ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়ছে

এসব দেশের বৈদেশিক নীতি বা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা ইমরানের জন্য বেশ কঠিন। কার্টুনটি করেছেন অমিত - নিউ ইনডিয়ান এক্সপ্রেস

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২২ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৩৩

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বীকার করেছেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য তার দেশ ও সরকারের ওপর ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ইমরান খান দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যুগের পর যুগ চলে আসা ফিলিস্তিন ইস্যুর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান ছাড়া ইসলামাবাদ কখনোই জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে না।

পাকিস্তানের একটি টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাতকার দেয়ার সময় ইমরান খান স্পষ্ট করে বলেননি কোন দেশটি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ দিচ্ছে। উপস্থাপক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কোন দেশটি আপনার ওপর এত চাপ দিচ্ছে? মুসলিম কোনো রাষ্ট্র নাকি অমুসলিম রাষ্ট্র? উপস্থাপক এ ব্যাপারে ইমরান খানকে সোজাসাপটা উত্তর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার স্বভাবসুলভ এবং কুটনৈতিক ভঙ্গিতে উপস্থাপককে বললেন, এ প্রশ্নটি এখন মুখ্য নয়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু বিষয় থাকে যা আমরা চাইলেই খোলাসা করতে পারি না। তবে, এটুকু বলতে পারি, যে দেশই বলুক না কেন, তার সাথে আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমীরাত ও বাহরাইন সম্প্রতি তেলআবিবের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক চালু করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের আরো বেশ কয়েকটি দেশও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে ভাবছে। এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে ইমরান খান বলেন, আমাদেরকে আগে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী অবস্থানে যেতে হবে। নিজের পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর আমরা সব প্রশ্নের উত্তর খোলামনে দিতে পারবো।

ইসলামাবাদ এখনো অনেক ক্ষেত্রে তেলসমৃদ্ধ দেশ বিশেষ করে সৌদি আরব ও আমীরাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই এসব দেশের বৈদেশিক নীতি বা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা ইমরানের জন্য বেশ কঠিন। তবে, এরপরও ইমরান খান তার দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেন, কোনো কিছুর বিনিময়েই ইসরাইলকে সমর্থন করা বা স্বীকৃতি দেয়ার কোনো আগ্রহ বা পরিকল্পনা তার সরকারের নেই।

ইমরান খান বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে এবং ফিলিস্তিনের জনগণের সন্তোষজনক কোনো সুব্যবস্থা নিশ্চিত না হলে ইসরাইলের ব্যাপারে পাকিস্তান বিন্দুমাত্র নমনীয় হবে না।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ’র কথা উল্লেখ করে ইমরান খান জানান, জিন্নাহকে বারবার অনুরোধ করা স্বত্বেও তিনি কখনোই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেননি। ইমরান খানের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও সরকারের ওপর ইসরাইলের প্রভাব খুব বেশি। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও পাকিস্তানের ওপর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য চাপ আছে বলেও ইমরান খান ইংগিত দেন।

পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেয়ার মূল কারণ হলো দেশটির ওপর ইসরাইলী এবং ইহুদি লবিংয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব। আর ট্রাম্পের সময়ে এসে ইহুদিদের এ প্রভাব ও আধিপত্য যেন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ইমরান খান তাই মনে করেন, আফগানিস্তান নয় বরং ইসরাইলকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন- তাই হবে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে ইসলামাবাদের আগামী সম্পর্ক কেমন হবে এ সম্পর্কে ইমরান খানকে বেশ কয়েকটি প্রশ্নও করা হয়। ইমরান বলেন, অনেকেই ভাবছেন আফগান নিয়ে বাইডেন খুব বেশি মাথা ঘামাবেন। আমার তা মনে হয় না। আমার ধারণা আফগান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বরং একই থাকবে। বর্তমানে মার্কিন নীতি নির্ধারকরা নানা ধরনের উদ্যেগ নিয়ে কাজ করছেন যাতে আফগানিস্তানে বিগত ১৯ বছর ধরে চলমান রক্তাক্ত সংঘাতকে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায়।
ইমরানের মতে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সরকারের জন্য আফগানিস্তান মূল ইস্যু নয়। বরং প্রকৃত ইস্যু হবে ইসরাইল। বাইডেন কীভাবে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেন তাই হলো দেখার বিষয়। ট্রাম্প ইসরাইলের সাথে সম্পর্ককে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। এখন দেখতে হবে, বাইডেনও একই পথে হাটেন নাকি তিনি এ সম্পর্কে কিছু ভিন্নতা নিয়ে আসতে সক্রিয় হন।
ইসরাইল, ইরান এবং কাশ্মীর ইস্যুতে বাইডেনের নীতি কী হবে- তা এখুনি বোঝা যাচ্ছে না। তবে নিশ্চিত আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে কুটনৈতিক নীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট উভয় দলই এখন আফগানিস্তান থেকে অবিলম্বে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার চায়।

কাশ্মির ইস্যুতেও ইমরান খানকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, কাশ্মির ইস্যুতে ভারত খেই হারিয়ে ফেলেছে। গত বছরের আগষ্টে কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন বাতিল করে দিয়ে নয়াদিল্লী যে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাতে কাশ্মিরে শান্তি আসেনি। বরং কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন এবং ভারত বিরোধী আবেগ অনুভূতি আরো প্রকটতর হয়েছে।

ইমরান খানের মতে , ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত যে বিতর্কিত অবস্থান নিয়েছিল, তারপর থেকে ভারতের হাতে আর খুব বিকল্প পথ খোলা নেই। ভারত পরিস্থিতিকে নিজেদের ভুলের কারণেই এমন দিকে নিয়ে গেছে। কাশ্মিরের কেউই আর ভবিষ্যতে ভারতপন্থী রাজনীতি যোগ দিতে চাইবে না। শুধু তাই নয়, এত দিন কাশ্মীরে ভারতপন্থী যেসব মিত্র রাজনৈতিক দল ছিল সেগুলোও বিজেপি সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

শুধু কাশ্মির নয় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া যুদ্ধ নিয়ে ইমরান পাকিস্তানের অবস্থান তুলে ধরেছেন। নাগোরনো কারাবাখ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইমরান খান প্রথমে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য আজারি সেনাদেরকে অভিনন্দন জানান। ইমরান বলেন, আজারবাইজানের সেনারা এ যুদ্ধে তাদের চরম সাহসের দৃষ্টান্ত রেখেছে। তিনি বলেন, নাগোরনো কারাবাখ নিয়ে কার্যত কখনোই কোনো বিতর্ক ছিল না। সারা পৃথিবীর সকল দেশই জানে যে, নাগোরনো কারাবাখ ভৌগলিকভাবে আজারবাইজানের আওতায়। তাই আজারিরা শুধু এ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে নিজেদের স্বীকৃত ভুখন্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আর কিছু নয়।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে নীরবে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সৌদি - আমিরাতি বলয়ের বাইরে পাকিস্তান ঘনিষ্টতা বাড়িয়েছে তুরস্কের সাথে। আজারবাইজানের পক্ষে পাকিস্তানের জোরালো অবস্থানের প্রতিদান ইসলামাবাদ পেতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। সৌদি আরবের ওপর পাকিস্তানের জ্বালানী নির্ভরতা অনেকটা কমে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে আজারবাইজান। ইতোমধ্যে পাকিস্তানে জ্বালানী সরবরাহের আর্ন্তজাতিক টেন্ডারে অংশ নিয়েছে আজারবাইজান।

পাকিস্তানের জন্য বড় সঙ্কটের কারণ হলো দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি। যদিও এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় এই মুহুর্তে পাকিস্তানের অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রকোপে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যখন বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে তখন রুপীর মান বেশ বেড়েছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে রূপীর এ উত্থান পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে কিছুটা সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। তবে, আগামীতে ইসলামাবাদের বেশ কিছু বড়ো ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

পাকিস্তান সৌদি আরব থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। এ বছরের মে মাসে তার মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার দেশটি পরিশোধ করেছে। খুব শীঘ্রই বাকি ২ বিলিয়ন ডলারও পাকিস্তানকে পরিশোধ করতে হবে।

অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের থেকে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে পারে। এর আগেও চীন পাকিস্তানকে বিশাল পরিমান অর্থ সাহায্য প্রদান করেছিল। বেইজিং এখন চায়না পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোরের বিষয়ে খুবই ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। তবে অর্থ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে চীন বসে থাকবেনা। বরং ভৌগলিকভাবে পাকিস্তানের অবস্থান চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় চীন বরাবরই পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। এর অংশ হিসেবে চীন পাকিস্তানকে চাহিদা মাত্রই ঋণ দিতে পারে।

তবে পাকিস্তানী রূপীর এ উদীয়মান যাত্রা থেমেও যেতে পারে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেহেতু শেষ হয়ে গেছে তাই এখন ডলারের মান আবারও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, প্রতিবেশি দেশ ভারতের মুদ্রার মান এ মুহুর্তে খুব বেশি ভালো নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জো বাইডেনের বিজয় চুড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা আস্তে আস্তে কমে আসবে। বাইডেনের বিজয়ে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের তিক্ততা কমবে। ফলে তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে কমতে পারে। এরকমটি হলে ভারতের মুদ্রার দাম বেড়ে যাবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন পাকিস্তান অর্থনীতির সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারলে আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখাতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ইরানের সাথে পাকিস্তানের সর্ম্পক অনেক গুরুত্বপূর্ন। বাইডেন ইরানের সাথে পরমানু চুক্তি আবার শুরু করতে পারেন। এতে ইরানের সাথে শুধু ইউরোপের দেশগুলো নয় পাকিস্তান, চীন ও ভারতের সাথে সর্ম্পকের ওপর প্রভাব ফেলবে। চীনের সাথে ইরানের ঘনিষ্ট সর্ম্পক রয়েছে। পাকিস্তানের সাথে ইরানের সর্ম্পক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। সব মিলিয়ে পাকিস্তান এখন বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে নতুন মেরুকরুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে