই নতুন কোন গতিপথ তৈরি করতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে